শাহানা আকতার মহুয়া
শৈশব আর কৈশোর হচ্ছে স্বপ্ন দেখার বয়স। নির্মল কল্পনায় পৃথিবী গড়ার বয়স। কোমলতায়-স্বচ্ছতায় স্বপ্ন বোনার বয়স। সরল শিশুমন খোঁজে নতুন আলো, নতুন আকাশ, নতুন দিগন্ত- তার স্বপনমগ্ন মন পাখির মতো ডানা মেলে উড়ে যায় সুদূর পাহাড়ে, অরণ্যের সবুজ হৃদয়ে, সমুদ্রের অতলে। সুযোগ পেলেই পৌঁছে যায় কল্পনা আর রোমাঞ্চের জগতে। শিশুকে স্বপ্নের এই অলৌকিক জগতে হাত ধরে নিয়ে যায় শিশুসাহিত্য। সেই অর্থে শিশুসাহিত্যিকরা যেন রূপকথার সেই জাদুকর। যে জাদুকর ‘চিচিং ফাঁক’ মন্ত্র দিয়ে খুলে ফেলে শিশুমনের দুর্বোধ্য দুয়ার।
দেশী বা বিদেশী যে কোনো শিশুসাহিত্যের কথা বলতে গেলেই রূপকথারা মনে পড়ে যায়। ‘ঠাকুরমার ঝুলি’,‘আলিবাবা আর চল্লিশ চোর’, ‘আলাদিন’, ‘সিন্দবাদ’, ‘অ্যালিস ইন দ্য ওয়াণ্ডারল্যান্ড’, ‘গালিভারস ট্র্যাভেলস’ বা গ্রিম-অ্যান্ডারসনের রূপকথার গল্প নিয়ে শৈশব কাটেনি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। প্রায় অবোধ বয়সে পড়া বইগুলো এমন জীবন্ত হয়ে স্মৃতির মণিকোঠায় রয়ে গেছে যে, আমার মাঝে মাঝেই মনে হয় এই বইগুলোর সব চরিত্র সত্যিই জীবন্ত। ব্যস্ত জীবনে হয়ত প্রতিদিন দেখা হয় না তাদের সঙ্গে, কিন্তু মনে পড়লেই দেখি নিজেদের জীবন নিয়ে পায়ে হেঁটে কিংবা নদীর ঢেউয়ের মতো ভেসে ভেসে এসে ঠিক সঙ্গে সঙ্গেই চলছে তারা। সেই কাজলরেখা, কাঁকন দাসী, সুয়োরাণী-দুয়োরাণী…
ক্ষীরের সাগর, লবণের মতো ভালবাসা, চাঁদের বুড়ি আর সুখী-দুখীর গল্প কি রকম ব্যাকুল করে তুলত! আজো যেন শুনতে পাই তেপান্তরের মাঠে রাজ পুত্র ডালিম কুমারের ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ, দেখি মানিকজ্বলা খাটে শুয়ে আছে কঙ্কাবতী- ‘শিয়রে তাঁর সোনার কাঠি, রূপোর কাঠি পায়ে’। শৈশবে বহুবার ঘনরাতে পাখিদের কথোপকথন শুনে মনে হতো বুঝি ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী এসেছে। ওরা আলাপ করছে, একে অন্যকে দোষারোপ করে বলছে- মুই থুনু, না তুই থুলু! টাকার থলি কই থুলু? অদ্ভূত সব রূপকল্প!
যে কোনো দেশের সমাজে ছোটদের জীবন গড়ে তোলার কারিগর হিসেবে শিশু-কিশোর সাহিত্যিকদের অবদান অনেকখানি। শৈশবের অন্তর্লোকে পৌঁছুনো কিন্তু সহজ কথা নয়। শিশুমনের বৈশিষ্ট্য হল, বিষয়-বৈচিত্র্য খোঁজা। একই জিনিস বারবার পড়বে না তারা, ঠিক যেমন খুব পছন্দের হলেও প্রতিদিনের টিফিনে তারা একই খাবার পছন্দ করে। শিশুমন বড্ড বৈচিত্র্যপিয়াসী- বৈচিত্র্য চায় গল্পে, ছড়ায়, কবিতায়, বিষয়ে, ভাবনায়। তারা তো জীবনের ভবিষ্যৎ বোঝেনা। জীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা রাখে না। এ সময় সাহিত্যের আবেদন যদি তাদের কাছাকাছি পৌঁছে দেয়া যায়, তাহলে তারা লেখাপড়ার মতো একটা দায়িত্বকে খেলা হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। নানান গল্প আর ছড়া শুনতে শুনতে, পড়তে পড়তে শিশুরা নানা শব্দ, ছন্দ, বানান ও ভাষা শেখার সাথে সাথে জীবনের টুকরো টুকরো ছবিও আঁকতে শিখে যায়।
‘ছোটদের রামায়ণ’ বা ‘ছোটদের মহাভারত’ পড়ে অবোধ অচেতন বয়সের পাঠক যেভাবে মহাকাব্যের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে, ‘ইশপের গল্প’ বা ‘জাতক কথা’ পাঠ তেমনি অবচেতনে সততা-ন্যায়-শুদ্ধতাবোধের ভিত তৈরি করে, যা পরবর্তী জীবনে প্রতিফলিত হয় নানাভাবে।
গোয়েন্দাগল্প পড়তে ভালোবাসে যে কিশোরী, তাকে দেখি ভূতের গল্পও পড়ছে গভীর মনোযোগে। জঙ্গলের গল্প পড়তে ভালোবাসে যে কিশোর, সে কল্পবিজ্ঞানের গল্প পড়ছে গোগ্রাসে। লেখাটা টানলেই হল। এই পাঠককে টানা, বিশেষত অল্পবয়সী পাঠককে টানা ব্যাপারটায় সাহিত্যিকের অবদান অনেকখানি। এমন লেখা যা তার সারাজীবনের সঙ্গী হবে, আজকের শিশু-কিশোরের আগামীকাল ঋদ্ধ হয়ে থাকবে, শোভন ও সুন্দরের চেতনার বিকাশে মনন সমৃদ্ধ হবে। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সী’ যেমন।
মাঝে মাঝে ভাবি যে ছোটদের জাদুপৃথিবীটা বোধহয় হারিয়ে গেছে। না হারায়নি তো, সময়ের সাথে সাথে কেবল বদলে গেছে সেই পৃথিবীর রূপ। বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠল কি উঠল না, সেটা নিয়ে না ভাবলেও এখন শিশুরা হ্যারী পটারের পৃথিবী চেনে।
আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন। বহু মানুষের রক্ত আর দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের এই লাল-সবুজ পতাকা। এই ত্যাগের ইতিহাস আর আবেগ প্রকাশিত হয় বইয়ের পাতায় ছাপার অক্ষরে। ইতিহাসকে যখন সাহিত্যে তুলে আনা হয়, তা হয় অনেক হৃদয়গ্রাহী ও আবেগমিশ্রিত। তাই আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে মহান মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরার জন্য শিশুসাহিত্য হতে পারে অন্যতম প্রধান মাধ্যম। জাতীয় চেতনার সঙ্গে শিশুদের মানসিকভাবে সংযুক্ত করার জন্য এর বিকল্প নেই। নতুন প্রজন্মকে স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে এবং সমৃদ্ধ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে সাহিত্যের মাধ্যমে সঠিকভাবে জানাতে হবে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। লোকগাথা, রূপকথা যেমন শিশুর মননকে নানাভাবে পুষ্ট করে, সমৃদ্ধ করে তেমনি স্বদেশ চেতনাঋদ্ধ সাহিত্য শিশুর ভেতরে বুনে দেয় দেশপ্রেম এবং আত্মপরিচয়ের বীজমন্ত্র। দেশের জন্য, মানবিক পৃথিবীর জন্য ভালোবাসায়, সৃষ্টিশীলতায় ভরে থাকুক আমাদের শিশু-কিশোরদের সত্ত্বা।