সাবরিনা নিপু: বাথরুমের দরজার হ্যাঙ্গারে ঝুলে আছে নাফিসের একটা গাউন তার পাশে ঝুলে আছে জর্জেটের পার্পল কালারের একটা নাইটি। কিন্তু এমন নাইটি আমি কি কখনও পড়েছি মনে করার চেষ্টা করলাম। নাহ কিচ্ছু মনে পড়ছে না। মনকে প্রবোধ দিলাম শুধু শুধুই অন্যকে বলার আগে মনে করার চেষ্টা করো লুবনা ইয়াসমিন……. নাহ সমস্ত স্মৃতি ঘেঁটেও এমন একটা নাইটির কথা কোনোভাবেই মনে করতে পারলাম না। তবে কেন যেন মনে হচ্ছে এটা আমি আগেও দেখেছি। এই বাড়িতেই অন্য কাউকে পড়তে দেখেছি কি? হঠাৎ ছেলের কান্নার আওয়াজ পেয়ে দরজা খুলে বের হলাম। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, আমার শ্বাশুড়ি মা এবং বুয়া একটা ঢাউস লাগেজ খাটের পেছন দিক থেকে টানতে টানতে বের করে আনার চেষ্টা করছে। আমাকে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হলেন দুজনেই। বুঝলাম এই লাগেজ টানাটানি করতে যেয়ে খাটে ধাক্কা লাগাতেই হয়তো ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো বাচ্চাটার। কিন্তু এটাতো পিঙ্কির স্যুটকেস। আমার বেডরুমে পিঙ্কির স্যুটকেস কেন? হঠাৎ বাথরুমে হ্যাঙ্গারে রাখা নাইটিটার রহস্য উন্মোচিত হলো। এই নাইটিটা পিঙ্কির। ও আমেরিকা থেকে আসার পরদিন ওকে ঘুম থেকে জাগাতে যেয়ে ওর পরনে দেখেছিলাম পার্পল নাইটিটা। কিন্তু আমার বাথরমে ওর কাপড়, ওর স্যুটকেসও আমার বেডরুমে। আমি চলে যাবার পর হয়তো আমার শ্বাশুড়ি মা তাঁর বোনের মেয়েকে এ রুমে থাকতে দিয়েছেন। নাফিস কি তাহলে গেস্ট রুমে শিফট করেছে? কিন্তু বাথরুমেতো নাফিসের গাউনও আছে। এতো কিছু ভাবতে পারছিলাম না আর । শ্বাশুড়িকে জিজ্ঞেস করলাম – এটাতো পিঙ্কির স্যুটকেস তাই না?
- হ্যাঁ গেস্ট রুমের বাথরুমে গিজার নেইতো , ও আবার গরম পানি ছাড়া ইউজ করতে পারে না। তুমি ছিলে না বলে ওকে এখানে থাকতে দিয়েছিলাম।
- সেটা ঠিক আছে। কিন্তু ওরতো গত সপ্তাহে চলে যাবার কথা ছিলো।
- কি যেন কাজ আছে তাই একমাস পিছিয়ে টিকিট চেঞ্জ করে নিয়েছে।
কথা বলতে বলতে বাচ্চাটার ডায়পার চেঞ্জ করে দিলাম… - ওহ আচ্ছা। এখন কোথায় ও?
এর কোনো উত্তর পেলাম না। পেছন ফিরে দেখি উনি কখন বেরিয়ে গেছেন ঘর থেকে । কানে ভেসে এলো চেনা গাড়ির হর্ন। আমার জানলায় দাঁড়িয়ে মেইন গেইটটা স্পষ্ট দেখা যায়। দেখলাম ড্রাইভার আংকেল গাড়ি নিয়ে ঢুকছে বাসায়। এবার গাড়ির পেছনের সিটে বসে থাকা নাফিস ও পিঙ্কিকে নেমে আসতে দেখলাম। ততক্ষনে আমার মাথায় ঘুরপাক খাওয়া সমস্ত প্রশ্নের উত্তরগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠলো। ইচ্ছে করছিলো ওই মুহূর্তে নিচে নেমে যেয়ে ওদের মুখোমুখি দাঁড়াই। কিন্তু লজ্জায় ঘেন্নায় যেতে ইচ্ছে করলো না ওখানে। দরজা বন্ধ করে দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলাম মনে আছে। মনে হচ্ছিলো জীবনে এতো অপমানিত বোধ হয়নি কখনো। স্যুটকেস থেকে বাচ্চার যে কাপড়গুলো বের করেছিলাম সেগুলো আবার তুলে নিলাম। চেয়ারে দাঁড়িয়ে আলমারীর ওপর থেকে বড় স্যুটকেসটা নামালাম। ধুলোবালি ঝেড়ে ক্লজেট থেকে সব কাপড় নামিয়ে একে একে সব ঢুকালাম। বিয়ের সময় উপহার পাওয়া কিছু টুকটাক জিনিস ছিল। খুব পছন্দের ছিলো সেগুলো তবু সেই মূহূর্তে মানসিক ভাবে এতোটাই ভেঙে পড়েছিলাম যে কোনো কিছুর প্রতি কোনো টান অনুভব করছিলাম না। যেই মুহূর্তে ওদের দুজনকে গাড়ি থেকে নেমে হাত ধরাধরি করে বাড়ির ভেতরের দিকে এগিয়ে আসতে দেখলাম, ঠিক সেই মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি এ বাড়িতে আর এক মুহূর্তও নয়। কোন দুঃখে আজ আসতে গেলাম এখানে ?
সিঁড়িতে ওদের পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। দম আটকে আসছে আমার। মনে হচ্ছিলো এখানে আর কিছুক্ষণ থাকলে আমি দম বন্ধ হয়ে মারা যাবো। দরজাটা ভেতর থেকে লক করে দিলাম। কতোক্ষণ স্থানুর মতো বসেছিলাম জানি না, দরজায় টোকা দেওয়ার শব্দে বিহ্বলতা কাটলো যেন। আমার শ্বশুর বাইরে থেকে ডেকে চলেছেন এক নাগাড়ে, বৌমা নাফিস এসেছে। আমার দাদু ভাইকে নিয়ে বাইরে আসো।
চোখ মুছে অনিচ্ছাসত্ত্বেও দরজাটা খুলে দিলাম। বললাম, বাবু ঘুমাচ্ছে বাবা।
আমার শ্বশুরের হাসি হাসি মুখটা দেখেই বুঝতে বুঝতে পেরেছিলাম তাঁর ছেলে এসেছে বলেই এতো খুশি! বললেন – বৌমা নাফিস এসেছে। তোমার সাথে দেখা হয়নি?
মাথা নেড়ে বললাম-নাহ!
- বলো কি ? ওতো অনেকক্ষণ এসেছে। বাবুকে দেখতে আসেনি এখনো ? ওহ ! তোমার দরজা বন্ধ দেখে হয়তো ভেবেছে বাবু ঘুমাচ্ছে তাই ডিস্টার্ব করেনি। নাফিসকে ডাকতে ডাকতে আবার ড্রইংরুমের দিকে চলে গেলেন তিনি।
ও ঘরে যেতে মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না। তার বদলে ড্রাইভার আংকেলকে ফোন দিলাম। এ বাড়ির দোতলায় ওঠার সিঁড়িটা বাইরের দিকে। ড্রাইভার উঠে আসতেই স্যুটকেস আর ব্যাগগুলো পাঠিয়ে দিলাম গাড়িতে। ঘুমন্ত বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম। ড্রইং রুম থেকে বাবা মা ও ছেলের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় ভেসে আসছে। বুঝলাম শ্বশুর হয়তো আমার পক্ষ হয়ে কিছু বলতে গিয়েছিলেন। যাই হোক, ওই মুহূর্তে আমার সমাজ, সংসার আত্মীয় স্বজন , কোনটা শোভন কোনটা অশোভন তার কিছুই মাথায় আসছিলো না। শুধু মনে হচ্ছিলো এই মুহূর্তে এখান থেকে আমাকে চলে যেতে হবে তা নাহলে দম আটকে মারা যাবো আমি। জীবনের শেষ বারের মতো ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। বাবা মা দুজনেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এতোদিন যে কথাগুলো বুকের ভেতর জমিয়ে রেখেছিলাম সব বললাম। বাবা ছলো ছলো চোখে চেয়ে রইলেন, মা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তাঁদের বহুদিনের চেনা বন্ধুর পরিবার এমন হতে পারে তা হয়তো বাবার পুরোপুরি বিশ্বাস হয়নি। তাই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন… তুমি কি আর সত্যিই ওই বাড়িতে ফিরে যাবেনা? আমি শুধু একবার চোখ তুলে তাকালাম বাবার দিকে। বাবা হয়তো আমার চোখের ভাষা পড়তে পেরেছিলেন। আমার মাথায় একটা হাত রেখে বললেন – আই এম স্যরি মা। ভুল আমারই হয়েছিলো। ওই বাড়িতে আর ফিরে যেতে হবে না তোমাকে। ড্রাইভারকে বললেন গাড়ি গ্যারেজে তুলে রাখো। এই গাড়ি আর ওই বাড়িতে যাবে না। এমন স্বস্তির দিন আমার জীবনে যেন এর আগে কখনোই আসেনি আর। তবে এ স্বস্তি দীর্ঘস্থায়ী হবার আগেই নাফিস তার মাকে সাথে করে হাজির হলো। এসেই আমাকে চোর বাটপার বলে গালি গালাজ শুরু করলো। না বলে ওর গাড়ি চুরি করে নিয়ে এসেছি এই অপবাদ দিল আমাকে। আমার বাবাকে বললো – আপনি একটা ধান্দাবাজ। কেমন কায়দা করে মেয়েকে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়েছেন যখন আমি বাড়িতেই ছিলাম না। ওর কাছে সব কিছুর ডুপ্লিকেট চাবি আছে। ও আমার ক্লজেট থেকে সব নিয়ে চোরের মতো চলে এসেছে ।
বাবা একবার ওর নাফিসের মুখের দিকে ভাবলেশহীন হয়ে তাকিয়ে রইলেন। এবার আমার শ্বাশুড়ি মা শুরু করলেন, এমন মেয়েকে ওদের ছেলের ঘাড়ে চাপানোর জন্য আমার বাবা মাকে রীতিমতো ভর্ৎসনা করতে লাগলেন।
এবার বাবা আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। তাঁর এতদিনের সহ্যের বাঁধ যেন ভেঙে পড়লো এবার। কে কার ঘাড়ে চাপিয়েছে তা আপনার ভালো মানুষ স্বামী এবং আমার বন্ধুটিকে জিজ্ঞেস করবেন অনুগ্রহ করে। আমার আদরের মেয়েকে আমি জোর করে আপনাদের কাছে গছিয়েছি নাকি আপনাদের অ্যাডিক্টেড ছেলের জন্য ভালো কোনো পরিবারের মেয়ে পাবেন না বলেই এক প্রকার জোর করেই আমার মেয়েকে নিয়েছেন। আগে জানলে আমি আমার মেয়েকে এমন ধরে বেঁধে আগুনে ফেলে দিতাম না কোনোদিনও। আর আমার মেয়েকে চোর সাব্যস্ত করছেন কোন সাহসে? আপনারা এমন কি দিয়েছেন ওকে যা ওকে চুরি করে আনতে হবে? একমাত্র মেয়েকে শাড়ি গয়নায় মুড়িয়ে বিয়ে দিয়েছিলাম। গাড়ির সাথে ড্রাইভারও দিয়ে রেখেছি যাতে আমার মেয়ের কোনরকম কষ্ট না হয় অথচ সেই গাড়ি নিয়ে আপনার ছেলে বেলেল্লাপনা করে বেড়ায় সারাক্ষণ।
- মুখ সামলে কথা বলুন..এবার তেঁতে উঠলো নাফিস !
- কেন মুখ সামলে কথা বলবো বলোতো? তুমিতো আজ দুপুরে ফিরেছো কক্সবাজার থেকে। সাথে কি আমার মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলে ? কোনোদিন কি বেড়াতে বেরিয়েছো ওকে নিয়ে ? এতোদিন মান সম্মানের ভয়ে কিছু বলিনি। ভেবেছি তোমার বাবা আমার ভালো বন্ধু, ওর বাড়িতে আমার মেয়ে রাজরানী হয়ে থাকবে। এই তার নমুনা। বাচ্চা হওয়ার আগ পর্যন্ত আমার মেয়েকে বাঁজা অপবাদ দেওয়া হয়েছে অথচ তোমার অ্যাডিকশনের কারণে এই তিনটা বছর তোমাদের কোনো ইস্যুস হয়নি। অনেক ডাক্তার দেখিয়ে সাধ্য সাধনা করে বাচ্চাটা যখন হলো এরপর আমার মেয়েকে খোটা দেবার যখন আর কিছু নেই , তখন ওকে চোর সাব্যস্ত করছো? বাচ্চার সাথে কতোটা সময় কাটিয়েছো তুমি? তোমার ঘুমের ডিস্টার্ব হয় বলে আমার মেয়ে বাচ্চা নিয়ে আপাতত আমার বাড়িতেই আছে। তুমিতো বাচ্চাটাকে এক নজর দেখতেও আসো না। আমার মেয়েতো তোমার সাথে থাকার জন্যই ওই বাড়িতে গিয়েছিলো। তাহলে কি কারণে ফিরে এলো তার উত্তর আছে তোমাদের কাছে ? আর ওর ক্লজেট থেকে ওর জিনিষ ছাড়া আর কি আনবে? তোমরা বিয়ের সময় যে পাঁচ ভরি গয়না দিয়েছিলে তা বিয়ের পরদিনই তোমার মা নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। বিশ্বাস না হলে তোমার মাকেই জিজ্ঞেস করো।
চলবে…