যমজ দুই সন্তানের মা হতে যাচ্ছেন শুনে প্রথমে খুশি হয়েছিলেন আফ্রিকার দেশ হাইতির নাগরিক পলিন ফিলিপ। কিন্তু গভবর্তী হওয়ার এই খবরে পরমূহূর্তেই তিনি চিকিৎসকের সামনে কেঁদে ফেলেন। কারণ তার অনাগত সন্তানের পিতা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্য এবং সেই সন্তানকে স্বীকৃতি না দিয়েই সে তার দেশে ফিরে গেছে।
পলিনের সন্তানের জন্মদাতা হাইতির রাজধানী পোর্ট-অব-প্রিন্সে জাতিসংঘের একজন পুলিশ সদস্য হিসেবে অস্থায়ীভাবে কর্মরত ছিলেন। গর্ভধারণের বিষয়টি পলিন তাকে জানিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন। ২০১২ সালে যমজ পুত্র ও কন্যা সন্তানের জন্ম দেন পলিন। তার দুই মাস পরই ওই ব্যক্তি পলিন ও দুই সন্তানকে ফেলে নিজ দেশে ফিরে যান।
হাইতিতে হাজার হাজার দরিদ্র নারীর জীবনের গল্পটা পলিন ফিলিপের মতোই। দেশটিতে ২০১০ সালে শক্তিশালী ভূমিকম্পে লাখো মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এরপর কলেরায় আরও কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। ভয়াবহ এই বিপর্যয় মোকাবিলায় দেশটিতে শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়ন করে জাতিসংঘ।
অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন দেশের সামরিক-বেসামরিক বাহিনীর সদস্যরা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্য হিসেবে হাইতিতে কাজ করতে এসে শত শত শিশুর জন্ম দিয়ে ফেলে রেখে চলে গেছেন। ২০১০ সাল থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত জাতিসংঘ তাদের কর্মীদের বিরুদ্ধে ৪৬৩টি পিতৃত্বের দাবি নথিভুক্ত করেছে।
শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের যৌন নিপীড়নের শিকার এসব নারীদের অনেকেই সমাজের কলঙ্ক মাথায় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সন্তান প্রসবের পর একাই সন্তান লালনপালনের করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।
২০১৩ সালে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনান একটি বুলেটিন প্রকাশ করেছিলেন, যেখানে জাতিসংঘের কর্মী ও ত্রাণকর্মীদেরকে অবৈধ যৌন সম্পর্ক স্থাপনে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। কারণ এটি জাতিসংঘের দায়িত্বের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করে।
বর্তমান মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস জাতিসংঘের দায়িত্বকে আরও সুশৃঙ্খল করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। ২০১৭ সালে তিনি নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, যা কেবল দায়মুক্তির অবসান ঘটানোই নয়, পাশাপাশি ভুক্তভোগীদের অধিকার ও মর্যাদাকেও অগ্রাধিকার দেয়। তিনি জাতিসংঘে প্রথমবারের মতো নিপীড়নের শিকার ব্যক্তিদের সহায়তার জন্য আইনজীবী নিযুক্ত করেন এবং ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য একটি ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেন।
তবে পলিন ফিলিপসহ ভুক্তভোগী বেশ কয়েকজন নারীর দাবি, জাতিসংঘের এ সহায়তা খুবই সামান্য এবং তা নানা শর্তের বেড়াজালে আবদ্ধ। সন্তানের পিতৃপরিচয়, ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে জাতিসংঘের সহায়তা- এ ধরনের বেশিভাগ সহায়তাই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তারা পাননি। জাতিসংঘ অফিসের আচরণ সম্পর্কে এক নারী বলেন,‘তারা আমাদের মানুষ বলেই মনে করেন না।’
হাইতিতে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর লড়াইয়ে হাজার হাজার মানুষ ঘরছাড়া হয়েছে, দেশটিতে খাবার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। নারীরা সন্তানের লালনপালন ও খাবার জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছেন। অনেকেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।
অন্যদিকে জাতিসংঘের কর্মীদের যৌন নিপীড়ন থামছে না। চলতি বছরের জুনে আফ্রিকা থেকে ৬০ জন শান্তিরক্ষীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়। এদের মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে নাবালিকাকে নিপীড়নের অভিযোগও রয়েছে।
২০০৯ সালে হাইতির রাজধানী পোর্ট-অব-প্রিন্সে জাতিসংঘ মিশনের সদর দপ্তরে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে যোগ দেন পলিন। পরবর্তীতে শান্তিরক্ষী মিশনের এক পুলিশ সদস্য পলিনকে নিজের ব্যক্তিগত কাজে নিয়োগ দেন। এরপরই পলিনের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক গড়ে তোলেন তিনি। ওই ব্যক্তি দেশে ফিরে যাওয়ার এক বছর পর পলিন সিদ্ধান্ত নেন, জাতিসংঘের জানা উচিত তার সঙ্গে কী ঘটেছে। ২০১৪ সালে তিনি দুই সন্তানসহ পোর্ট-অব-প্রিন্সে জাতিসংঘ মিশনের সদর দপ্তরে যান। ২০১৫ সালে তার ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট পজিটিভ বলে জানানো হয়। ২০১৮ সাল থেকে এনজিওর মাধ্যমে জাতিসংঘের কাছ থেকে সন্তানদের জন্য তিনি অর্থ সাহায্য পেতে শুরু করেন। তবে চলতি বছরে এখন পর্যন্ত কোনো সাহায্য পাননি বলে পলিনসহ অন্যান্য নারীরা জানান।
পলিন বর্তমানে দুই সন্তানকে নিয়ে এক কক্ষের একটি বাসায় থাকেন। তার দুই সন্তান ছোট একটি বিছানায় ঘুমায় আর তিনি ঘুমান মেঝেতে। তার ছেলে বেশ কিছু দিন ধরেই ব্যথায় ভুগছে। কিন্তু সন্তানের চিকিৎসা করানোর মতো অর্থ তার কাছে নেই।
হাইতির লেস কায়েস শহরের জোকেনসি জিন নামে এক নারী নিজের দুর্বিষহ জীবনের কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। সেনেগালের এক শান্তিরক্ষীর সন্তানের মা তিনি।
জোকেনসি বলেন, ‘একবার কল্পনা করুন তো, সন্তানের স্কুলের ফি জোগাড় করে বাসায় ফিরে দেখলেন সে ক্ষুধায় কান্না করছে। আপনার তখন কেমন লাগবে।’
সাহায্য সংস্থার আচরণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘তারা আমাদের সঙ্গে বেশ্যার মতো আচরণ করে। কারণ আমরা গরিব।’
শান্তিরক্ষী বাহিনীর ফেলে যাওয়া সন্তানের লালনপালনের দায়িত্ব এখন এই মায়েদের একার। ফি দিতে না পারায় অনেক নারী তার সন্তানকে স্কুলেও পাঠাতে পারছেন না। জাতিসংঘের সাহায্য পেতে ডিএনএ টেস্ট, সন্তানের স্কুলের রশিদ বই সহ নানা ধরনের অপমানজনক শর্তের মুখোমুখি হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের।
জাতিসংঘ বা তাদের কর্মীদের দ্বারা যৌন শোষণ ও নিপীড়নে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় জাতিসংঘ ট্রাস্ট ফান্ডের ২০২২ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে ৪৮ লাখ ডলারের বেশি সহায়তার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ২০২১ সালে হাইতিতে চালু হওয়া দুই বছরের প্রকল্পে মাত্র দুই লাখ ৪০ হাজার ৭৩৮ ডলার ব্যয় করা হয়েছে।
একাধিক নারী জানিয়েছেন, তারা প্রতিশ্রুত সহায়তার এক চতুর্থাংশেরও কম পেয়েছিলেন। তবে সংস্থার মতে, বাকিটা অ্যাডহক খরচ এবং এনজিওর মাধ্যমে উন্নয়ন কার্যক্রমে ব্যয় করা হয়েছে।
উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা সরাসরি নগদ অর্থ প্রদানকে সবচেয়ে কার্যকর সহায়তা হিসাবে বিবেচনা করে থাকেন। জাতিসংঘ তাদের কর্মসূচিতে অন্যান্য ধরনের সাহায্য প্রাথীদের নগদ অর্থের সুবিধা দেয়। কিন্তু তা নিপীড়িতদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
এ প্রসঙ্গে ট্রাস্ট ফান্ডের প্রোগ্রাম অফিসার ইয়াসনা উবেরয় বলেন, জাতিসংঘের নীতি অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্তদের সরাসরি কোনো অর্থ প্রদান করা হয় না। ট্রাস্ট ফান্ড প্রকল্পটিও একই ধরনের। এক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ ও জীবিকার সুযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে সহায়তা করা হয়, যেন তারা তাদের জীবন পুনর্গঠন করতে পারে ও স্বাবলম্বী হতে পারে।
কিছু ব্যতিক্রম বাদে, শিক্ষা ও আরো কিছু মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ রশিদ দেখানোর কথা বলে। এক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারী সংস্থা ক্ষতিগ্রস্তদের উপকারে তহবিলের অর্থ কিভাবে ব্যয় করা হবে সেই সিদ্ধান্ত নেয়।
হার্ভার্ড ল স্কুলের প্রভাষক এবং হাইতির ইনস্টিটিউট ফর জাস্টিস অ্যান্ড ডেমোক্রেসির সাবেক লিগ্যাল ডিরেক্টর বিট্রিস লিন্ডস্ট্রম বলেছেন, ‘এই ধরনের তহবিল যেভাবে পরিচালিত হয় তা মৌলিক মানবিক মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করে। কেননা নিপীড়িতরা জানে না তাদের কী হবে বা যে ধরনের সহাতায় পায় তা নিয়ে তারা কোনো কথা বলতে পারে না।’
সমাজকর্মী পলা ডোনোভান বলেন, ‘মনে করুন আপনাকে একজন ধর্ষণ করেছে, এরপর সেই ব্যক্তির নিয়োগদাতার একজন প্রতিনিধি আপনাকে সাহায্য করার জন্য আসে এবং বলে, আপনি জানেন ন্যায়বিচার দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। আপনার কি একটি সেলাই মেশিন প্রয়োজন?’
এদিকে কর্মীদের মাধ্যমে নিপীড়িত ব্যক্তিদের আইনি সহায়তায় নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের যে ভিকটিম রাইটস অফিস রয়েছে সেখানে আইনি সহায়তা নিয়েও রয়েছে অভিযোগ। পলিন ২০১৮ সালে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ নিযুক্ত আইনজীবী জেন কনরসের কাছে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে তিনি নিজের পক্ষে হাইতির কোনো আইনজীবী, সংবাদিক বা শিশু অধিকারের প্রতিনিধি পাননি।
পলিন বলেন, ‘সেখানে আমাদেরকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল, যাতে জাতিসংঘের মহাসচিবের প্রতিনিধির কাছে আমাদের কান্না বা দুর্দশার তথ্য পৌঁছাতে না পারে।’
নিউ ইয়র্কের একজন আইনজীবী সিয়েনা মেরোপে বলেন, এই নারীদের জন্য সহায়তাকে ‘আইনি অধিকারের বিকল্প’ হিসেবে দেখা উচিত নয়। জাতিসংঘ আসলে জবাবদিহিতায় নিজেকে জড়াতে চায় না।
জাতিসংঘের নিজস্ব নিয়মঅনুযায়ী, যৌন নিপীড়ন ও নির্যাতনের জন্য কেবল স্বতন্ত্র অপরাধীরাই দায়ী, জাতিসংঘ নয়। জাতিসংঘের নিয়মে আরো উল্লেখ রয়েছে, শান্তিরক্ষীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কেবল তাদের নিজ দেশের আইনের কাছে জবাবদিহি করতে পারে। এর মানে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা যায় না এবং শিশু অধিকারের জন্য মামলা মানে অকল্পনীয় এক আন্তর্জাতিক যুদ্ধে নামার শামিল। জাতিসংঘের মতে, পলিনের এই অবস্থার জন্য কেবল তার সন্তানের বাবাই দায়ী।
পলিনের প্রশ্ন, ‘জাতিসংঘ তাহলে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য অফিস কেন খুলল? ’
তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘও এক্ষেত্রে দায়ী। ওই ব্যক্তিকে জাতিসংঘ এখানে নিয়ে এসেছে। আমি তার সঙ্গে দেখা করতে তার দেশে যাইনি।’
শান্তিরক্ষী বাহিনীর সন্তান গর্ভে ধারণ করার আগে পলিন যে জীবনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা এখন বিবর্ণ। বর্তমানে রাস্তায় খাবার বিক্রি করে দিন কাটে তার। এর মধ্যে অনেক দিন অনহারেও কেটে যায়।
তিনি বলেন, ‘সন্তানের মা হওয়াটা প্রতিটি নারীর জন্য গর্বের বিষয়, সেই গর্ব তখনই আসে যখন আপনার সবকিছু থাকে। কিন্তু আমি সন্তানের মা হিসেবে গর্ব করতে পারি না। মাঝে মধ্যে জাতিসংঘের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলতে ইচ্ছে হয়, যথেষ্ট হয়েছে, আমি আর পারছি না।’