ফারহানা পল্লব
শরিফ আব্দুসালাম, ফেসবুক নাম দেখলাম সালাম শরিফ। করোনার ভয়াল থাবায় আজ তিনি হারিয়ে গেছেন না ফেরার দেশে।ঘর বন্দী অবস্থায় শুনেছিলাম সালাম ভাই অসুস্থ, তারপর ভুল পোস্ট দেখেছিলাম উনার মৃত্যু খবরের। খুশি হলাম শুনে তিনি সঙ্কামুক্ত আছেন। তারপর হঠাৎ চলে যাওয়া। পুরা বাঙালী কমিউনিটি ভারাক্রান্ত হয়েছিলো ক’টা দিন।
সালাম ভাইর সাথে আমার খুব কাছে থেকে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিলো। সে স্মৃতির গল্প বলি। ২০০২ তে আমাদের সংগঠন অন্টারিও বাঙালি কালচারাল সোসাইটির শুরু। সেই থেকে বেশ বড় মাপের সংস্কৃতিক অনুশ্ঠান করে বাঙালীদের মন জয় করে চলি প্রতি বছর। ২০০৫ এর দিকে সালাম ভাই ড্যানফোর্থ এলাকায় পথের উপরেই আমাকে ডাকেন- ‘ফারহানা’ খুব শ্নেহ সুলভ অধিকার ছিলো সে ডাকে। সবসময়েই শত ভীরের মধ্যেও আমি চিনতাম সে ডাক।আমি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস ‘করি জ্বী ভাই? ‘ সালাম ভাই: তোমাদের সংগঠন কি রেজিস্ট্রেশন করা আছে?আমি বল্লাম: জ্বী ভাই, আছে।সালাম ভাই: ঠিক আছে কথা আছে তোমার সাথে, একদিন বসতে হবে।আমি বল্লাম: ঠিক আছে ভাই , আমার ফোন নম্বর আছে তো? আমাকে জানাবেন কবে কোথায় বসতে হবে।সেই থেকে আমাদের কাজের সুত্রপাত।
এর পরে একদিন ফোন করে ডাকলেন সুইস বেকারীতে, আমি সেখানে তার থেকে যা শুনলাম তা অত্যন্ত আশার কথা, আমাদের সংগঠন তথা পুরা বাঙালি কমিউনিটির জন্য। বিষয়টা ছিলো, প্রভিন্সিয়াল ফান্ড আছে যা বাঙালীর একটি কমিউনিটি সেন্টার গড়ার জন্য আবেদন করা যায়। এ আবেদনে সক্রিয় সহযোগীতা করবেন তৎকালিন এম পি। আমি অবাক হলাম কত কত অন্য বাঙালী সংগঠন আছে কমিউনিটিতে, হঠাৎ ওবিসিএস কেনো?তখন তিনি জানালেন যে আমাদের কাছেই প্রথম প্রস্তাবনা আসেনি। আরো অনেকগুলো সংগঠনের কাছে প্রস্তাব করে দেখেছেন কিন্তু শর্ত মিলানো যায়নি তাদের কাগজপত্রের সীমাবদ্ধতার জন্য। তখন আমরা কাগজ পত্র সব জমা দিয়ে গেলাম। অনেক শর্ত পূরণের কয়েকমাস জুড়ে আমাদের সংগঠনের সাথে যত রকম সমস্যার মুখোমুখী হতে হয়, সমাধানের কাজ করতেন সালাম ভাই।
তিনি জানতেন ফারহানাকে ( আমাকে) কিভাবে রাজী করানো যায়। আমার কাকার বন্ধু তিনি, মা’কে খুব সম্মান করতেন। তার উপরেও ভালোবাসার এক মায়ার বন্ধনে জড়িয়ে ফেলেছিলেন আমাদের। আমি তার কথা ফেলতে পারতাম না। দিনের পর দিন মিটিং এর পর মিটিং আর কমিউনিটি সেন্টার গড়তে সালাম ভাই আমাদের সাথে ছিলেন। এসনয় তিনি বাঙালী কালচারাল সেসাইটির বোর্ডে যেগদান করেন।সে কাজের সময়গুলোতে খুব কাছ থেকে এমপির সাথে কাজ করতে হয়েছে, কথায় কথায় ঠুকাঠুকি লেগে যেত মতের অমিল হলেই, সংগঠনের তথা বাঙালী কমিউনিটির স্বার্থে আঘাত লাগলেই আমি বেঁকে বসতাম। সালাম ভাই মধ্যস্ততা করে সমস্যা মেটাতেন। আমাকে শাসন করা থেকে আদর দিয়ে বুঝিয়ে সমস্যা সমাধান করতেন। ভিতর ভিতরে খুব নরম একটা মানুষ দেখতাম।
দেশের জন্য যে মায়া আর কমিউনিটির অন্ত:প্রান মানুষটি খুব আবেগ প্রবনও ছিলেন। আমি রাগ করে কথা বন্ধ করে দিতাম। তিনি আরিফের সাথে, মায়ের সাথে কথা বলে আবার আমাকে মানিয়ে ফেলতেন।আমার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর, সালাম ভাইয়ের গোপালগন্জ। সেদিক থেকে পরম আত্মীয়ের মত দেশী টানে কথা বলতেন, একটু দ্রুত। যারা সালাম ভাইকে চেনেন তাঁর দেশপ্রেম আর বাংগালীর প্রতি মায়ার সাথে পরিচিত। আমি এক বান্ধবী পেয়েছিলাম সে এখন দেশে থাকে। তার খুব বিপদে বাসা থেকে যখন বাইরে, আমি এক শীতের সন্ধায় তার সমস্যা শুনছিলাম, সে তখন কোথায় উঠেছে বাসা ছেড়ে জিজ্ঞেস করাতে উত্তর দিয়েছিলো শরিফ সালাম ভাইর বাসায় আছি। শ্রদ্ধায় মনটা ভরে উঠেছিলো সেদিন। এভাবে নিরবে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর নজির খুব বেশী নেই এ সমাজে। আমাদের ডামাডোল এত বেশী যে সালাম ভাইদের মত মানুষের অবদান না বলাই থেকে যায়। এরকম আরো অনেক কাজ সালাম ভাই নিরবে করে গেছেন।
আমাদের সংগঠনের অনুশ্ঠানে যখনি সাহায্য চেয়েছি স্পন্সর করে দিতেন ৫০$/ ১০০ $ যা হয়। কখনো মানা করতেন না। জানি তিনি সকলকেই সহযোগিতা করতেন। মুক্তিযোদ্ধার মনে দেশপ্রেমটা অন্য মাত্রায় বয়ে যায়। আমার কাকাদের দেখেছি, আর প্রবাসে অনেক মুক্তিযোদ্ধার সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়েছে। তাঁদের দেশপ্রেমের সাথে অনেক আশা, হতাশা থাকে-কোন স্বার্থ নয়। বরং কি দেশ চেয়েছিলাম কি দেশ পেলাম, নিজেদের আত্মত্যাগ থেকে হতাশা আসাটাও অস্বভাবিক নয়। সালাম ভাই একজন মুক্তিযোদ্ধা যাঁর মাঝে হতাশা দেখিনি। আইনের (law)পেশাগত কারনে তাঁকে কোর্টে যেতে হত প্রতিদিন তাই পোশাক পরিহিত থাকতেন , স্যুট বুট যাকে বলে। লম্বা চওড়া সুঠাম গড়নের সাথে ফর্সা অত্যন্ত সুশ্রী চেহারার এ যোদ্ধা হেরে যেতে শেখেন নি। এদেশে সংগ্রামের পাশাপাশি নিজে ল’এর লাইসেন্সিং করেছিলেন।
সালাম ভাইয়ের অবদানেই আজ আমার স্বপ্ন- বাঙালীর একমাত্র কমিউনিটি সেন্টার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ড্যানফোর্থ এ্যভেনিউর উপরে। যাদের পদচারনায় আজ বাংলাদেশ সেন্টার মুখরিত, তারা অনেকেই জানেন না সালাম ভাইর অবদান। বাংলাদেশ সেন্টার কতৃপক্ষের উচিত সালাম ভাইর একটি বড় পোর্ট্রেট দেয়ালে টানিয়ে বর্তমান এ আগামী প্রজন্মের কাছে এই প্রতিশ্ঠাতা সংগঠকের নামটি সসম্মানে অমর করে রাখা।সালাম ভাই কমিউনিটি সেন্টার প্রতিস্ঠানের সময় আমার দিন রাত পরিশ্রম দেখে বলেছিলেন- ‘ফারহানা, তুমি তো বিখ্যাত হয়ে যাবা এই কাজের জন্য’আমি বলেছিলাম ‘সে আশা করিনা সালাম ভাই, বাঙালীর প্রথম কমিউনিটি সেন্টার হবে সেটাই একমাত্র স্বপ্ন।’ আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছিলো সালাম ভাইর হাত ধরে, এর চাইতে বড় পাওয়া একজীবনে আর কি চাই? এরকম মানুষ আর হবে না, চোখ ভরে আসে শুধু। আপনি যেখানেই থাকেন আমার সেল্যুট, আমি কাজ করে যাচ্ছি সালাম ভাই, বিখ্যাত হইনি- তবে যা চেয়েছি জীবনে সব অর্জন করতে পারছি, আপনাদের মত যেন বড় মানুষ হতে পারি।
আমি সামান্য কাজ করার সুযোগ পেয়েছি ছালাম ভাই এর সাথে। আমি আছি ফরিদপুর এসোসিয়েশন এর সাথে । সেখানে মিটিং এ পিক নিকে ভাইকে পেয়েছি। ভালো লেগেছে কথা বলে।
অনেক সুন্দর লিখেছেন পল্লব।অনেক জানতে পারলাম ছালাম ভাই সম্পর্কে । আসলে তার মতো মানুষ থাকবেন আমাদের সবার অন্তরে । আপনার প্রস্তাবের সাথে আমি সহমত পোষণ করছি।
Thank you so much. Stay blessed.
সালাম ভাইকে আমি চিনি না, কোনদিন দেখিও নি।কিন্তু তোমার লেখাটা পড়ে ওনার প্রতি শ্রদ্ধায় মন ভরে গেলো।খুব সাবলীল আর স্বচ্ছন্দ লেখা যা হৃদয়ে নাড়া দিয়ে যায়। এই নীরব অজানা যোদ্ধার প্রতি শ্রদ্ধা ও তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি।
Thank you so much.stay blessed.
বাংলাদেশ কম্যুনিটি সেন্টার এর জন্ম , চরাই উৎরাই দেখেছি এবং সালাম ভাইয়ের অবদান কারো অজানা নয় সেই সাথে ফারহানা পল্লব এর অক্লান্ত পরিশ্রম ও দেশের প্রতি ভালোবাসা আমাদের সবার জানা I
রাহুর করাল থাবা ও দেখছি ! যাক স্বপ্ন পূরণ তো হয়েছে ! প্রতিষ্ঠাতা সংঘটকের ছবি ও নাম অবশ্যই রাখা উচিত নাহলে তো আগামী প্রজন্ম ও বর্তমান কে মুছে দিবে অনায়াসে !
Thank you for your comment.i agree with you.stay blessed.