সাবরিনা নিপু: নন্দিনীর চোখ থেকে বড় বড় ফোটায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ম্যাডাম এবার ওর পাশে এসে বসলো। ওকে সান্তনা দেয়ার ভঙ্গিতে বললো- তোমরা এই জেনারেশনের বাচ্চা হয়ে এতো নরম প্রকৃতির কেন বলোতো? আবার ম্যাডাম উঠে যেয়ে একটা টিস্যু এনে ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন– চোখটা মোছো । তোমাকে এখন আরো স্ট্রং হতে হবে। যে কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আর তোমার সিদ্ধান্তটা তোমাকেই নিতে হবে। আজকের এক্সিবিশনটা শেষ হোক। তুমি দুদিন ছুটি নাও। বাসায় বসে ভাবো। তোমার জীবনে এখন কোন জিনিসটা সবচেয়ে বেশি জরুরি সেটা তোমার নিজেকেই ভেবে বের করতে হবে। তুমি কি রোজ রোজ মুখ ঝামটা আর মারধোর খেয়ে কাজ করতে চাও নাকি রাশেদ এর কথামতো চলতে চাও এটা তুমি ঠিক করবে। আমি তোমাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেবো না কথা দিচ্ছি।
এই ৫৫ বছর বয়সী লুবনা ইয়াসমিনকে তুমি কি মনে করো জানি না। দীর্ঘ ৩৫ বছর একা একা থাকতে থাকতে ইস্পাতের মতো কঠিন হয়ে গেছে হৃদয়। আর এই পৃথিবীতে তুমি একাই অ্যাবিউজ হচ্ছো এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। প্রতিটি নারী সে শিক্ষিত পরিবারের হোক বা অশিক্ষিত পরিবারের হোক, গরীব কি বড়লোক সেটা কোনো ব্যাপার না। কিন্তু কোনো না কোনো ভাবে তারা নির্যাতিত হয় সেটা যে সব সময় পুরুষদের দ্বারা হয় তা নয়, অনেক সময় নারীরাও বড় ভূমিকা রাখে এখানে।
কেন যেন আজ এই সকাল বেলায় লুবনা ইয়াসমিন নন্দিনীর কাছে মনের অর্গল খুলে দিয়ে বলতে শুরু করে…
আমার বিয়ে হয় মাস্টার্স পাশ করেই। ইন্টারন্যাশনাল অনার্স, মাস্টার্স করেছি । আমি ক্যারিয়ারিস্ট হবো, বড় চাকরি করবো এটাই আমার প্ল্যান ছিল। বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার প্রিপারেশন নিচ্ছি ঠিক সে সময় বাবা মা দুজনই বেঁকে বসলেন। বললেন, মেয়েদের বিসিএস পরীক্ষা দেয়ার দরকার নেই। কোথায় না কোথায় পোস্টিং হবে । তাছাড়া এমন পাত্রীর জন্য ভালো পাত্র পাওয়া যাবে না। বিসিএস যদি দিতেই হয় বিয়ের পর স্বামীর অনুমতি নিয়ে পরীক্ষায় বসা ভালো। আমাকে প্রায় জোর করেই বাবার ছোটবেলার এক বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়া হলো। বাবা মায়ের অনেক আরাধ্য সন্তান আমি। তাঁদের বিয়ের ১২ বছর পর অনেক সাধ্য সাধনা করে জন্ম হয়েছে আমার। ওদের একমাত্র মেয়ে হিসেবে অনেক বেশি পজেজিভ ছিলেন আমাকে নিয়ে। যাই হোক আব্বা তাঁর ছোটবেলার বন্ধুর ছেলের সাথে যখন আমার বিয়ে ঠিক করেছেন নিশ্চই ছেলে ভালোই হবে এই ভেবে আর কিছু বলিনি। তাঁদের কথা মতো রাজী হয়ে গেলাম বিয়েতে। বাবার বন্ধুকে ভালো করেই চিনতাম। উনি রেগুলার আসতেন আমাদের বাসায়। কিন্তু আমার হাসব্যান্ডকে বিয়ের আগে মাত্র একবার দেখেছিলাম তাও স্কুলে যখন পড়ি সেসময়। আমার জন্মদিনে ওর বাবা মা আর বোনের সাথে এসেছিলো। আমার বাবা জামাই এর জন্য গাড়ি থেকে শুরু করে ওদের পুরো বাড়ি ফার্নিচার দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিলো। ফ্রিজ, টিভি , এসি কোনো কিছু বাদ দেননি। অথচ তারপরও ফ্রিজ ধরতে হলে অনুমতি নিতে হতো শ্বাশুড়ির। গাড়ি থাকতো হাসব্যান্ড এর কাছে। সে ছিলো ড্রাগ অ্যাডিক্টেড। সরকারি চাকরি করতো। কোনোরকম অফিস শেষ করে কোথায় যে চলে যেতো কেউ জানে না। অনেক রাতে ফিরতো বাসায়। বিয়ের পর এখানেই প্রথম ধাক্কা খেলাম। প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলাম নেশা ছাড়ানোর। বাসায় কিছু জানাইনি বাবা মা কষ্ট পাবেন বলে। কিন্তু আমার শ্বাশুড়িকে তার ছেলের অ্যাডিকশনের কথা বললেই আমাকে নানা ভাবে হেয় করে কথা বলতেন। কয়েকদিনের জন্য সেবার বাবার বাড়ীতে বেড়াতে গেছি। বাসায় ফিরে দেখি আলমারির পেছনে ফেনসিডিলের খালি বোতল বেশ কয়েকটা। সেগুলো আমার শ্বাশুড়িকে দিতেই আমাকে আবার বেশ কিছু কথা শুনিয়ে দিলেন, আমার বাবাই নাকি জোর করে তার ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছেন, এ বিয়েতে নাকি উনি বা ওনার ছেলে কেউই রাজী ছিলেন না। শুধু আমার শ্বশুরের জোরাজুরিতেই নাকি ওনারা রাজি হয়েছেন। সত্যি তখন আমি কোনো উত্তর দিতে পারতাম না। বাবাকে যেয়ে যে জিজ্ঞেস করবো তাতেও মন সায় দিতো না। বাবা মা এতো শখ করে বিয়ে দিয়েছেন, এসব শুনলে তাঁরা কষ্ট পাবেন। তাই কখনও কিছু বলিনি।
এরপর শুরু হলো আরেক অশান্তি। এভাবে দুই বছর পার হয়ে গেলো। আমি কনসিভ করছি না কেন এজন্য আমাকে অলরেডি বাঁজা বলা শুরু হয়ে গেলো। বাবা এবার ইন্ডিয়ায় তাঁর এক পরিচিত ডাক্তারের কাছে পাঠালেন। প্রথমে আমার হাসব্যান্ড কিছুতেই যেতে রাজি হচ্ছিলো না। কারণ আমার শ্বাশুড়ি বললেন “আমার ছেলের কোনো সমস্যা নেই তাহলে ওর যাবার দরকার কি? তোমার মার সাথে তুমি যেয়ে ডাক্তার দেখিয়ে আসো ভালো করে।” আমার শ্বশুডর ছেলেকে ধমকে পাঠালেন আমার সাথে। ফাইনালি ওকে নিয়ে ইন্ডিয়া গেলাম। সব ডায়োগনসিস শেষ করে ডাক্তার বললো আমার কোনো সমস্যা নেই। ও যদি কিছুদিনের জন্য ড্রাগ নেওয়া বন্ধ করে দেয় তাহলেই মেডিসিন কাজ করবে। এরপর বাড়িতে ফিরে আমার প্রথম কাজই হলো ওকে পাহারায় রাখা। যাতে ও কোনোভাবেই ড্রাগ না নিতে পারে। নিজের বাঁজা ইমেজ ঘুচানোর জন্য আমিও তখন উঠে পড়ে লেগেছি। ক্যারিয়ারের চিন্তা মাথা থেকে তখন হাওয়া। যাই হোক আমার অদম্য ইচ্ছে ফল দিলো খুব তাড়াতাড়ি। ইন্ডিয়া থেকে ফেরার দুই মাসের ভেতর কনসিভ করলাম আমি। সবাই খুব খুশি। শুধু আমার শ্বাশুড়ি আর হাসব্যান্ড ছাড়া। যথা সময়ে আমার একটা ছেলে সন্তান হলো। হাসপাতাল থেকে বাচ্চা নিয়ে বাসায় ফিরলাম। সিজারের ওই সেলাই নিয়ে রাতভোর বাচ্চাকে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করে ঘুম পাড়াতে হতো। কেননা আমার ছেলে খুব কান্নাকাটি করতো সারারাত। কখনো আমার হাসব্যান্ড একটা বারের জন্যও ছেলেকে কোলে নেওয়ার চেষ্টা করতো না। “ছেলেকে আমার কাছে দিয়ে তুমি ঘুমাও” জাতিয় কথাবার্তা জীবনেও ওর মুখ থেকে বের হয়নি কখনও। বাচ্চা সারারাত কাঁদতো বলে আমার শ্বাশুড়ি ছেলেকে ডেকে নিয়ে বলেছে “এভাবে ঘুমের ডিস্টার্ব হলে অফিস কিভাবে করবে? তুমি যেয়ে ড্রইং রুমে ঘুমাও”। ছেলেও মায়ের কথা শুনে সেই যে আলাদা ঘরে থাকা শুরু করলো বিয়ের তিন বছর পর থেকেই। তার পরের দুই বছর আর কখনও এক ঘরে থাকা হয়নি আমাদের। আমার সাথে সম্পর্ক না রাখুক, তাই বলে ছেলেকে কোলে নিবেনা? কখনোই কোলে নিতে চাইতো না। জোর করে দিলেও বলতো সার্ট এর ভাঁজ নষ্ট হয়ে যাবে। ভাবতে পারো। এই মানুষটার ঘর করেছি আমি যার সন্তানের প্রতিও বিন্দুমাত্র টান ছিলো না। এর পরের ঘটনা আরো করুণ। ওর এক খালাতো বোন এসেছে আমেরিকা থেকে। সারাক্ষণ আমার শ্বাশুড়ি আর হাসব্যান্ড ওকে নিয়েই ব্যস্ত। আমার বাবার কিনে দেওয়া গাড়িতে করে রোজ সন্ধ্যায় বেড়াতে বেরোয় নাফিস অফিস থেকে ফিরলে। অথচ ওই গাড়িতে আমাকে কোনোদিন ও একা কোথাও নিয়ে যায়নি। কতো ইচ্ছে করতো খুব বৃষ্টিতে লং ড্রাইভে যাবো দুজন। ও কোনোদিন আমার ইচ্ছের কথা জানতে চায়নি আমিও মুখ ফুটে বলিনি কিছু।
দুঃসময় যখন আসে এভাবেই আসে হয়তো। এক রাতে প্রচণ্ড জ্বর আর বমি শুরু হলো। এর ভেতর এই ছোট বাচ্চাটাকে ব্রেস্ট ফিড করাচ্ছি । এ বাসায় বাচ্চাকে দেখার মতো কেউ ছিলোনা। দাদা কিছুক্ষণ কোলে নিয়ে বসে থাকলেও কি এক অজানা কারণে দাদী কখনও নাতিকে কোলে নিতেন না। আমার এ অবস্থা দেখে নাফিসের বাবা মা দুজনেই আমাকে বাবার বাড়িতে চলে যেতে বললেন। আমারও মনে হলো সেটাই ভালো। ওখানে অন্তত মা আমার ছেলেকে দেখতে পারবে। সেদিনই বিকেলে চলে গেলাম বাবার বাসায়।
সুস্থ হতে সময় লেগেছিলো এক মাসের মতো। এর ভেতর শ্বশুরবাড়ির কেউ এসে উঁকি দেওয়াতো দুর ফোনেও খোঁজ নেয়নি কখনো। আমি একদিন ছুটির দিন দুপুরে শ্বশুড়বাড়িতে গেলাম আমার কিছু কাপড় চোপড় নেওয়ার জন্য। বুয়া গেইট খুলে দিয়ে ড্রইং রুমে বসতে বললো। এর ভেতর আমার শ্বাশুড়ি এসে হাজির। খুব মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে কখনো যেটা করেনি তাই করা শুরু করলেন। আমি বাচ্চা রেখে একা একা কেন বের হয়েছি, তার ছেলে এখন ঘুমাচ্ছে বেডরুমে যাওয়া যাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি বলতে লাগলো। বুয়া ট্রেতে করে পুডিং, সমুসা আর জ্যুস রেখে গেলো। আমার শ্বাশুড়ি প্রথমবারের মতো জোর করে খাওয়ালেন আমাকে। আমি ততক্ষণে বুঝে গেছি নিশ্চই কিছু একটা গন্ডগোল আছে এখানে।
চলবে…