সাবরিনা নিপু: মাইন্ড ইয়োর ল্যাঙ্গুয়েজ। কি ভেবেছিলে? যখন যা খুশি বলার এবং করার অধিকার কি তোমার একারই আছে?
- হাউ ডেয়ার ইউ আমার গালে চড় মারার মতো ধৃষ্টতা হয় কি করে তোর?
- কিভাবে হয়েছে দেখতে পাওনি?
তখন বাবা মায়ের দুই জোড়া বিস্ফারিত চোখ অবাক বিস্ময়ে আমাকে দেখছে আমি জানি। কোনোদিন আমি এতো জোরে কথা বলাতো দূর, কারো কথার প্রতিবাদ পর্যন্ত করিনি। এসব আমার কাছে খুব ইনডিসেন্ট মনে হতো। অথচ এই কাজটাই আমি আজ কিভাবে করছি তাঁরা হয়তো তাই ভাবছেন। কিন্তু নারীদের এই ভালো মানুষির সুযোগ গুলোই পুরুষরা নেয়। তাদের সাথে ডিসেন্ট ওয়েতে কথা বললে ভেবে নেয় মেয়েটা খুব দূর্বল। এই একটা চড় যে আমাকে কতোখানি কনফিডেন্স দিয়েছে এটা বলে বোঝানো যাবে না।এদিকে ফোনের ওপাশ থেকে আবার হিস হিসে গলা শোনা গেলো …
- আমি কি করতে পারি সে সম্পর্কে তোর কোনো ধারনাই নেই।
- ওহ! তাই নাকি? তা কি করতে চাও তুমি?
- কি করবো দেখতে চাস? জাস্ট ওয়েট অ্যান্ড সি।
- স্যারি ওয়েট করায় মতো এতো সময় আমার নেই। এ কথা বলেই ফোনটা কেটে দিলাম। বাবার হাতে ফোনটা দিয়ে বললাম। ওদের বাসার সবার নাম্বার ব্লক করে দাও বাবা। ওদের কোনো ফোন রিসিভ করবে না। আজকে বিকালে তামান্নার বাসায় যাবো আমি। আমার এই বন্ধু জজ কোর্টে প্র্যাকটিস করে। মামলা কিভাবে সাজাতে হবে ওই সব বলে দেবে।
- কিসের মামলা?
- নারী নির্যাতনের মামলা করবো আমি নাফিসের বিরুদ্ধে।
-সত্যিই বলছিস? তোকেতো আগেই বলেছিলাম মামলা কর, তুইতো রাজী হলি না।
-হ্যাঁ বাবা এতোদিন তোমার সম্মানের কথা ভেবে চুপ করেছিলাম। তাছাড়া নাফিস একটা গভর্নমেন্ট জব করে। এ কারণেও মামলা করতে চাইনি ওর জব টা চলে যেতে পারে। শুভ্র যখন বড় হয়ে জানবে ওর বাবা আমার জন্য জবলেস হয়েছে। ও কি ভাববে আমাকে বলো? বাচ্চাটার কথা ভেবেই ডিভোর্স ফাইল করিনি এখনো। কিন্তু আমি বেশ বুঝতে পারছি নাফিস আমাকে শান্তিতে থাকতে দেবে না।
দেখলাম, বাবা মাথা নিচু করে বসে আছেন। বাবার পাশে যেয়ে বসলাম। একটা হাত বাবার হাতের ওপর রেখে বললাম,- আই অ্যাম স্যরি বাবা। আমিতো কখনও এভাবে কথা বলি না তুমি জানো। কিন্তু নাফিসের কাছে নিজেকে আর দুর্বল করতে চাই না।
- তুমি কেন স্যরি বলছো মা। ভুল আমিই করেছি। তোমার মাও আমাকে অনেকবার নিষেধ করেছে। এখানে বিয়ে হোক তোমার মায়ের পছন্দ ছিলো না। তবুও আমার অনুরোধেই মত দিয়েছে।
ভুল আমি করেছি। আমি অন্ধের মতো আমার বন্ধু মোর্শেদকে বিশ্বাস করেছি। ওর নজর ছিল আমার টাকার দিকে সেটা কোনোভাবেই বুঝতে দেয়নি কখনও। তাছাড়া নিজে সারাজীবন ব্যবসা করেছি। বাড়িতে সময় দিতে পারিনি। তুমি আমাদের একমাত্র মেয়ে। আমার যা কিছু আছে একসময় এর মালিকও ভবিষ্যতে তুমিই হবে। তাই ভেবেছি তোমার বিয়ে সরকারী চাকরিজীবীর সাথে হলে জীবনটা গোছানো হবে। হিসেবী জীবন কেমন সে সম্পর্কে একটা বাস্তব অভিজ্ঞতা হবে তোমার। তাছাড়া নাফিসকে সব সময় ভালো ছেলে বলেই জানতাম। কিন্তু ওরা আমার সাথে এভাবে প্রতারণা করবে ভাবিনি।
- তুমি এসব ভেবে একদমই কষ্ট পেওনা বাবা। আমার এই নরম স্বভাবই আমার কাল হয়েছে। আরো আগেই যদি প্রতিবাদ করতাম, ওদের সব কথায় অ্যাগ্রি না করতাম, আমার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতাম, তাহলে এতোটা অ্যাবিউসিভ আচরণ ওরা করতে পারতো না।
যাকগে , এসব বাদ দাও। বাবা আমি ভাবছি স্কুল, কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে জবের জন্য অ্যাপ্লাই করবো। ওখানে সিঙ্গেল মাদার বা ছোট বাচ্চার ব্যাপারটা খুব সমস্যা হবে বলে মনে হয় না।
মা শুভ্রকে কোলে নিয়ে খাওয়াচ্ছিলেন। আমার চাকরির কথা শুনে একবাক্যে মানা করে দিলেন
- নাফিসের মতিগতির কোনো ঠিক নেই। ও যে কোনো ভাবে হোক তোর ক্ষতি করার চেষ্টা করবেই। আমি তোকে কোথাও চাকরি করতে দেবো না।
- কিন্তু মা আমি ওর ভয়ে যদি বাসায় বসে থাকি, তাহলে ও ভাববে আমি ওর ভয়ে গুটিয়ে গিয়েছি। আমার যে কোনো দুর্বলতাই ওকে আনন্দ দেবে। ও সরকারী চাকরি করে কোনোভাবে যদি ওর ব্যাপারে অফিস এসব জানতে পারে ওর পক্ষে চাকরি বাঁচানো মুশকিল হবে । ও আমার সাথে খারাপ কিছু করার সুযোগ পাবে না। তুমি আমাকে নিয়ে এতো চিন্তা করো না। কোনোভাবেই আমাকে দুর্বল করে দিও না তোমরা। এ কথা বলে শুভ্রকে মার কোল থেকে নিয়ে বেড রুমে চলে আসলাম।
ফোনটা চার্জে রেখে ব্রেকফাস্ট টেবিলে গিয়েছিলাম। এসে দেখি ৪টা মিসড কল তামান্নার। ওকে কাল রাতে ওর সিনিয়রের সাথে কথা বলতে বলেছিলাম আমার ব্যপারটা নিয়ে। নিশ্চই ওই ব্যাপারেই কিছু বলতে চেয়েছে। শুভ্রকে পায়ের ওপর নিয়ে দোল দিয়ে দিয়ে ঘুম পাড়ালাম। এবার বিছানা থেকে দূরে যেয়ে সোফায় বসলাম কল ব্যাক করার জন্য। ছেলেটার ঘুম এতো পাতলা একটু সামান্য আওয়াজেই ঘুম ভেঙে যায়।
একটা রিং বাজতেই কলটা ধরলো তামান্না।
বললাম – স্যরি ফোনটা চার্জে রেখেই ব্রেকফাস্ট টেবিলে গিয়েছিলাম। আর সে সময়ই আমার শ্বশুর ফোন দিয়েছেন বাবাকে। বাবা ফোনটা দিলেন আমাকে। আমি আজ খুব কনফিডেন্টলি কথা বলছিলাম শ্বশুরের সাথে ওদিক থেকে বাপের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে গালিগালাজ শুরু করে । আমিও আজ ছেড়ে কথা বলিনি। বেড রুমে এসে দেখি তোমার মিসড কল। এখন বলো ।
- ইটস ওকে লুবনা! ডোন্ট ওয়ারি । আমি আমার সিনিয়রের সঙ্গে কথা বলেছি। তোমার সব কথা তাকে খুলে বলেছি। তিনি সব শুনে বললেন তুমি অবশ্যই ওর বিরুদ্ধে মামলা করতে পারবে। ডিভোর্সতো ফাইল করবেই। তার আগে নারী নির্যাতন এর মামলা অবশ্যই করতে পারবে।
- তামান্না আমার আসলে এসব আইন আদালতের ব্যাপারে কোনো ধারনাই নেই। তবে আমি চাই না কারো ওপর অন্যায় হোক। নাফিস বা ওর পরিবার আমাদের ভালো মানুষির সুযোগ নিয়ে যে প্রতারণা করেছে এবং যে মানসিক যন্ত্রণা আর হুমকি ধামকি দিচ্ছে এই ব্যপারে কিছু কি করা যায়?
- অবশ্যই করা যাবে। মানসিক নির্যাতনের ধরনটা ব্যক্তিভেদে নানা ধরনের হয়। কটুক্তি, টিটকারী, হেয় প্রতিপন্ন করা, খবরদারি মূলক আচরণ, ব্যক্তি স্বাধীনতা হস্তক্ষেপ, পৌরুষত্ব দেখাতে বিকৃত আচরণ, ঘরের বাইরে কাজ না করতে দিয়ে স্ত্রীকে অকর্মন্য প্রমাণ করা, সন্দেহপ্রবনতা ইত্যাদি বিষয় মানসিকভাবে নারীকে বিপর্যস্ত করে। পারিপার্শ্বিক কারনে নারী নিজের অবস্থান থেকে এ ধরনের মানসিক নির্যাতনকে সহ্য করে মানসিকভাবে নিজে সবল নয় বলে। তবে মানসিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে যে আইনি প্রতিকার রয়েছে তা অনেকে জানে না। পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইনে এ বিষয়ে মামলা করা যায়। যদিও আমাদের দেশে এর পার্সেন্টেজ খুবই নগণ্য। তবে তোমার মতো শিক্ষিত মেয়ের অনেক আগেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ ছিলো।
- এটা ঠিক বলেছো। এটা অবশ্যই আমার দোষ। পরিবার ও সমাজের কথা ভেবে পাঁচটা বছর নষ্ট করেছি। তবে বাচ্চাটার দিকে তাকালে বুকটা ভেঙে যায়। একটা বাচ্চার জন্য কতো কথা শুনেছি। বাঁজা বলে কতো অপবাদ দিয়েছে শ্বশুর বাড়ির লোকজন। পরে যখন ইন্ডিয়ায় ট্রিটমেন্ট করতে যেয়ে যখন জানা গেলো নাফিসের অ্যাডিকশানের কারণে এই প্রবলেম সেদিন সবার মুখ বন্ধ হলো। কিন্তু শুভ্রকে ওর বাবা বা দাদী একটা দিনের জন্যও ভাল করে কোলে নেয়নি। বাচ্চাটার দিকে তাকায় না পর্যন্ত। নাফিসের বাবা আদর করেন অবশ্য। হয়তো ভাবেন, একমাত্র বংশের বাতি..
- এরা এমনই হয়, এমন কতো কেস দেখলাম। নাতি নাতনিদের খাবার খেতে দেয়না ঠিক মতো। ফ্রিজে তালা দিয়ে রাখে কতো দাদী এমনও আছে। কতো শ্বশুর এমনও আছে যারা ছেলের বউকে অ্যাবিউজ করে।
- ছেলের সমস্ত বদ কাজে এসব বাবা মায়েরা সাপোর্ট করে করেই ছেলেদের সংসার নষ্ট করছে। আমি ওই বাড়িতে থেকেও টের পাইনি নাফিসের খালাতো বোনের সাথে ওর একটা সম্পর্ক আছে। ইভেন আমি যখন বাবার বাসায় ছিলাম ওরা তখন আমার বেড রূমে থাকতো একসাথে। আমার বাবার দেয়া গাড়িতে ওই মেয়েকে নিয়ে যখন তখন লং ড্রাইভে অথবা আউট অফ স্টেশন চলে যেতো অথচ আমি এর কিছুই জানতামনা।
- বলো কি ? তোমার হাসব্যান্ড এর এই গুনও আছে তাতো বলোনি। তুমিতো বলেছো তোমার সাথে ফিজিক্যাল রিলেশনে তেমন স্বচ্ছন্দ বোধ করতো না। তখনই আমার মাথায় এসেছিলো নিশ্চই অন্য কোনো রিলেশানে আছে। কিন্তু একথা জানতে চাইলে তুমি আবার আফেন্ডেড হও কিনা এজন্য জিজ্ঞেস করিনি।
- কি যে বলো ? তুমি আমার ল ইয়ার। তোমার কাছে লুকোনোর কিছু নেই। ডাক্তার এবং উকিলের কাছে কিছু লুকাতে নেই বাবা বলেন সব সময়… এ কথা শুনে
ফোনের ওই প্রান্তে হাহা করে হেসে উঠলো তামান্না।
এদিকে ফোনে একটা কল ঢুকলো বলে মনে হলো লুবনার। কান থেকে ফোনটা নামিয়ে স্ক্রিনে দেখলো নাফিস কলিং…
চলবে