হুমায়ূন কবীর ঢালী
ছেলেবেলার গল্প দিয়েই শুরু করি।
বিকেলে অন্যরকম একটা খেলা ছিলো বন্ধুদের মাঝে। কাশফুল খেলা। খেলাটা ছিলো গুচ্ছ কাশফুল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আসা একাকী কোনো ফুল নিয়ে। উড়ে আসা কাশফুলটাকে বন্ধুদের মধ্যে কে বেশি ফুঁ দিয়ে উপরে তুলতে পারে। মাটিতে কিংবা কোনো ডালে বসার আগে কতক্ষণ হাওয়ায় ভাসিয়ে রাখতে পারে। বাতাস যত প্রবল হতো, আমাদের খেলা হতো ততো প্রাণবন্ত। ফুঁ দিতে দিতে গাল ব্যথা হয়ে যেত। পা ব্যথা করত। চোখ ঝাপসা হয়ে আসত। কিন্তু খেলায় বিরতি নেই। কেবলি জেতার চেষ্টা। কখনো কখনো বাতাসের তালে উড়ে যেত দূরে। কোথায় যায়, কত দূরে যায়, অপলক দৃষ্টি তা অবলোকন করত গভীর উচ্ছলতায়। পরাজয়ের কালিমা দূর হয়ে যেত। খেলা সাঙ্গ করে ফিরে যেতাম বাড়ি।
সেই কাশফুল, যা শরতের শুভ্র প্রতীক। প্রকৃতিতে কাশফুলের আনাগোনা দেখলেই আমরা বুঝতে পারি যে শরত্ ঋতু এসেছে! একান্তই আমাদের নিজস্ব ফুল কাশফুল। জন্ম এ উপমহাদেশেই। ভারত, নেপাল, ভুটান, আফ্রিকা প্রভৃতি দেশেও কাশফুল ফোটে। ফুল হিসেবে কাশফুলের কোনো কদর নেই, কেউ তা চাষও করে না। বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই নদীর ধার, জলাভূমি, চরাঞ্চল, শুকনো রুক্ষ এলাকা, পাহাড় কিংবা গ্রামের কোনো উঁচু জায়গায় কাশফুলের রাশি অপরূপ শোভা ছড়ায়। মূলত নদীর তীরেই বেশি দেখা যায় কাশফুল। কারণ, নদীর তীরে পলিমাটির আস্তর থাকে এবং এই মাটিতে কাশের মূল সহজে সম্প্রসারিত হতে পারে।
শরতের অন্যতম বড় আকর্ষণ কাশফুল! কাশফুলের এ অপরূপ সৌন্দর্য পুলকিত করেনি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে এদেশে কাশফুল ছিল। কাশফুলের জাত ভাইয়ের নাম কুশ। কাশফুল মনের কালিমা দূর করে। শুভ্রতা অর্থে ভয় দূর করে শান্তির বার্তা বয়ে আনে। শুভ কাজে কাশফুলের পাতা বা ফুল ব্যবহার করা হয়।
বিস্তীর্ণ নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা আর কাশফুলের সমারোহ শরৎ প্রকৃতির এক নান্দনিক রূপ। কাশফুল প্রাণবন্ত ঋতু শরৎকালীন ফুল। ধবল কাশফুল শোভন সুন্দর বলে সবুজ প্রাণ আর মেঘের আকাশ মিলে মূর্ত প্রকৃতি নয়নাভিরাম হয়ে ওঠে। সাদা কাশফুল যখন বাতাসের দোলায় দুলতে থাকে তখন মনটাও আন্দোলিত হয়। কাশফুল আবহমান বাংলার চিরায়ত শরতের সুনন্দ স্নিগ্ধ ফুল। শরৎ ঋতুতে ফোটা দৃষ্টিনন্দন কাশফুল ব্রহ্মপুত্রের অপার সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলেছিলেন খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদীন তার চিত্রকর্মে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ ‘পুরাণ’-এ কুশের স্থান খুব উঁচুতে।
কবি-সাহিত্যিকদের লেখায় কাশফুল উঠে এসেছে নানাভাবে। রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন গ্রন্থ ‘কুশজাতক’ কাহিনী অবলম্বন করে ‘শাপমোচন’ নৃত্যনাট্য রচনা করেছেন।
বর্ষা-বিদায় কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম শরতের সাদা মেঘকে কাশফুলের সাথে তুলনা করেছেন।
“ওগো ও কাজল মেয়ে,
উদাস আকাশ ছলছল চোখ তব মুখে আছে চেয়ে।
কাশফুল সম শুভ্র ধবল রাশ রাশ শ্বেত মেঘে
তোমার তরীর উড়িতেছে পাল উদাস বাতাস লেগে।”
জীবনানন্দ দাশের অনেক কবিতায় কাশফুলের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে।
“ধূ ধূ মাঠ,-ধানক্ষেত,-কাশফুল,-বুনোহাঁস,-বালুকার চর
বকের ছানার মতো যেন মোর বুকের উপর
এলোমেলো ডানা মেলে মোর সাথে চলিল নাচিয়া!”
কবি নির্মলেন্দু গুণের একটি কবিতা ‘কাশফুলের কাব্য’ প্রায়ই পড়ি। কী সুন্দর প্রেমানুভূতি, শৈল্পিক ও নান্দনিক সুর-ব্যঞ্জনায় কাশফুলের বৈশিষ্ট্য ছন্দপ্রকরণে তুলে ধরেছেন।
“ভেবেছিলাম প্রথম যেদিন ফুটবে তোমায় দেখব,
তোমার পুষ্প বনের গাঁথা মনের মত লেখব।
তখন কালো কাজল মেঘ তো ব্যস্ত ছিল ছুটতে,
ভেবেছিলাম আরো ক’দিন যাবে তোমার ফুটতে।
সবে তো এই বর্ষা গেল শরত এলো মাত্র,
এরই মধ্যে শুভ্র কাশে ভরলো তোমার গাত্র।
ক্ষেতের আলে নদীর কুলে পুকুরের ওই পাড়টায়,
হঠাৎ দেখি কাশ ফুটেছে বাঁশ বনের ওই ধারটায়।
আকাশ থাকে মুখ নামিয়ে মাটির দিকে নুয়ে,
দেখি ভোরের বাতাসে কাশ দুলছে মাটি ছুঁয়ে।
কিন্তু কখন ফুটেছে তা কেউ পারে না বলতে,
সবাই শুধু থমকে দাঁড়ায় গাঁয়ের পথে চলতে।
উচ্চ দোলা পাখির মত কাশ বনে এক কণ্বে,
তুলছে কাশের ময়ূর চূড়া কালো খোঁপার জন্যে।
শরত রানী যেন কাশের বোরখা খানি খুলে,
কাশ বনের ওই আড়াল থেকে নাচছে দুলে দুলে।
প্রথম কবে ফুটেছে কাশ সেই শুধুরা জানে,
তাইতো সেটা সবার আগে খোঁপায় বেঁধে আনে।
ইচ্ছে করে ডেকে বলি, ওগো কাশের মেয়ে-
“আজকে আমার চোখ জুড়ালো তোমার দেখা পেয়ে
তোমার হাতে বন্ধী আমার ভালবাসার কাশ
তাইতো আমি এই শরতে তোমার কৃতদাস”
ভালবাসা কাব্য শুনে কাশ ঝরেছে যেই
দেখি আমার শরত রানী কাশবনে আর নেই।”
… কাশফুলের কাব্য/নির্মলেন্দু গুণ
কবি শামসুর রাহমান নিজের বর্ণনা, তথা শুভ্রকেশরাশির উদাহরণ হিসেবে কাশফুলের কথা বলেছেন।
“এই পরিণতি জেনেও এখনো বেহায়া মাথায়
এক রাশ শাদা কাশফুল নিয়ে কখনো সকালে
দুপুরে অথবা গভীর নিশীথে কলম চালাই।”
… এই পরিণতি জেনেও এখনো/শামসুর রাহমান
কবি সুশান্ত হালদার ‘দেবী দুর্গতিনাশিনী’ কাব্যের শুরুতেই চয়ন করেছেন…
“শরতের শরবনে কাশফুলে প্রকৃতি হইয়াছে সুশোভিত
নীলাকাশেও সাদামেঘ করিতেছে আনাগোনা অবিরত।
মায়ের আগমনি বার্তা শুনিতেছি এই ত্রিভূবনে।”
পুঁথিগত ব্যাখ্যায় গেলে বলা যায়, কাশফুল একধরনের ঘাসজাতীয় জলজ উদ্ভিদ। এর বৈজ্ঞানিক নাম Saccharum spontaneum। উচ্চতায় সাধারনত ৩ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। মূলত ছন গোত্রীয় এক ধরনের ঘাস। কাশফুল পালকের মতো নরম এবং সাদা। গাছটির চিরল পাতার দুই পাশ খুবই ধারালো।
কাশফুল শুধু শরতে শুভ্রতার প্রতীকই নয়, এ ফুলের রয়েছে বেশ কিছু ঔষধি গুণ । যেমন- পিত্তথলিতে পাথর হলে নিয়মিত গাছের মূলসহ অন্যান্য উপাদান দিয়ে ওষুধ তৈরি করে পান করলে পিত্তথলির পাথর দূর হয়। কাশমূল বেটে চন্দনের মতো নিয়মিত গায়ে মাখলে গায়ের দুর্গন্ধ দূর হয়। এছাড়াও শরীরে ব্যথানাশক ফোঁড়ার চিকিৎসায় কাশের মূল ব্যবহৃত হয়।
হুমায়ূন কবীর ঢালী