বাইরে থেকে মেঘ গর্জনের গুড়ু গুড়ু ধ্বনি ভেসে আসছে, ম্যাডাম কেমন ভাবলেশহীন ভাবেই আবার বলতে শুরু করলেন…
দেখো নন্দিনী আমি কিন্তু সেদিন এখনকার এই ঘা খাওয়া স্ট্রং লুবনা ইয়াসমিন ছিলাম না। আমার সহজ সরল মনে অন্য কোনো ভাবনাই আসেনি। আমার শ্বাশুড়ি বললেন .. তোমার যা দরকার নাফিস রাতে যেয়ে পৌঁছে দিয়ে আসবে।
এ কথা শুনে মনে মনে খুশীই হলাম। ভাবলাম অনেকদিন ছেলেটাকে দেখতে আসেনা নাফিস। বাবা মাও খুশী হবেন ওকে দেখলে। আমি আর দেরী না করে বেরিয়ে আসলাম শ্বশুরবাড়ি থেকে।
বাসায় যেয়ে মাকে বলতেই মাতো জামাই এর জন্য রীতিমতো ভোজের আয়োজন শুরু করে দিলেন। সন্ধ্যা থেকে অপেক্ষা করতে করতে রাত দশটা বাজলো। এবার মেজাজ খারাপ করে ফোন দিলাম। বললো নট রিচেবল। শাশুড়িকে ফোন দিলাম। উনি বললেন হঠাৎ করে অফিসের কাজে চিটাগং গেছে। কিছুই বলতে ইচ্ছে করছিল না সেই মুহূর্তে শুধু বললাম, একটা কল করে বলে গেলেওতো পারতো। উনি কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন আমি এর মাঝেই ফোন সুইচড অফ করে দিলাম l ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়লাম।
সকালে ড্রাইভারকে দিয়ে শাশুড়ি একটা স্যুটকেস পাঠালেন। হয়তো রাতে ফোনটা ওভাবে রেখে দিয়েছিলাম বলেই আমার যে মেজাজ খারাপ হয়েছে বুঝতে পেরেছেন।। ড্রাইভার স্যুটকেস নিয়ে চারতলায় আমার বেডরুমে পৌঁছে দিতে এসে চুপ করে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রইলো। ওকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, কিছু বলবেন ড্রাইভার আঙ্কেল? ড্রাইভার হাত কচলাতে লাগলো আমি একটা কথা বলতে চাই মামনি। মন কিন্তু অলরেডি কু ডাক গাইতে শুরু করেছে তখন।
ড্রাইভার বললো- আপনি যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসায় ফিরে আসেন মামনি।
- বাবুকে ওখানে একা সামলাতে পারি না। এখানে থাকলে একটু সুবিধা হয়। আচ্ছা আপনার কোনো সমস্যা হচ্ছে ওখানে?
- না মামনি। আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তবে আপনার ওখানে যাওয়া খুব জরুরি। এর বেশি কিছু বলতে চাই না।
- কি হয়েছে বলবেনতো? কি এমন কথা যা বলতে পারছেন না?
- মামনি আপনি বাড়িতে ফিরে আসেন তাড়াতাড়ি । তখন নিজেই বুঝতে পারবেন।
এই ড্রাইভার আঙ্কেল। আমার বাবার অনেক পুরোনো ড্রাইভার। কিন্তু বিয়ের সময় গাড়ির সাথে ড্রাইভারও দিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। যাতে আমার কোনো অসুবিধে না হয়। কিন্তু গাড়ি সারাক্ষণ নাফিসের সাথেই। বিয়ের পর পর খুব ইচ্ছে করতো ওর সাথে লং ড্রাইভে যাই। কিন্তু কোনোদিন ও ইনসিসট করেনি আমিও রিকুয়েস্ট করিনি পাঁচ বছরে কখনো কোথাও যাওয়া হয়নি। এমনকি কক্সবাজারেও বেড়াতে যাইনি ওর সাথে কখনো।
যাই হোক, ড্রাইভারের কথাটা সারাদিন মাথায় ঘুরতে লাগলো। রাতে বাবা মার সাথে কথা বললাম। ওঁরাও মত দিলেন। বাবা বললেন- ও আমাদের এতো পুরোনো এম্প্লয়ী, পরিবারের একজন সদস্যই হয়ে গেছে। ও তোকে যখন ওই বাড়িতে যেতে বলেছে নিশ্চই ভেবেই বলেছে।
আমি ওই বাড়িতে কাউকে কিছু না জানিয়ে পরদিন বিকেলে যেয়ে হাজির হলাম। আমাকে দেখে আমার শ্বাশুড়ি ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন যেন।
বললেন- কি ব্যাপার এরকম না জানিয়ে বাড়িতে এসে হাজির হয়েছো? তোমার স্যুটকেসতো ড্রাইভারকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম কালকেই। আজ আবার কি দরকার হলো? এতো ছোট বাচ্চা নিয়ে যখন তখন বের না হওয়াই ভালো।
কথাটা শুনে মাথাটা এতো গরম হয়ে গিয়েছিলো, অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছিলো কিন্তু বরাবরের মতো নিজেকে সামলে নিলাম। এর মাঝেই আমার শ্বশুর এসে ওখানে হাজির হলেন। উনি ভীষণ খুশি হলেন আমাকে দেখে। হৈ হৈ করে নাতিকে কোলে নিয়ে খেলতে লাগলেন, আমাকে বললেন তোমার বাবাকে আজই ফোন দিতে যাচ্ছিলাম, বলতে চাচ্ছিলাম আর কতোদিন নাতিকে নিয়ে একা একা খেলবে । এবার আমাকে একটু খেলার সুযোগ দাও… বলার আগেই আমার দাদু ভাই এসে হাজির। খুব ভালো করেছো বৌমা। তোমাদের বাসার সবাই ভালো আছেতো?
-জ্বি বাবা ভালো আছে বলে আমার বেড রুমের দিকে পা বাড়াতেই যাচ্ছিলাম। শ্বাশুড়ি পেছন থেকে ডাকলেন। নাফিসের ঘরতো লক করা। ও ফিরুক তারপর তুমি থাকতে এসো।
একথা শুনে মেজাজ আর ঠিক রাখতে পারলাম না। একটু গলাটা চড়িয়েই বললাম – মা আপনি ভুলে গেছেন এই রুমটা আমারও। এবার শ্বশুর থামিয়ে দিলেন শ্বাশুড়িকে! বললেন- ওকে ওর রুমে যেতে কেন মানা করছো?
- মানা করছি কারণ, রুমটা লক করা, এলোমেলো হয়ে আছে। বাচ্চা নিয়ে এই অগোছালো রুমে ঢোকার দরকারও নেই। আর এই রুমের চাবি আমার কাছে নেই, নাফিস নিয়ে গেছে।
- বলো কি? নাফিস এতো দায়িত্ববান হলো কবে থেকে ওকেতো জীবনে কোনোদিন দরজাই বন্ধ করতে দেখিনি। আজকে ও রুমে তালা বন্ধ করে ও গেছে কোথায়?
- ওর অফিসের কাজে চিটাগং গেছে কালকে। তুমিতো বরিশাল থেকে আসলেই সকালে, তুমি কিভাবে জানবে?
- আমি ওদের বাক বিতন্ডার মাঝখানেই আমার চাবি দিয়ে রুমের লক খুলে ভেতরে ঢুকলাম। আমার শ্বাশুড়ি মনে হলো দৌঁড়ে এলেন সেখানে।
-তুমি কিভাবে ঢুকলে রুমে?
- মা আপনি বোধ হয় ভুলে গেছেন, এ রুমের একটা চাবি আমার কাছেও থাকে। তারপর হেসে বললাম, আপনি যেমন বলছিলেন তেমন অগোছালো হয়ে নেই রুমটা। মনে হচ্ছে এই মাত্র কেউ পরিষ্কার করে গেছে।
শ্বাশুড়ি মা কিছু বলতেই যাচ্ছিলেন , এর ভেতর ঘুমন্ত ছেলেটাকে কোলে নিয়ে শ্বশুর ঘরে ঢুকলেন। - নাও বৌমা তোমার ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি।
- খুব ভালো করেছেন বাবা। বলেই ছেলেকে দাদার কোল থেকে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলাম। পেছনে ফিরে দেখলাম শ্বাশুড়ি চিন্তিত মুখে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। আমি বুঝতে পারছিলাম আমি এভাবে না বলে এ বাড়িতে আসাতে কোথাও একটা বিরাট সমস্যা হয়েছে এ কথা তাঁর মুখ দেখেই আন্দাজ করতে পারছি। খুব অস্বস্তি হচ্ছে আমারও, যদিও মুখে সেটা প্রকাশ করছি না মোটেও। গতকাল রাতে আমার এক স্কুলের বন্ধু রুনা ফোন করেছিলো। ও একটা খবরের কাগজে নারী বিষয়ক একটি বিশেষ পাতা সম্পাদনা করে। ওকে ড্রাইভার আঙ্কেলের বলা কথাগুলো বললাম, শুনে বললো -ডালমে কুচ কালাতো অবশ্যই আছে। তা না হলে তোর বর দিনের পর দিন তোকে রেখে ওই বাড়িতে একা থাকবে কেন? তোর প্রতি ভালোবাসা থাকলে ছেলের প্রতি টান থাকলে ঠিকই জোর করে বাসায় নিয়ে যেতো অথবা নিজেই এসে তোদের সাথে থাকতো। লুবনা তুই অবশ্যই ওই বাড়িতে যাবি এবং বোল্ডলি কথা বলবি। সিচুয়েশন যেমনই হোক, ওই বাড়ি থেকে খবরদার ফিরে আসবি না। নিজের অধিকার আদায় করে নিতে হয়। তুই নরম স্বভাবের বলেই ওরাও তোকে পেয়ে বসেছে। ভয় পাবি না একদম। যা বলবে ওখানেই জবাব দিয়ে দিবি। কোনো টেনশান করবি না। তোর পাশে আছি সব সময়। তোর বাবা কি আর জানতো একটা অ্যাডিক্টেড ছেলের হাতে একমাত্র মেয়েকে তুলে দিচ্ছে?
ওর কথার উত্তরে শুধু বলেছি , সবই আমার ভাগ্য। তুই আমার পাশে আছিস, এটা অনেক বড় পাওয়া।
রুনার কথা মনে করেই আজকে সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে নিজের অধিকারের জন্য লড়াই করতে এসেছি। ছেলেকে স্পয়েল করার পেছনে যে আমার শ্বাশুড়ি মা অনেকাংশে দায়ী তা বোঝাই যায়। বিয়ের পর পর কতো ফেনসিডিলের জমানো বোতল জানলার পর্দার পেছন থেকে বের করে দিয়েছি। উনি এগুলো দেখে বলতেন- ওর বন্ধুবান্ধবরা কেউ এগুলো খেয়ে বোতল রেখে গেছে। আমার ছেলেকে আমি কখনো এসব ছাই পাস খেতে দেখিনি। আমার ছেলে জীবনে কোনোদিন কিছুতে সেকেন্ড হয়নি। খবরদার আমার ছেলের নামে কোনো বাজে কথা বলার আগে দশবার ভাববে। তারপরতো ইন্ডিয়ার ডাক্তারের কাছে যেয়ে টেস্টে ধরা পড়লো নাফিস অ্যাডিক্টেড। যাই হোক ড্রাইভার আঙ্কেল কেন এ বাসায় অবশ্যই ফিরতে বলেছে তার পেছনে কারণ কি এসব ভাবনা নিয়েই ফিরেছি যদিও ফিরে আসতে মন কোনো ভাবেই সায় দিচ্ছিলো না। তবে আমার শ্বাশুড়ির চেহারা দেখে বোঝাই যাচ্ছে আমি ফিরে আসাতে উনি মোটেও খুশি হতে পারছেন না। নাতিকে একবার কোলে নেওয়াতো দূর নাতির দিকে তাকিয়েও দেখেননি। আমার মন খারাপ লাগলেও আজ আমি দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নেবো সব। তা না হলে এই বাড়িতে টিকে থাকা মুশকিল হবে। আমি পাঁচ বছর আগে বিয়ে হয়ে আসা লাজুক মেয়েটি নই।
এই পাঁচ বছরে নানান ঝড়-ঝাপটা সামলাতে সামলাতে এতো দূর এসেছি। এখন সামনে কি আছে সেটাই দেখার অপেক্ষা। ছেলেটা অঘোরে ঘুমাচ্ছে। আমার শ্বাশুড়ি বিছানার একপাশে বসে আছে। উনিতো কোনোদিন নাতিকে কোলেও নেননি। ভাবলাম, অনেকদিন পর দেখে হয়তো মায়া লাগছে। রক্তের সম্পর্ক কি আর অস্বীকার করা যায়? জানি আমি এখানে আসায় উনি খুব একটা খুশি হননি কিন্তু আমি মনে মনে বেশ খুশিই হলাম নাতির প্রতি তিনি এতোটা কনসার্ন দেখে। যাই হোক, প্রসন্ন মন নিয়ে হাত ধুতে ওয়াশ রুমে ঢুকলাম। কিন্তু বের হয়ে আসার সময় দরজার হ্যাঙ্গারে চোখ পড়তেই এক নিমেষেই সমস্ত আনন্দ উধাও হয়ে গেলো।
চলবে…