সাবরিনা নিপু: আজ এক্সিবিশন এর প্রথম দিন ছিলো। সকালে গোলাপী তাঁতের শাড়ী পড়ে আয়নায় দাঁড়াতেই ঝিলিমিলিয়ে উঠেছিলো ওর গোলাপী ঠোঁট, গালের চিকন ত্বক, যত্নে সাজানো ভূরু আর আশ্চর্য আবেদন মাখা দুটো টলটলে চোখ। অথচ রাশেদ ওর দিকে ফিরেও তাকালোও না একবারও। ওর কিনে আনা টি-শার্টটা ছুঁয়েও দেখেনি রাশেদ। এই এক্সিবিশন এর কথা শুনেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেছিলো সেদিন। সাথে আজে বাজে কথা বলতেও ছাড়েনি। এই এক রুমের বাসার ভাড়াটা কিভাবে কোথা থেকে দেয় এ ব্যাপারটা নন্দিনীর কাছে আজো স্পষ্ট নয়। সেদিনের পর থেকে নন্দিনীর সাথে বাক বন্ধ রয়েছে ওর। নন্দিনীও ঘাটায়না ওকে। ইনফ্যাক্ট নন্দিনী কোনোভাবেই এই চাকরিটা হারাতে চায় না। এখন ওর জীবনে এই একটাই খোলা জানলা রয়েছে , কোনো কিছুর বিনিময়েই সে এটা হারাতে চায়না। বাসা থেকে বের হবার সময় এবার রাশেদ এসে ওর হাতের কব্জি ধরে মুচড়ে ঘরের ভেতর নিয়ে এসে হিসহিসে গলায় বললো
– আমার এখানে থেকে এসব বেলেল্লাপনা চলবে না।
নন্দিনী এবার ওর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কিছু না বলেই বেরিয়ে গেলো। ওই ফোলা হাতটা নিয়েই ম্যাডামের গাড়িতে পাঁচতারা হোটেলের লাইঞ্জে এসে পৌঁছালো যখন তখনো হাতের কব্জিতে প্রচণ্ড ব্যাথা অনুভব করছিলো। তবুও প্রতিটি পোশাক নন্দিনী খুব যত্ন করে দেখাচ্ছিলো কাস্টমারদের। প্রথম দুই ঘণ্টায় ওদের অর্ধেক পোশাক যখন বিক্রি হয়ে গেলো, নন্দিনীর ম্যাডাম এসে জড়িয়ে ধরলো ওকে। ওই মুহূর্তে হাতের ব্যাথাটাও যেন কমে গিয়েছিলো অনেকটা।
বাড়ি ফিরতে রাত হলেও ম্যাডাম নামিয়ে দিয়ে গেলেন ওকে। নন্দিনী দেখলো রাশেদ জানলায় দাঁড়িয়ে আছে। বুঝলো ওর অপেক্ষাতেই আছে রাশেদ। বাড়িতে ঢুকতেই অকথ্য ভাষায় গালাগাল আর সজোরে চড় কষালো ওর গালে। দ্বিতীয়বার গায়ে হাত তোলার আগেই এক হাতে আটকালো রাশেদকে। ওর গা থেকে তখন ভুর ভুর করে বাংলা মদের গন্ধ বেরুচ্ছে। নন্দিনীকে এক হাতে জড়িয়ে ধরলো রাশেদ। ব্লাউজটা পেছন থেকে এক ঝটকায় টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেললো। ওই খানে মুখ ঘষতে লাগলো।নন্দিনীর গা গুলিয়ে উঠলো কেন যেন। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে ঘরে যেয়ে ছিটকিনি লাগিয়ে দিলো । কিন্তু রাশেদ তখন ক্ষুধার্থ বাঘের মতোই ফুঁসছে। দরজায় দাঁড়িয়ে গালাগালি করতে লাগলো। এরপর সজোরে লাথি দিতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষন পর আর কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া গেলোনা। হয়তো ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে রাশেদ।
বাথরুমে ঢুকে ঝাপসা আয়নায় নিজের বিধ্বস্ত মুখটা দেখে আকাশ ভেঙে কান্না এলো ওর। যে ভালোবাসার জন্য নিজের পরিবার, আত্মীয়স্বজন বন্ধবান্ধব সব ছেড়েছে নন্দিনী এ কি সেই রাশেদ?
অনেকটা সময় নিয়ে গোসল সারলো ও। হাতে প্রচণ্ড ব্যথা। গালটা লাল হয়ে ফুলে আছে। কালকে সকালে কিভাবে যাবে এক্সিবিশনে এরকম একটা চেহারা নিয়ে তাই ভাবছে । ঘরে এসে কান পাতলো দরজায়। ওপাশে রাশেদ এর কোনো সাড়া শব্দ নেই। মনে মনে প্রমাদ গুনলো, কিছু হয়নিতো? দরজাটা সামান্য একটু ফাঁকা করে দেখলো চিৎ হয়ে একপাশে ফ্লোরে পড়ে আছে । নন্দিনী রাশেদের চোখে মুখে পানির ছিটা দিয়ে ওকে টেনে বিছানায় শুইয়ে দিলো কোনরকম। সার্ট এর বোতাম গুলো খুলে দিলো। রাশেদ এখন গভীর ঘুমে অচেতন। বহুদিন ওর দিকে ভালো করে তাকায়না নন্দিনী। এই কি সেই হ্যান্ডসাম ছাত্রনেতা যাকে দেখে রক্ত চলকে উঠতো নন্দিনীর ! সেই রাশেদ একমাথা এলোমেলো চুল, গাল ভর্তি চাপদাড়ি আর ভাসা ভাসা চোখ জোড়া বন্ধ করে কি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ঘুমাচ্ছে অথচ ওর প্রতি কোনো আকর্ষণই বোধ করছেনা নন্দিনী। আশ্চর্য! এতো মগ্নতা , এতো প্যাশন এভাবে নষ্ট হয়ে যায় ?সত্যিই আশ্চর্য লাগে ভাবতে, বিয়ের আগে দূর থেকে যেটাকে অ্যাচিভমেন্ট বলে মনে হতো। সেটা এই তিন বছরে কিভাবে উবে গেলো?
ছাত্র হিসেবে খুব ভালো ছিলো রাশেদ। নেতারা তার এই ভালো ছাত্র হওয়াকেই কাজে লাগিয়েছিলো। তাদের ফায়দা হাসিল করার জন্য ওকে নানা ভাবে অর্থনৈতিক সুবিধা দিতো প্রথম প্রথম। একটা মোটর সাইকেলও দিয়েছিলো ওই কলেজে পড়াকালীন সময়। ওর মোটর সাইকেলের পেছনে বসলে অন্যরকম এক শিহরণ হতো। রাশেদ একেতো ছিলো ভালো ছাত্র, জনপ্রিয় ছাত্রনেতা তার ওপর সুদর্শন। কলেজের সব সুন্দরীদের নজর ছিল ওর দিকে। কিন্তু নন্দিনীর সে সময় মনে হয়েছিলো বাই হুক অর ক্রুক রাশেদকে ওর চাই। তবে ভালোবেসেই চেয়েছিলো , এতে কোনো ভুল ছিলোনা। দলের নেতাদের সাথে দর কষাকষিতে হয়তো ঝামেলা হয়েছে। অথবা ওর বাবাকে ট্রাম্প কার্ড হিসেবে ব্যবহার করতে পারেনি বলেই রাশেদের আজ এই অবস্থা। কে জানে! নন্দিনী কখনও এ সমস্ত ব্যাপারে মাথা ঘামায়নি। ইনফ্যাক্ট বেকার, বাউন্ডুলে রাশেদকে যতোই অসহ্য মনে হোক, কিন্তু ওকে ছেড়ে যাবার কথা কখনও ওর মনেও আসেনি। এইযে নন্দিনীর টাকাতেই সংসার চলছে এখন, তাতে নন্দিনীর কোনো রকমের অসুবিধা বা আপত্তি নেই। কিন্তু রাশেদকে এরকম কর্মহীন আর ফ্রাস্টেটেড দেখতে ভালো লাগেনা নন্দিনীর। ও চায় কিছু টাকা জমিয়ে রাশেদকে নিয়ে একটা কিছু শুরু করবে। তবে এজন্য ওকে যেভাবে হোক অনেক হার্ড ওয়ার্ক করতে হবে। এখনই রাশেদকে কিছু জানাতে চায়না নন্দিনী। ও যদি জানতে পারলে যে কটা টাকা জমাচ্ছে তাও আর থাকবেনা।
ঘুমের ভেতর পাশ ফিরে শুলো রাশেদ। নন্দিনী উঠে আবার আয়নায় তাকালো। গালে কালশিটে পড়ে গেছে । এতো জোরে চড় মেরেছে রাশেদ নন্দিনীর মাথাটা ঘুরে উঠেছিলো। এই চেহারা নিয়ে কিভাবে এক্সিবিশনে যাবে ও তাই ভাবতে ভাবতে মাথা রাখলো বালিশে। কয়েক মুহূর্তেই তলিয়ে গেল ঘুমে।
খুব ভোরে ভোরে উঠে চাল, ডাল আর আলু দিয়ে নরম করে খিচুড়ি করে খেয়ে রেডী হয়ে নিলো। রাশেদ এখনও ঘুমে। ওর খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে চট করে বেরিয়ে পড়লো। রাশেদ উঠলে কোন হাঙ্গামা শুরু করে তার কোনো ঠিক নেই। যে কোনো ভাবে এই চাকরিটা ওকে ধরে রাখতেই হবে। এতো সকালে ভেন্যুতে একা একা যেতে মন সায় দিলোনা। সকাল সকাল ম্যাডামের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। এই প্রথম ম্যাডামের বাসায় যাচ্ছে নন্দিনী। যদিও খুব কাছেই বাসা। তোপখানা রোড থেকে সেগুনবাগিচা হাঁটা পথ। শিল্পকলা একাডেমীর আশে পাশেই কোথাও ম্যাডামের বাসা এটা ম্যাডাম বলেছিলেন। ও ব্যাগ থেকে ম্যাডামের কার্ডটা বের করে দেখে নিলো বাসার নাম্বার। একটা মুদি দোকানে জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দিলো একটা গলি পরেই একটা মাত্র নয়তলা অ্যাপার্টমেন্ট। সিকিউরিটি ইন্টারকমে নন্দিনীর নাম বলতেই আর অপেক্ষা করতে হয়নি। সাথে সাথেই লিফট এর ফাইভে যেতে বললো সিকিউরিটি গার্ড।
লিফটে থেকে বের হয়ে দেখলো ম্যাডাম দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। ম্যাডাম এতো সকালে ওকে আশা করেননি হয়তো। নন্দিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলেন তিনি… একি তোমার মুখে এমন দাগ হলো কি করে?
নন্দিনী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। ম্যাডাম হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন। নন্দিনী এবার তাকিয়ে দেখলো । এক হাজার স্কয়ার ফিটের হবে হয়তো ফ্ল্যাটটা। ছোট্ট লিভিং বেতের এক সেট সোফা দিয়ে সাজানো। দেয়ালে দুটো অ্যাবস্ট্রাক্ট পেইন্টিং l বেতের ডাইনিং টেবিলে সাদা ক্রুশের ঝালর দেয়া ডাইনিং ক্লথ। একটা স্নিগ্ধতা ঘিরে আছে ঘর জুড়ে। ডাইনিং এর ওপাশে দুটো দরজা। দুই বেড রুমের অ্যাপার্টমেন্ট হবে হয়তো। কাজের বুয়া একটা ট্রেতে করে লেবুর শরবত আর বিস্কিট রেখে গেল।
ম্যাডাম বললেন- শরবতটা এক চুমুকে শেষ করো। নন্দিনী নীরবে হুকুম তামিল করলো।
এবার বলো তোমার কি হয়েছে?
নন্দিনী রাতের ঘটনা সবটা খুলে বললো। ম্যাডাম খুব মন দিয়ে পুরো ঘটনা শুনলেন। গতকালও খেয়াল করেছি তুমি বার বার হাত ধরে রাখছিলে, তখনই তোমাকে জিজ্ঞেস করবো ভেবেছিলাম। পরে কাজের ঝামেলায় ভুলে গেছি। আর কালকে রাতে যেটা হয়েছে এটা খুব ভালো কিছু হয়নি। এভাবে মার খেয়ে খেয়ে কয়দিন কাজ করতে পারবে?
নন্দিনী সাথে সাথে ম্যাডামের দু হাত ধরলো। আমাকে আপনি বের করে দিয়েন না ম্যাডাম। আমি যে কোনো উপায়ে কাজ করবোই। এই কাজটা আমার খুব দরকার ম্যাডাম।
-সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু তোমার হাসব্যান্ড খুব ভালো মানুষ না। তোমার উপর রাগ করে দেখা গেল আমার দোকানে কোনো ঝামেলা করলো , তখন আমার ব্যবসাও যাবে। নন্দিনী এবার মরিয়া হয়ে বললো-ম্যাডাম আপনি আমাকে একটু সময় দেন, এমন কিছু যাতে না হয় সেটা আমি অবশ্যই খেয়াল রাখবো।
চলবে….