|| এবিএম সালেহ উদ্দীন ||লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক ।
সূর্যের প্রখরতা কমে আসছে । গা পোড়ানো রোদ নেই । দুপুর গড়িয়ে বিকেলের সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। গাড়ি রেডি। সবার নিকট থেকে বিদায়পর্ব শেষ করে নীলা ড্রাইভারকে নিয়ে কমলাপুর রেল স্টেশনে রওয়ানা হল। ধানমন্ডি থেকে এলিফ্যান্ট রোড হয়ে কাঁটাবন, শাহবাগ হয়ে যাবার আগেই অতঃপর ট্রাফিক জ্যাম ! ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে ল্যাপ্টটার্ন করে হাতিরপুল থেকে পরিবাগ হয়ে শেরাটন হোটেলের সামনে দিয়ে
যাচ্ছে ।
শুক্রবার । ছুটির দিন । কোলাহল বিহীন সব রাস্তাই খোলা। নীলা জানে তাদের এই ড্রাইভারটি খুব চালু। নাম জসিম । তার ওপর নীলার পরিবারের সবার খুবই আস্থা। বিশ্বাসি, শিক্ষিত, ভদ্র, বিনয়ি এবং ভালো ড্রাইভ করে ।
পশ্চিমের আকাশ ঈষৎ হরিদ্রাভ। রাস্তার দুইদিকের সারি সারি গাছ-গাছালি। ফাগুনের হালকা বাতাসে সেইসব গাছের পাতার ঝিরঝিরে শব্দ যেন স্বরসঙ্গতির ছন্দোময়তায় এনে দেয় নুপুরধ্বনি । নীলা জানালা খুলে পত্র-পল্লবের মনোরম দৃশ্য অবলোকন করছে। প্রকৃতির স্নিগ্ধতায় অপরূপ সাজে সাজানো শহরের রাজপথ। সত্যিই এইসব মোহনীয় দৃশ্যে মন সতেজ হয়ে যায়। নীলার মনটিও যেনো প্রকৃতির প্রণতিতে দুলে উঠেছে ।
রমনা পার্কের পাশেই মিন্টুরোড পার হতেই মনে পড়ে গেল তিন যুবকের কথা। ওরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র । যার সঙ্গে নীলা খারাপ আচরণ করেছিল সে ছিল বেশ স্মার্ট ও লাজুক প্রকৃতির । এক বছর আগে ঘটনাটি এখানেই ঘটেছিল । হৃদয়ের অনন্তঃপুরের অনুকম্প উত্তাপে রুদ্ধকমলের মতো কম্পিত ও বিচলিত হয়ে উঠল নীলা । সেদিন রমনা পার্কে যুবকটির সঙ্গে কর্কশ স্বরে অহেতুক দুর্ব্যবহারে জন্য নীলা নিজের প্রতি ক্ষুব্ধ ও অনুতপ্ত । নীলা এখন বুঝতে পারছে মানুষকে কঠাক্ষ করতে নেই । ইচ্ছে করছে নিজের হাত দিয়ে জেদীস্বভাবের জন্য নিজের গালে কষে চড় মারতে।
হেমন্তের শান্ত বিকেল। হিমেল ছোঁয়ানো বাতাসের আশ্চর্য সজীবতা। মনের অজান্তেই নীলা আজ সেই যুবককেই খুঁজছে । যদি দেখা হত, ছেলেটির সামনে নিজের অহংবোধকে জলে ছুড়ে দিয়ে কাতরকন্ঠে বলত ‘সরি! আই অ্যাম ভেরি সরি..!’
কাকরাইলের বুক বেয়ে ফকিরাপুল হয়ে শা করে গাড়ি থামল কমলাপুর রেল স্টেশনে । মার্বেলখচিত স্টেশনের বুক দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে নীলা ট্রেনের নির্ধারিত কেবিনে ঢুকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ।
ট্রেন ছুটছে তিরবেগে । শা শা বাতাসের শব্দ । অদূরে যমুনার মতো শান্তঃজলধারা । বাহিরে সবুজচাদরে মোড়া প্রান্তরের দিকে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে আছে নীলা । হঠাৎ দরজায় শব্দ ।কেবিনের আরেক সিটের যাত্রী । চোখ ফেরাতেই এক সুদর্শন । নীলা এক নিরিখে তাঁকিয়ে রইল । সমস্ত দেহ মন জুড়ে কেমন যেন অচেনা শিহরণ ! মনের অজান্তেই হৃদয়ে জ্বলে উঠল অভেদ্য আলো ।
এক অবুঝ মায়ার স্নিগ্ধতায় নীলার চোখে ভালোবাসার আবির । এই সেই সুদর্শন (!) যাকে নীলা অপমান করেছিল । নীলার অপলক চোখে মিশে গেল যুবকেরও স্থির দুটো চোখ ।