সাবরিনা নিপু: নাফিস তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো যেন! বললো, আমার মায়ের ব্যাপারে কোনো বাজে কথা বলবেন না। আপনার মেয়ে এসব কথা বানিয়ে বলেছে আমার মা সম্পর্কে। আপনারা বাড়িতে এনে গয়নাগুলো লুকিয়ে রেখেছেন কিনা তা পুলিশ দিয়ে বের করাবো আমি।
মা অনেকক্ষণ থেকে চুপচাপ সব শুনছিলেন এবার গর্জে উঠলেন
- এতো কথা কোন সাহসে বলো তুমি? তোমার লজ্জা করে না নাফিস? তুমি আমার একটা মাত্র মেয়ের জামাই। কতো শখ করে মেয়ের বিয়ে দিয়েছি আমরা। তোমার বাবা আমার স্বামীর বন্ধু বলেই এতোটা ছাড় দিয়েছি আমরা। বিয়েতে এই গয়নাগুলো ছাড়া আর কোনো কিছুই তোমাদের বাড়ি থেকে আসেনি। একটা সুতোও না। আমাদের মেয়েটা একটা পরিচিত বাড়িতে যাবে। আদরে থাকবে শুধু এইজন্য তোমাদের পুরো বাড়ি সাজিয়ে দিয়েছে ওর বাবা। গাড়ির সাথে ড্রাইভারটাও রেখে দিয়েছেন । ওর বেতনটাও এই বাড়ি থেকেই দেওয়া হয়। বিয়ের পর প্রথম যখন জানতে পারলাম তুমি অ্যাডিক্টেড। রিহ্যাব এ পাঠানোর সমস্ত খরচ দিয়েছি আমরা। ইভেন তোমাদের কোনো ইস্যু নেই দেখে আমার মেয়েকে যখন রোজ অপমানিত হতে হয়েছে। তখন ইন্ডিয়ান ডাক্তারের সাথে অ্যাপয়েনমেন্ট করা থেকে শুরু করে চিকিৎসার সমস্ত খরচ বহন করেছি আমরা। এতো আরাধ্য একটা সন্তান হয়েছে তোমার অথচ বাচ্চাটা হওয়ার পর থেকে একটা জামা প্যান্ট বা একটা খেলনা অথবা দুধের কৌটাও এখনও কিনতে হয়নি তোমার। এরপরও তোমাদের মুখে কথা আসে কিভাবে ? তুমি না একজন সরকারী কর্মকর্তা ? এতো শিক্ষিত আর প্রগতিশীল দাবী করো নিজেদের অথচ আচরণ করো বস্তিবাসীর মতো। ছি!
একথা বলে এক মুহূর্ত আর ওখানে দাঁড়ালেন না মা। হন হন করে ভেতরে চলে গেলেন।
নাফিসের মুখটা দেখাচ্ছিলো তখন একেবারে রক্তশূন্য । আর ওর মায়েরও মুখ চুন। ওরা এই বাড়িতে সব সময় আদর যত্ন পেয়ে অভ্যস্ত, এমন সিচ্যুয়েশনে পড়তে হবে কখনো কস্মিনকালেও হয়তো ভাবেনি। এবার আমার দিকে তাকিয়ে হিসহিসে গলায় বললো – এই অপমানের প্রতিশোধ আমি নেবোই। লাবনী আমরা যদি আজ ফিরে যাই তাহলে ঐ বাড়ির দরজা তোমার জন্য চিরদিনের মতো বন্ধ হয়ে যাবে।
এবার বাবা গর্জে উঠলেন– আমার মেয়ের সাথে এভাবে কথা বলার সাহস হয় কি করে তোমার নাফিস ? কি ভেবেছিলে গাছেরও খাবে তলারও কুড়াবে ? আমি তোমার সমস্ত প্ল্যান খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছি। সরকারী চাকরি ছেড়ে দিয়ে আমেরিকায় যেয়ে সেটেল হতে চাও তাইতো? যাও তোমার যেখানে খুশি যাও তবে আমার মেয়ে তোমাদের ওই বাড়িতে আর কোনোদিন ফিরে যাবে না এটাই ফাইনাল।
নাফিস আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টি হেনে বললো- তাহলে এটাই তোমারও শেষ কথা ? ফিরতে চাওনা আর বাসায় ?
আমি ভাবলেশহীন হয়ে ওর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ভাবলাম এই লোকটা, যে দিনের পর দিন বউ বাচ্চার কোনো খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি, যার সাথে সাথে মানসিক বা শারীরিক ভাবে কোনো স্থায়ী সম্পর্ক আজ পর্যন্ত স্থাপিত হয়নি। নেশা করে যখন বুঁদ হয়ে থাকতো তখন শুধুই শারীরিক ক্ষিদে মেটানোর জন্য আমাকে প্রয়োজন হতো। ইদানিং অবশ্য সে প্রয়োজনটাও ফুরিয়েছে। ইচ্ছে করছিলো চিৎকার করে সবার সামনে এ কথাগুলো বলি। কিন্তু তখন নিজের ওপরই নিজের ঘেন্না হচ্ছিলো।
নাফিস আবার চিৎকার করে বললো– তাহলে এটাই ফাইনাল? তুমি কোনোদিন আর ওই বাড়িতে ফিরতে চাওনা? তবে এ কথা মনে রেখো, তোমার ছেলেকে কোনোদিন আমি আমার ছেলে হিসেবে স্বীকৃতি দেবো না। একটা কানা কড়িও দাবী করতে পারবে না ওর জন্য কোনোদিন।
বাবা আর সহ্য করতে পারলেন না , বললেন– স্টপ ইট নাফিস। আমার সাথে টাকার বড়াই করতে এসো না তুমি। আমার মেয়ের জন্য একটা ফুটো পয়সা খরচ করতে হয়নি তোমার। আশা করি নাতির খরচও আমি যতদিন বেঁচে আছি কাউকে দিতে হবে না। আর একটা কথাও বলবে না। তুমি তোমার মাকে নিয়ে সসম্মানে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও। তোমাদের ভাগ্য ভালো আমার মেয়ে তোমাদের পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা দিতে রাজী হয়নি। তানাহলে পুরো পরিবারকে জেলে পাঠাতাম।
বাবা কথাগুলো এতো বোল্ডলি বললেন, আমি নিজেই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। নাফিস আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। ওর মায়ের হাত ধরে টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
যেতে যেতে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে আমাকে শাসিয়ে গেলো, তোমাকে আমি ছেড়ে দেবো ভেবেছো? এতো সহজে তোমার নিস্তার নেই আমার হাত থেকে।
শ্বাশুড়ি আবার ফিরে আসলেন, এবার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমার বংশের বাত্তি আপনি কিভাবে এই বাড়িতে আটকে রাখবেন আমিও দেখবো। দরকার হলে কোর্টে যাবো।
বাবা বললেন– যান যান আল্লাহর ওয়াস্তে আর মুখ খোলাবেন না আমার। হাত জোড় করে মিনতি করছি আপনারা দয়া করে এখন আসুন।
নাফিস ওর মাকে হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে বের হয়ে গেলো। তবে যাওয়ার আগে আবারও আমার দিকে অগ্নি দৃষ্টি হেনে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।
লোকটার সাথে পাঁচটা বছর কাটিয়েছি আমি। শুধুই সমাজ কি বলবে ভেবেছি. ভেবেছি আমার বাবা মায়ের মাথা হেট হবে। কখনো ভাবিনি আমি নিজেকে নিজেই এ্যাবিউজ হতে দিয়েছি। আমি যদি জানতাম বাবা মা এভাবে আমাকে সাপোর্ট করবে তাহলে হয়তো বিয়ের পরদিনই ওই বাড়ি ছেড়ে চলে আসতাম।
এই ঘটনার পরের দিন আমার শ্বশুর এসে বাবা মায়ের হাত ধরে মাফ চেয়ে আমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছেন ওই বাড়িতে। বাবা মা রাজী হননি।
বাবা বলেছেন– শুধু আপনাকে দেখে ভেবেছিলাম আপনার বাড়ির আর সবাই বোধহয় আপনার মতোই বোধ সম্পন্ন মানুষ। মানুষ চিনতে আমার অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে মোর্শেদ সাহেব। আপনার সঙ্গে বন্ধুত্বটা আর রাখা গেলো না। এ বাড়িতে আসতে আপনাকে বারন করতে পারি না, কারণ আপনার নাতি রয়েছে এখন। যদিও আপানার ছেলে বাচ্চাটাকে কোনোদিন স্বীকৃতি দেবে না বলেছে। আমরা আর কিছুই চাই না আপনার পরিবারের কাছে এ কথা আপনার ছেলেকে বলে দেবেন। মেয়ের জীবনটা হাতে ধরে নষ্ট করে দিলাম, যতোদিন বেঁচে থাকবো এই আফসোস নিয়ে বাঁচতে হবে আমাকে। বাবার চোখ দুটো ছল ছল করে উঠলো।
বললাম– আফসোস কেন করো বাবা। এটা আমার ভাগ্য। ভাগ্যে থাকলে কেউ আটকাতে পারে না। আমার শ্বশুর আমার মাথায় একটা হাত ছুঁইয়ে বেরিয়ে গেলেন।
এরপর ছয়মাস কেটে গেলো ওই বাড়ির কেউ বাচ্চাটারও খোঁজ নেয়নি। এরমাঝে আমি কয়েক জায়গায় সিভি ড্রপ করেছি, ইন্টারভিউ দিয়েছি। কিন্তু ছয়মাস চেষ্টা করার পর একটা ব্যাংকে জুনিয়র অফিসার হিসেবে চাকরি হলো আমার। কি যে আনন্দ হয়েছিলো সেদিন। নিজেকে বাবা মায়ের ওপর আর বার্ডেন মনে হবে না এখন থেকে। বাচ্চার খরচটা নিজে বহন করতে পারবো। ভেবেছিলাম বাবা আপত্তি করবেন কিন্তু বাবাই খুশি হলেন বেশি। বললেন- খুব ভালো খবর, আমি কতোদিন তোমার মাথার ওপর থাকবো জানি না। তোমার বাচ্চাটাকে তোমাকেই মানুষ করতে হবে। ফাইন্যান্সিয়ালী স্ট্রং না হলে একটা মেয়ের পক্ষে এ সমাজে টিকে থাকা খুবই মুশকিল।
ওই মুহূর্তে মনে হয়েছিলো পৃথিবীতে দেখা সবচেয়ে ভালো মানুষ আমার বাবা। বাবার ধারণা আমাকে তাঁর ইচ্ছেতে বিয়ে দিয়ে বাবা একটা বড় পাপ করেছেন। যার প্রায়শ্চিত্ত তিনি এই পৃথিবীতেই করে যেতে চান।
মায়ের হাতে বাচ্চার সমস্ত দায়িত্ব দিয়ে অফিস যাওয়া শুরু করলাম নিশ্চিন্তে। মা ওর নাম রেখেছে শুভ্র। ও যদিও মায়ের কাছেই বেশির ভাগ সময় কাটায়। শুধু রাতে ঘুমানোর সময় আমার বিছানায় নিয়ে আসি। বাবা-মা দুজনই হাই প্রেশারের রোগী। শুভ্রকে টেক কেয়ার করতে যেয়ে কোনোভাবে যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন, নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না কোনও দিন।
অফিসে জয়েন করেছি। পরিবেশটাও একেবারে খারাপ নয়। মাস খানেক সব কিছু ভালোই চলছিলো। একদিন অফিস ছুটি হবার ঠিক আগে আগে ম্যানেজারের রুমে ডাক পড়লো। একজন অফিস সহকারী এসে বললো- ম্যাডাম আপনার একজন গেস্ট এসেছে।
মনে মনে একটু অবাক হলাম। আমি এ অফিসে আছি পরিচিত কাউকেই জানাইনি। তবে ম্যানেজারের রুমে ঢুকে বিস্ময়ে হতবাক আমি।
চলবে…