চারুশিল্পী, নাট্য নির্দেশক, শিল্প গবেষক- একসঙ্গে তিনি অনেক গুণের অধিকারী। সৃজনকর্মে গোটা দেশকেই ‘গৌরবান্বিত’ করেছেন সব্যসাচী এই শিল্পী। বাংলাদেশে পাপেট চর্চার অন্যতম প্রাণপুরুষ মুস্তাফা মনোয়ারের জন্মদিন আজ। শুভ জন্মদিন মুস্তাফা মনোয়ার।
১৯৩৫ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি যশোরে জন্মগ্রহণ করেন। আজ তিনি ৮৫ পেরিয়ে ৮৬-তে পা রাখলেন। দেশ বরেণ্য এই শিল্পীর ডাক নাম মন্টু। অতি আপনজনদের কাছে তিনি এখনো প্রিয় ‘মন্টু ভাই’। যিনি সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালোবেসে কখনো বিদেশের দিকে মুখ ঘুরাননি। আজ শিল্প-সংস্কৃতির জগতে তার অবদান দেশের সকলকে গৌরবান্বিত করেছে।
তার বড় হয়ে ওঠাও ছিল একটি শিল্পীত ও স্বাধীন পরিবেশের মধ্যে। স্কুলে থাকতে বাবার ক্যামেরা দিয়ে ফটোগ্রাফি করতেন। তার বাবা কবি গোলাম মোস্তফা ছিলেন শিল্পরসিক। তিনি শুধু কবিতাই লিখতেন না, ভালো গানও গাইতেন। তার মায়ের নাম জমিলা খাতুন। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে মুস্তাফা মনোয়ার ছিলেন সবার ছোট।
১৯৫২ সালে মুস্তাফা মনোয়ার নারায়ণগঞ্জ হাই স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়তেন। তখন ভাষা আন্দোলনের জন্য কার্টুন এঁকে এক মাসের জন্য জেলে গিয়েছিলেন। এসব ঘটনা তাঁর মনে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর আগ্রহ তৈরি করে। বাড়ি থেকে স্কুলে প্রথম হওয়ার চাপ ছিল না। বাবা কেবল বলতেন পড়তে, জানতে।
মুস্তাফা মনোয়োর তার কর্মজীবন শুরু করেন পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে। এরপর একে একে কর্মজীবনে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের উপ-মহাপরিচালক, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক, জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ টেলিভিশন, ঢাকা’র জেনারেল ম্যানেজার এবং এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে কর্মরত ছিলেন। তিনি জনবিভাগ উন্নয়ন কেন্দ্রের চেয়ারম্যান এবং এডুকেশনাল পাপেট ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন।
নিজের ভেতরেই কাজ করার অসম্ভব তাগিদ তার। জলরঙে ভালো ছবি আঁকতেন। আর্ট কলেজে পড়ার সময় কলকাতায় যখন ছিলেন, খুব নাম হয়েছিল। নির্মাতা সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, তার আঁকা ছবি খুব অল্পতে কথা বলতে পারে।
একসময় কলকাতার বিভিন্ন নাটকের দলের সঙ্গে কাজ করেছেন। ওস্তাদ ফাইয়াজ খাঁর ছাত্র সন্তোষ রায়ের কাছে আলাদা করে গানও শিখতে শুরু করেছিলেন। সে সময় শিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরীর দলে তিন বছর গান করেছেন। পরে মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় ওয়াহিদুল হক ও সন্জীদা খাতুনের উদ্যোগে যে সাংস্কৃতিক দল গড়ে উঠেছিল, সেখানে যোগ দিয়ে বিভিন্ন স্থানে দেশাত্মবোধক গানও গেয়েছেন।
এরই মধ্যে সত্তরের নির্বাচন পেরিয়ে এল একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চ। ২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস। তখন টেলিভিশনে অনুষ্ঠান শেষের পর পতাকা ওড়ানো দেখানো হতো। পাকিস্তান দিবসে পাকিস্তানের পতাকা টেলিভিশন অনুষ্ঠানে দেখানো হবে না—এ রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন পিটিভি ঢাকা কেন্দ্রের কর্মকর্তারা। এদের মধ্যে মুস্তাফা মনোয়ার ছিলেন অন্যতম। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার কথা রাত ১০টায়। কিন্তু সেদিন অনুষ্ঠান শেষ করা হলো রাত ১২টা পার হওয়ার পর। ততক্ষণে ২৪ মার্চ হয়ে গেছে, পতাকা দেখিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করা হলো।
বাংলাদেশে পাপেট শো ছড়িয়ে দেওয়ার পেছনে তার একক অবদানই বেশি। হুগলি, বাঁকুড়া, কলকাতায় পাপেট দেখে এ ব্যাপারে আগ্রহ জন্মে। তার অনবদ্য সৃষ্টি পাপেট চরিত্র ‘পারুল’। পারুলকে দেখেই ইউনিসেফের র্যাচেল কার্নেগি উৎসাহিত হন। তৈরি হয় ‘মীনা’ চরিত্রটি।
এই প্রতিভাবান জীবন্ত কিংবদন্তিতুল্য মানুষটির জন্মদিনে আমাদের শুভেচ্ছা।