সাবরিনা নিপুঃ
দেখতে দেখতে এক্সিবিশনের দিন ঘনিয়ে আসছে। বেশ কিছু নতুন ড্রেস ডিজাইন করেছেন ম্যাডাম। সাহস করে নন্দিনী নিজেও তিন চারটা ড্রেসের ডিজাইন করেছে। ম্যাডাম অবশ্য মুখে তেমন কিছু না বললেও ডিজাইনগুলো একেবারে অপছন্দ করেননি তা বুঝতে পেরেছে নন্দিনী। গতকাল ম্যাডাম ওকে একটা খাম ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ উদ্বোধনের দিন পড়ার জন্য একটা শাড়ী কিনে নিও নন্দিনী। তোমার পছন্দ মতো কয়েকটা ড্রেস নিয়ে যাও । ওখানে ভালো কাপড় পড়তে হবে । এইযে এতো বড় একটা এক্সিবিশনে আমরা যেতে পারছি তার ক্রেডিট কিন্তু তোমারও কম নয়। তুমি এ কয়দিনেই আমার বুটিকটাকে এতো আপন করে নিয়েছো। এতো যত্ন করে দেখাশোনা করছো আবার কিছু কাপড়ের ডিজাইন করে দিয়েছো তুমি আরেকটু লেখা পড়া করতে পারলে ভালো একটা ক্যারিয়ার হতো তোমার।
নন্দিনী তার পারিবারিক পরিচয় কখনও দেয়না ম্যাডামকে। উনি রাশেদকে একবারই দেখেছেন , কিন্তু খুব একটা খুশি হতে পারেননি। বরং নন্দিনীর মতো একটা মেয়ে এই ছেলের পাল্লায় পড়ে কেন জীবন নষ্ট করছে এটাই তাঁর বিস্ময়।
যাই হোক, এই এক্সিবিশনটা ভালোভাবে শেষ করতে পারলে আগামী মাস থেকে তোমার স্যালারিও কিছুটা বাড়িয়ে দেবো ভাবছি।’
শুনে নন্দিনীর চোখে পানি এসে গেলো। ম্যাডাম ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তুমি আরো অনেক বেশি ডিজার্ভ করো।
সেদিন একটু আগেই বুটিক বন্ধ করে দিয়ে ম্যাডাম ওকে ছুটি দিয়ে দিলেন। পুরো এক বছর পর আজ শপিং এ যাচ্ছে নন্দিনী। বাড়ি থেকে ও যে কাপড় চোপড় নিয়ে এসেছিলো সেগুলো উল্টে পাল্টে পড়েছে এতোদিন। বিয়ের আগে রাশেদ বিভিন্ন শপিং সেন্টারে নিয়ে গেছে, কখনও টুকটাক কিছু কিনেও দিয়েছে। তখন বরং নন্দিনীই পছন্দ করে কিনে দিতো রাশেদের পোশাক আশাক। তারপর বিভিন্ন কফি শপে বসে থেকেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আজকাল সেসব স্বপ্ন মনে হয় নন্দিনীর।
অনেক দিন পর আজ চেনা শপিং সেন্টারে ঢুকতে কেমন আড়ষ্ট লাগছে। মনে হয় ওই ফুটপাথের দোকান গুলোই যেন ওর কাছে অনেক বেশী কমফোর্টেবল মনে হয় আজকাল। তবু পায়ে পায়ে ভেতরে ঢুকে এলো নন্দিনী। একটা নস্টালজিক ফিলিং ঘিরে ধরলো ওকে।
ব্র্যান্ডেড শাড়ির দোকানে ঢুকতে যেয়েও প্রথমে একটা জেন্টস কাউন্টারে ঢুকে রাশেদের জন্য একটা টি শার্ট কিনে নিলো। বড় শাড়ির দোকানে না ঢুকে একটা ছোট তাঁতের শাড়ির দোকানে ঢুকে বেবী পিংক কালারের একটা তাঁতের শাড়ি কিনে নিলো ঝটপট । পাশের কসমেটিকসের দোকানটায় আগে কলেজ ফেরার পথে কতো যে ঢুঁ দিতো। মালিক একটু বয়স্ক ছিলেন, প্রতিটা জিনিস খুলে খুলে দেখাতেন ধৈর্য্য নিয়ে। আজও উনি বসে আছেন কাউন্টারে। দেখে ভালো লাগলো নন্দিনীর। কাছে যেতেই বললেন .. মামনি অনেক দিন পরে আসলেন। এদিকে আসেননা বুঝি? নন্দিনীর চোখ পানিতে ভরে উঠলো। কতোদিন পর এমন মমতা জড়ানো কন্ঠে কেউ ওকে মামনি বলে ডাকলো । বললো, ঠিকই ধরেছেন চাচা অনেকদিন আসা হয়না। এর পর আর কথা বাড়ায়না নন্দিনী। একটা আই লাইনার আর একটা পিঙ্ক ম্যাট লিপস্টিক কিনে বেরিয়ে এলো দোকান থেকে।
ঠিক সে মূহূর্তে পেছন থেকে নন্দিনী বলে ওর হাত ধরে টান দিলো কেউ। পেছনে ঘুরে দেখলো ওর কলেজ ফ্রেন্ড রত্না দাঁড়িয়ে আছে ওর ঘাড়ের কাছে। ঘাড় ঘোরানোর সাথে সাথেই ওকে চেপে ধরে টেনে হিচড়ে কর্নারের সেই পরিচিত কফি শপটাতে নিয়ে এলো রত্না। যেখানে বন্ধুদের সাথে একসময় ঘণ্টার পর ঘন্টা কাটিয়েছে নন্দিনী। রত্না ঢুকেই ওয়েটারকে ডেকে দুটো কফি ও ওয়েজেস অর্ডার করলো। নন্দিনী মনে মনে হিসেব করতে লাগলো ওর ব্যাগে এই কফির বিল দেয়ার টাকা হবে কিনা। পাঁচ শ টাকা এক জোড়া স্যান্ডেল কিনবে বলে রেখেছিলো আর ভাংতি ষাট সত্তর টাকা হয়তো থাকতে পারে। যাই হোক স্যান্ডেল না হয় কিনবেনা আজ। পুরোনো স্যান্ডেলটা সেলাই করিয়ে নেবে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রত্না বললো – – – কিরে কি অত ভাবছিস বলতো ?ড্যাশিং হিরোকে নিয়ে সেইযে পালালি আর খবরই নেই তোর। আমার বিয়ে অবশ্য কোভিডের সময় হয়েছে। তবুও খোঁজ করেছিলাম তোর, কেউ বলতে পারলোনা তোর ঠিকানা। নন্দিনী কোনো কথা না বলে হাতের প্যাকেটগুলো একটা পাশের চেয়ারে সরিয়ে রাখতেই যাচ্ছিলো ঠিক তখনই প্যাকেটগুলো ওর হাত থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে নিলো রত্না ।
- ওহো তুই দেখি শপিং সেরে ফেলেছিস ? কি কিনলি দেখি ?
নন্দিনী জানতো কারো সামনে পড়লে এমন অস্বস্তিতে পড়তে হবে ওকে । তবু নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করলো। কোনো উত্তর দিলোনা রত্নার কথার।
রত্না এবার বললো – দেখি কি কিনলি? টি শার্টের ব্যাগটা থেকে টি শার্ট বের করে বললো – বাব্বাহ বরের জন্য টি শার্ট কিনেছিস ? আমার বর আবার তার জন্য কিছু কেনা পছন্দ করেনা। ব্র্যান্ডেড কাপড় ছাড়া পড়েই না। আমি আবার পুরুষ মানুষদের ব্র্যান্ড অত ßবুঝিনা। তাই আমাকে কিনতে হয়না বলে বেঁচে গেছি। আজকাল চার পাঁচ হাজারের কমে কিছু পাওয়াও যায়না। ওহ শাড়িও কিনেছিস দেখছি। দেখি … ওমা এটাকি খালাম্মার জন্য কিনেছিস ? আমিতো ভাবলাম তোর জন্য শপিং করতে এসেছিস ! তবে শাড়িটা আরেকটু দামী কেনা দরকার ছিল ।
আমিতো গত সপ্তাহে মায়ের জন্মদিনে দশ হাজার টাকা দিয়ে একটা জামদানি কিনে দিলাম। আমার বরের প্রমোশন হয়েছে বলে আমাকে একটা ডিজাইনার শাড়ি আর এক সেট গয়না কিনে দিয়েছে। আমাকে যমের মতো ভয় পায়। সামনের মাসে আমাকে একটা গাড়ি গিফট করবে বলেছে। সেটা দেখতেই গিয়েছিলাম সকাল সকাল। পরে ভাবলাম বাসায় পড়ার জন্য কয়েকটা ওয়ান পিস নিয়ে যাই এখান থেকে। এই মার্কেটেতো ব্র্যান্ডেড জিনিস তেমন পাওয়া যায়না।
রত্নার হুল ফোটানো কথার জবাবে নন্দিনী শুধু বললো- ঠিক বলেছিস।
এর মাঝে কফি আর ওয়েজেস দিয়ে গেলো ওয়েটার। নন্দিনী শুধু কফি নিলো। খাওয়া শেষ করে বিল মিটিয়ে দিতে পেরেছে এটাই ওর জন্য অনেক সম্মানের ব্যাপার আজ অন্তত রত্নার সামনে।
তবে এবার রত্নার সাথে কোনো ভদ্রতা না করে উঠে পড়লো। ছুটা কাজের বুয়া নিশ্চই চলে এসেছে বাসায়। টুক টাক বাজার করে ফিরতে ফিরতে আরো আধ ঘন্টা লেগেই যাবে ওর। রত্না অবশ্য কিছুতেই ছাড়তে চাইছিলোনা ওকে। কিন্তু ওর কথার বানে জর্জরিত হতে আর ভালো লাগছিলোনা নন্দিনীর। নন্দিনী ওর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে এলো শপিং সেন্টার থেকে। বাইরে বেরিয়ে লম্বা একটা দম নিয়ে বড় বড় পা ফেলে হাঁটা শুরু করলো।
চলবে…