সাবরিনা নিপু, ঢাকা
আজ শুক্রবার, ছুটির দিন। শেষ রাত থেকেই ঝরছে অবিশ্রান্ত মাঝে মাঝে বেশ হাওয়া দিচ্ছে! মর্নিং ওয়াকে বেরুবো কি বেরুবো না ভাবছিলাম। পরে কি ভেবে ঝড়-বৃষ্টির তোয়াক্কা না করে পায়ে স্নিকার্স গলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়। আমার সদর দরজার দু’পাশে গলাগলি করে থাকা কৃষ্ণচূড়ার পাতা থেকে তখনও ঝুপ-ঝপ করে ঝরে পড়ছে জল। তার নিচ দিয়ে হেঁটে যেতে মন্দ লাগছিলো না।
এই মাঝ বয়সে টিনএজের দিনগুলোর কথা ভেবে কিছুটা নষ্টালজিক হয়ে উঠলাম যেনো। হঁাঁতে হঁাঁতে কখন লেকের পাড়ে চলে এসেছি, খেয়াল করিনি! ঝড়-বৃষ্টির দিন বলে এদিকটা আজ বেশ ফাঁকা! হঠাৎ লেকের পাড়ের বেঞ্চির দিকে চোখ পড়তেই, ভারি চমকে উঠলাম। ভুল দেখেছি ভেবে হেঁটে চলে গেলাম। কিন্তু অবাধ্য মন পায়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না চেয়ে ছুটে যেতে চাইছে উল্টে দিকে, সেই মানুষটির কাছে।
মনে পড়ে গেলো ইউনিভার্সিটির প্রথম দিনটির কথা। প্রথম ক্লাস, এক্সাইটমেন্ট ছিলো অন্যরকম। ফার্স্ট পিরিয়ডে যে স্যারের ক্লাস, তাঁকে নিয়ে আগে থেকেই কানাঘুষা চলছিলো। জানা গেলো, সদ্য পাশ করেই জয়েন করেছেন। ইয়াং এন্ড হ্যান্ডসাম, পড়ানও দুর্দান্ত!
স্যার যখন ক্লাসে ঢুকলেন, তখন তাঁর এমন সৌম্য মূর্তি দেখে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিলাম। সাদা শার্ট আর কালো ট্রাউজারে অসম্ভব হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছিল তাঁকে। শার্টের হাতা কনুইয়ের কাছে ফোল্ড করা, ক্লিন্ড শেভ গালে রক্তিম আভা! আমার দীঘল কালো চোখে ছাড়া পড়েছিল এক স্বপ্ন পুরুষের। আমার প্রথম ক্রাশ, ফার্স্ট লাভ।
স্যারের একটা ক্লাসও মিস করতে চাইতাম না কখনও, ইনফ্যাক্ট করিওনি কখনও কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো কোর্স ফাইনালের সময়। হঠাৎ করে জ্বরে পড়লাম! পড়লাম তো পড়লাম, সেই জ্বর টাইফয়েডে দিয়ে ঠেকলো। মাঝখান থেেেক একটা ইনকোর্স এক্সাম মিস হয়ে গেলো! একটু সেরে উঠতেই ডিপার্টমেন্ট অফিসে খোঁজ নিতে গেলাম এক্সামটা আদৌ দেয়া সম্ভব কিনা; দোতলায় ওঠার মুখেই মুখোমুখি হলাম স্যারের। যে আমার প্রথম ক্রাশ! দেখা হতেই বললেন- কেমন আছো নন্দিনী? পুরোপুরি সেরে উঠেছোতো? তোমাকে বেশ দুর্বল দেখাচ্ছে!
তার এমন আন্তরিক অভিব্যক্তি পুরোপুরি দখল করে নিলো আমাকে। আমি ওই মুহূর্তে তার প্রেমে পড়ে গেলাম আবারও।
পাঁচদিন পর এক্সাম দিতে গেলাম থিয়েটারের চার তলায়, স্যারের রুমে। সেইদিন ও আকাশের মাথার করিডোরটা ছেয়ে ছিলো কালো বজ্র-বিদ্যুৎ ভরা মেঘে! শরীরটা যুতে ছিলনা, মনটাও কি বশে ছিলো আমার? এই প্রথম স্যারের রুমে ঢুকতে যাচ্ছি একা। সম্পূর্ণ একা! বুকের ভেতর কেমন একটা মিশ্র অনুভূতি কাজ করছিলো তখন। এই অনুভূতি ব্যাখ্যা করা খুব কঠিন।
স্যার যখন প্রশ্ন বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, তখন তাঁর নিঃশ্বাস এসে লাগলো আমার গালে, চোখের পাতায়।
বুঁজে এলো আমার অপাপবিধ্ব আঁখি পল্লব
দু’টি। জংলী ফুলের গন্ধ ভেসে আসছিল তার শরীর থেকে। আর সেই গন্ধে কেঁপে উঠছিলো আমার শরীর!
সেইদিন কি লিখেছিলাম, কতটুকু লিখেছিলাম, আজ আর মনে নেই। এক্সাম শেষে বেরিয়ে যাবার মুহূর্তে স্যারের ডাক শুনে থমকে দাঁড়ালাম। মনে মনে বললাম, এমন একটি দিনের প্রত্যাশায় ছিলাম এতোগুলো দিন! মনে হলো, বিন্দু বিন্দু ভালো লাগা যা এতোদিন চুইয়ে চুইয়ে জমা হয়েছে বুকের ভেতর, তা আজ প্রকাশ করার সময় এসেছে! কিছু বলার আগেই একটি কার্ড এগিয়ে দিলেন। বললেন-আগামী রোববার আমার বিয়ে! এরপর আরো কি কি বলছিলেন, কিন্তু ঐই মুহূর্তে আর কোনো কথা শোনার মতো মানসিক অবস্থা আমার ছিলনা!
কার্ডটা হাতে নিয়ে এক মুহূর্ত দাঁড়াইনি ওখানে। প্রচ- এক অভিমান গ্রাস করেছিলো যেনো। সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছিলাম যখন, তখনও আকাশ কালো করে ঝরছে তুমুল বৃষ্টি! এই আধো আলো-আধো অন্ধকার আবহে কেমন যেনো গুলিয়ে যাচ্ছিলো বহুদিনের চেনা সমীকরণগুলো।
এরপর ব্যারিস্টারি পড়তে চলে দিয়েছিলাম লন্ডনে। ওখানেই বিয়ে-থা সংসার। তবু, এক মুহূর্তের জন্য ও বিস্মৃত হইনি তাকে। ক্যালেন্ডারের বয়স বাড়লেও আমার প্রেম এখনো আনকোরাই রয়ে গেছে যেনো!
আজ কুড়ি বছর পর আবার সেই মানুষটির সাথে দেখা! যাকে এক সময় প্রচ- ভালবেসেছিলাম। তাকে উপেক্ষা করে চলে যেতে পারলাম না। ধীর পায়ে যেয়ে পাশে বসতে গেলাম যেই, উনি চমকে সরে বসতে চাইলেন। চেখে চোখ পড়তেই মুখে সেই পরিচিত হাাসির রেখা টেনে বলেলেন,
- ও মাই গড! নন্দিনী! কতো বছর পর দেখা! কেমন আছো বলো?
- বেশ আছি ! তবে আপনি এই ভোর বেলা বৃষ্টি মাথায় নিয়ে একা একা লেকের পাড়ে বসে আছেন কেন?
- প্রায়ই এসে এখানে বসি আমি। পাওয়া না পাওয়ার হিসেবগুলো ঝালিয়ে নিই!
- দেখো গাছের পাতাগুলো থেকে টুপ টুপ করে জল পড়ছে লেকের বুকে। বৃষ্টির ফোটারা মুহূর্তের জন্য কতনা ছবি আঁকছে আর মুছে দিচ্ছে।
- মাঝে মাঝে এমন একেকটা ঘটনা ঘটে যায় আমাদের জীবনে! হয়তো খুব তুচ্ছ, তবুুও তার রেশ টেনে জীবনটা যেনো অন্য খাতে বাঁক নেয়! বদলে যায় জীবন! একজন ব্যক্তির ভাগ্যরেখা।
- তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা! সচেতনভাবে না হলেও, মনের গভীরে অবচেতনে কোথাও তোমার ব্যক্তি পূজার মালা সংরক্ষিত হয়ে আছে আজও! সেদিন বুঝিনি, ভেবেছিলাম ভালবাস ঠিক গড়ে ওঠেনি! একটু মুগ্ধতা শুধু, একটু রঙ্গিন হিল্লোল ভেবেছিলাম, অল্প বয়সে সবারই হয় এমন। মৃদু হেসে বললাম, অ্যাভারেজ লাইফ, অ্যাভারেজ কনসেপশান!
- সেদিন তুমি যখন আমার সামনে বসে পরীক্ষার খাতায় লিখছিলে, তখন তোমাকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিলো আমার! কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গিয়েছিলাম আমাদের সম্পর্ক ! ওই মুহূর্তে, তোমার হাতদুটো দেখে মনে হয়েছিলো এগুলো নিশ্চয়ই মোম দিয়ে বানানো। আর তাতে মধু বার্নিশ করা হয়েছে! একবার যদি ওখানে টোাঁ ছোঁয়াই, তাহলে সারা মুখ গলা এমনকি হৃৎপি- পর্যন্ত মিষ্টি হয়ে যাবে। অথচ এসব কিছুই বলা হয়নি সেদিন।
মুহূর্তেরও ভগ্নাংশ সময়ে শুধুমাত্র একটি চাহনি দিয়ে যতখানি কৃতজ্ঞতা ঢেলে দেয়া সম্ভব, তাই যেনো উজাড় করে দিতে চাইল এ মন! বললাম, আপনাকে এক সময় প্রচ- ভালবেসে ফেলেছিলাম। অস্বীকার করবোনা! তবে ধীরে ধীরে মনই আমাকে যুক্তি যুদ্ধ করে বুঝিয়ে দিয়েছে ওটা ভালবাসা নয়, ইনফ্যাচুয়েশান!
এ কথার পর তাঁকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ছুটির দিন, বাড়িতে কাজ পড়ে আছে প্রচুর এ অজুহাত দেখিয়ে উঠে পড়লাম!
অনেক অনেক দিন মাস বছর ধরে যে পাথরটা বুকের ওপর চেপে বসেছিলো তা যেনো আজ মুহূর্তেই নেমে গেলো! আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, বৃষ্টি ঝরা শেষে মেঘগুলো উড়ে যাচ্ছে কোন সুদূরে, ওই মেঘের সাথেই উড়তে উড়তে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের ব্যক্তিগত সুখগুলো।
পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম, স্যার একদৃষ্টে আমার চলে যাওয়া দেখছেন। চোখে চোখ পড়তেই মৃদু হেসে হাত নাড়ালেন, আমি হাত নাড়ালাম ঠিকই, অথচ চোখের জল উপচে যাবে উপচে যাবে ভাব। তাই চোখ সরিয়ে নিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ালাম।