নাফিসা তাসনিম
শৈশবের একটা-দুটো ক্ষুদ্রকায়া স্মৃতি অকারণ রঙীন জায়গা করে থাকে।আমার বয়স তখনও পাঁচ বছর হয়নি। স্কুল যাওয়া শুরু করিনি,ভাই-বোন আর প্রতিবেশি সঙ্গীরা সবাই স্কুলে যায়,আমি খুন্নমনে একা ঘুরে বেড়াই। বাগানে,মাঠে, সামনের পাকা রাস্তাটায়। পুতুলের কাপড় পরাই, হাড়ি-কলসি নাড়া-চাড়া করি। কখনোবা ঘুরি আম্মুর পায়ে পায়ে। মাঝে ব্যস্ততার ফাঁকে মা বলে, ‘কি,ক্ষুধা’? মাথা নাড়ি। ‘নিচে যেতে চাও’? তাও না। ‘দাঁড়াও, রান্না আরেকটু বাকি। এক্ষণি এসে গোসল দিচ্ছি।” এই একটা অসহ্য কাজ কেন যে করতে হয় প্রতিদিন!
গোসল শেষ হলে নরম সূতির জামা পরি আমি।ভেজা চুলে সিঁথি করি অনেকক্ষণ।সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের নদী পার হওয়ার মতন দূরুহ, সময়সাপেক্ষ আর একরোখা সেই সিঁথি কাটা। সিঁথি হওয়া চাই সোজা, নাক বরাবর। এক চুল সরে আসলেই আবার সিঁথি চলে একেবারে গোড়া থেকে। কিছুতে কি কিছু হয়!
মা-এর ডাকে ডাইনিং এ এসে বসি। দ্রুত হাতে প্লেট নামিয়ে খাবার দিয়ে যায়।খুব জানে সে, আজ খাবারে মর্জি হবে না কোণ। সব আমার মনের মত। সামনে তাই হাজিরার দরকার নেই । সাদা ধোঁয়া ওঠা ভাত, একটা মুরগির রান, ঝোল আর আলু, এক টুকরো লেবু। ধোঁয়াটা আমার নাকে লাগে, মাত্র রান্না হওয়া মুরগির ঘ্রাণটাও নাকে লাগে। নাক থেকে মগজে,মগজ থেকে নেমে এসে হৃদয়ে স্থায়ী জায়গা করে নেয়। ঝোলেতে, আলুতে, এলাচি লেবুর ঘ্রাণেতে মাখামাখি আঠালো আঙ্গুলে ছোট ছোট লোকমা মুখে পুরি আমি। মা এসে ঘুরে যায় একবার,নিশ্চিন্ত যে আমি খাচ্ছি। আমি নিশ্চিন্ত যে মা আছে।
কতদিন গেছে এমন, হয়ত গর্ভবতী থাকাকালীন, হঠাৎ করে শৈশব থেকে উঠে আসা সেই সৌরভ আমাকে কাবু করে ফেলে। ছোটাছুটির দুপুর, মেঘলা দ্বিপ্রহর অথবা নেহায়েত লেগে যাওয়া ক্ষুধায় কিছু খাওয়ার ইচ্ছেতে ঐ ছবিটা এসে সামনে দুলতে থাকে-ধোঁয়া ওঠা সফেদ ভাত, একটা মুরগির রান, আলু আর ঝোল, লেবু এক টুকরো। কত কি গেল এল, কতকিছু পেলাম আর খেলাম…স্বাদ বদলের, বৈচিত্রের আর ঐতিহ্যের! তবু ভুলতে পারলাম কই? কি মিশে আছে ওতে? সুখময় শৈশব? সরল উপাখ্যান? মায়ের হাতের রান্না!? কি আমাকে ব্যাকুল করে? কাকে আমি হারাই?