-মোরসালিন মিজান
শেখ মুজিবুর রহমান নামটি মুছে ফেলতে হবে। সে লক্ষ্যে অযুত ষড়যন্ত্র। দেশী-বিদেশী তৎপরতা। অথচ ইতিহাস নিজের প্রয়োজনেই বাঁচিয়ে রাখল তার বরপুত্রকে। মৃত্যুর এতকাল পরও মুজিব নামে জয়ধ্বনি হচ্ছে। নতুন নতুন রূপে সামনে আসছেন বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা। সর্বশেষ তাঁকে পাওয়া হলো ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অফ দা নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ শিরোনামের সিরিজ গ্রন্থে। এখানে যে দৃষ্টিকোণ থেকে মুজিবকে তুলে ধরার প্রয়াস, তা আলাদা তাৎপর্যের। বইতে পাকিস্তানী গোয়েন্দাদের চোখে দেখা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি পদক্ষেপ অনুসরণ করেছিল ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ বা আইবি। প্রতিদিনের বক্তৃতার নোট নিয়েছিল। লিখিত বিবৃতি, লিফলেট ইত্যাদি সংগ্রহ করে তার ভিত্তিতে নিজেদের মনগড়া প্রতিবেদন দাখিল করেছিল। এভাবে শেখ মুজিবুর রহমান নামে বিশালাকার ফাইল। স্পেশাল ব্রাঞ্চে খোলা ব্যক্তিগত ফাইলে জমা হয়েছিল দীর্ঘ ২৩ বছরের গোয়েন্দা প্রতিবেদন। আইবি’র সদস্যরা, আজ ভেবে অবাক হতে হয়, মোট ৪০ হাজার প্রতিবেদন দাখিল করেছিল!
এসব প্রতিবেদনের আলোকে গত বছর ১৪ খন্ডের প্রামাণ্য গ্রন্থ প্রকাশ শুরু করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট। পাঠকের হাতে বই তুলে দিচ্ছে হাক্কানী পাবলিশার্স। সম্পাদনার কাজ করছেন শেখ হাসিনা। এ ধরনের পুরনো প্রাচীন সরকারী সিক্রেট ডকুমেন্ট সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে সংগ্রহের চিন্তা, এ কাজে সফল হওয়া, সর্বোপরি গ্রন্থাকারে প্রকাশ্য বড় এবং বিরল ঘটনা। যারপরনাই চ্যালেঞ্জিং। তা সত্তেও শতভাগ উৎড়ে গেছেন শেখ হাসিনা। পিতাকে আরও একবার আবিষ্কার করেননি শুধু, নিজের ইতিহাস চেতনা ও দায়বোধের উজ্জ্বল প্রকাশ ঘটিয়েছেন। আগামী দিনের গবেষকদের হাতে সত্যি রত্ন ভান্ডার তুলে দিয়েছেন তাঁরা।
এরও কিছুকাল আগে প্রকাশিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে নিজ জবানীতে পাওয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। রাজবন্দী হিসেবে কারাগারে থাকা অবস্থায় বাঙালীর মহান নেতা তাঁর জীবনের ঘটনাবলী লিখতে শুরু করেছিলেন। খুব বেশি দূর এগোতে পারেননি, যেটুকু লেখা, বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে। তাতেই বিস্ময় কাটে না। এখনও বইটির পাতায় বুদ হয়ে আছেন পাঠক। এর পরপরই প্রকাশিত হয় ‘কারাগারের রোজনামচা।’ এতে শেখ মুজিবুর রহমানের জেল জীবনের দুঃসহ স্মৃতি। ডায়েরি হিসেবে নিজেই লিখেছিলেন তিনি। গ্রন্থ আকারে পেয়ে নেতার আত্মত্যাগ সম্পর্কে আরও গভীরভাবে জানার সুযোগ পান পাঠক।
ধারাবাহিক প্রকাশনার এ পর্যায়ে এসেছে ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অফ দা নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’ গ্রন্থ সিরিজের দুই খন্ড ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম খÐটি নিয়ে আজকের আলোচনা। পাকিস্তানী গোয়েন্দাদের চোখে কেমন ছিলেন তরুণ সম্ভাবনাময় নেতা শেখ মুজিব? এই খন্ডের আলোকে তা বিশ্লেষণ করা যাক।
প্রথমভাগটি সাজানো হয়েছে যে ফাইল দিয়ে সেটির নম্বর পিএফ ৬০৬-৪৮। ফাইলের উপরের দিকে ছোট করে শেখ মুজিুবর রহমান নামটি লেখা রয়েছে। আর বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে ‘কনফিডেন্সিয়াল।’ বইতে তুলে ধরা সব ডকুমেন্ট ইংরেজীতে লেখা। কখনও হাতে লেখা হয়েছে। কখনও টাইপ রাইটারে। এসব ডকুমেন্টের ভিত্তিতে যতটুকু সম্ভব ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় সাজানো হয়েছে প্রথম খন্ড।
বইয়ে ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫০ সালের ঘটনাবলী বিধৃত করা হয়েছে। সেই ১৯৪৮ সাল থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে অনুসরণ শুরু করে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা। তাকে অনুসরণ করার মতো অনেক কারণ ছিল। তাই বলে এত আগে থেকে? আজ ভাবলে অবাক হতে হয়। কারণ তখনও শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্র। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে স্নাত্বক শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ভর্তি হয়েছেন। আইন বিভাগে মাস্টার্স শুরু করেছেন। অবশ্য শুধু ছাত্রটি হয়ে তিনি ছিলেন না। দেশভাগের আগে ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় থেকেই মুজিব এক সম্ভাবনার নাম। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো কিংবদন্তি নেতা তাঁকে আগলে রেখেছিলেন। ওইটুকুন বয়সে পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনকে বেগবান করতে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। দুর্ভাগ্য এই যে, স্বপ্নের পাকিস্তান অচিরেই তাঁর জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে ধরা দিয়েছিল। নতুন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছিল শেখ মুজিবকে। প্রথমেই ভাষার লড়াই। ১৯৪৮ সালের ৪ মার্চ দাখিল করা গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে ভাষা সংগ্রামী শেখ মুজিবের নাম পাওয়া যায়। ১৯৪৯ সালের ১২ মার্চ দেয়া গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলরত কর্মচারীদের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
শেখ মুজিবুর রহমান সারাদেশ ঘুরে বক্তৃতা করেছেন। জনমত গঠনের চেষ্টা করেছেন। তাঁর জ্বালাময়ী প্রতিটি বক্তৃতা সংগ্রহ করেছে গোয়েন্দারা। এর পাশে নোট লিখে উর্ধতনদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। এমন বেশকিছু প্রতিবেদন বইতে যুক্ত করা হয়েছে। একইভাবে স্থান পেয়েছে বঙ্গবন্ধুর দেয়া বিবৃতির অনুলিপি। ১৯৪৯ সালের ১০ জানুয়ারি দেয়া একটি বিবৃতিতে জুলুম প্রতিরোধের আহ্বান জানান শেখ মুজিব। কড়া সমালোচনা করেন তৎকালীন সরকারের। এভাবে তাঁর জাতীয় নেতা হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপটটি যেন পাওয়া হয়ে যায় পাঠকের। ১৯৪৯ সালের ১১ আগস্ট পাঠানো একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়, মাওলানা ভাসানী শামসুল হক ও শেখ মুজিবুর রহমান সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে ফোনে কথা বলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ‘আনসুইটেবল’ সময়ের কারণে সম্ভব করতে পারছেন না। খ্যাতিমান সাংবাদিক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে অনুসরন করে এই তথ্য পেয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনের নিচের দিকে ছোট্ট নোট- ‘সাবমিটেড ফর ফেভার অব নেসেসারি এ্যাকশন।’ ১৯৫০ সালের প্রতিবেদনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলীম লীগের যুগ্ন সম্পাদক বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের খবর প্রকাশকারী পত্রিকার কপি। বোনের সঙ্গে মুজিব দেখা করতে চান। সেই আবেদন। শেখ মুজিবের নিজের লেখা এবং বঙ্গবন্ধুকে লেখা অনেক চিঠি যুক্ত করা হয় গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। জেলা ও মহকুমার নেতাদের লেখা সব চিঠি প্রাপকের হাতে পৌঁছেনি। চলে গিয়েছে গোয়েন্দা দফতরে। একইভাবে বঙ্গবন্ধুকে লেখা বহু চিঠি মাঝপথে গিলে ফেলে আইবি। এমন অনেকগুলো অপঠিত চিঠি সে সময়ের সরকারের নষ্ট রাজনীতির পরিচয় দেয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর লেখা একটি চিঠি পাঠে জানা যায়, তিনি বঙ্গবন্ধুসহ অন্য নেতাদের আইনী সহায়তা দিতে তাদের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চাইছেন। ১৯৫০ সালের ২১ জুলাই লেখা আবেদন গ্রাহ্য করেনি অমানবিক সরকার। এমনকি বিনা বিচারে বন্দী শেখ মুজিব ১৯৫০ সালের ১৫ মে জেলে থেকে আইন পরীক্ষা দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে লিখিত আবেদন জানান। কিন্তু জরুরী এ আবেদন শোনারও কেউ ছিল না তখন। এসবের বাইরে মুজিবের নামে, আহা, কত যে মামলা রুজু হয়েছিল! মিথ্যা মামলায় জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। বইতে বিভিন্ন সময় দায়েরকৃত মামলার তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। আছে চমকিত হওয়ার মতো আরও অনেক তথ্য উপাথ্য। এবং সব তথ্য উপাত্তই শেখ মুজিবকে আপোসহীন নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঙালীর সংগ্রামের আলেখ্য হয়ে ওঠে।
শেষ করার আগে গোপন নথি থেকে বই হয়ে ওঠার জার্নি সম্পর্কে একটু জেনে নেয়া যাক। শেখ হাসিনা বহু সাধনায় অমূল্য নথি সংগ্রহ করার কথা বইয়ের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন। ডকুমেন্ট সংগ্রহসহ প্রাসঙ্গিক অনেক প্রশ্নের জবাব দিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা লিখেছেন, ‘১৯৯৬ সালে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। আমি তখনই এই ফাইলগুলো সংগ্রহ করি এবং ১৯৯৭ সালে ফটোকপি করে রেখে পুনরায় ফাইলগুলো এসবি অফিসে ফেরত পাঠাই। ডকুমেন্টগুলো গোয়েন্দা সংস্থার গোপনীয় দলিল হওয়ায় ডি-ক্লাসিফাইড করা হয়। তিন কপি করে এক সেট আমেরিকায় জয়ের কাছে পাঠাই। জয় সেটা ড. এনায়েত রহিমের কাছে দেয়, কারণ তিনি ইতিহাসবিদ হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের উপর গবেষণা করছিলেন। এক সেট বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে রেখে দেই। একটা সেট নিয়ে আমি ও বেবি মওদুদ কাজ করতে শুরু করি। ২০০৮ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করার পর এসবিকেই দায়িত্ব দেই এই ফাইলগুলো কম্পিউটারে টাইপ করে প্রকাশের ব্যবস্থা করতে এবং মূল ডকুমেন্ট স্ক্যান করে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংগ্রহ করার জন্য। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এই কাজটা তারা সম্পন্ন করেছেন। একটা টিম দিনরাত পরিশ্রম করেছে।’
দ্বিতীয় দফায় ডকুমেন্ট উদ্ধারকারী টিমের নেতৃত্ব দিয়েছেন মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী। কাজটুকু সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের স্বার্থে তাকে দীর্ঘদিন এই পদে বহাল রাখা হয় বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। অবশ্য এর আগে এসবি’র ডিআইজি সামসুদ্দিনের সময় সমস্ত ফাইল সংগ্রহ করা হয়। রত্নভান্ডারের খোঁজ তার কাছ থেকেই প্রথম পেয়েছিলেন বলে জানান শেখ হাসিনা। তার মানে, দীর্ঘ জার্নি। এই জার্নি সফল না হয়ে পারে না।