সাবরিনা নিপু: ম্যানেজারের রুমে ঢুকতেই অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখলাম সোফায় বসে আছে নাফিস।
ম্যানেজারের ডাকে সম্বিত ফিরলো আমার… আসুন মিস লুবনা উনি নিজেকে আপনার স্বামী পরিচয় দিয়ে ভেতরে ঢুকেছেন।
নাফিস বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ম্যানেজারকে উদ্দেশ্য করে বললো – স্বামী পরিচয় দিয়ে ঢুকেছি মানে? আমি মিস লুবনার হাসব্যান্ড কিনা সেটা ওকেই জিজ্ঞেস করুন না !
আমি শুধু মৃদু স্বরে বললাম – আই অ্যাম এক্সট্রিমলি স্যরি স্যার। আধ ঘণ্টার জন্য বাইরে যাবার অনুমতি চাইছি স্যার।
নাফিস বললো- নো। আমিতো তোমার সাথে একান্তে সময় কাটাতে আসিনি। আমি ম্যানেজারকে জানাতে এসেছি তুমি মিথ্যা তথ্য দিয়ে এ চাকরিটা নিয়েছো। তুমি যে বিবাহিতা এবং তোমার ছয়মাস বয়সী একটা ছেলেও আছে, এ কথা অফিসের কেউ জানে না। আমি কি মিথ্যে বলছি? বলো !
কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম ম্যানেজারের সামনে। চাকরি পাওয়া নিয়ে ভয় ছিলো আমার। বিবাহিতা এবং ছোট বাচ্চা আছে শুনে অনেক জায়গায় চাকরি হতে হতেও হয়নি। তাই এটুকু মিথ্যার আশ্রয় আমাকে নিতে হয়েছে। কিন্তু নাফিস এসব কথা জানলো কিভাবে?
নাফিস একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো, কি মনে মনে ভাবছো আমি এতোসব কিভাবে জানলাম তাইতো? এই ব্যাংকের একজন ডাইরেক্টর আমার বন্ধু। ওর কাছ থেকেই জেনেছি সব। তুমি আমার মতো একজন গভর্নমেন্ট অফিসারের ওয়াইফ হয়ে চাকরি করবে এটাতো আমি মেনে নিতে পারি না। তোমার বাবা খুবতো বড়াই করে আমার স্ত্রী সন্তানকে আটকে রেখেছে তার বাড়িতে। এখন মেয়েকে আবার চাকরি করতে পাঠিয়েছে। আমি কি গত পাঁচ বছরে তোমাকে চাকরি করার জন্য কোনোভাবে ইনসিস্ট করেছি? করিনি। কারণ, কোনো সরকারী কর্মকর্তাই তাদের স্ত্রীদের এসব সাধারণ চাকরি করতে পাঠায় না। তুমি তোমার বাবার একমাত্র আদরের মেয়ে, তোমার গায়ে একটা মশা বসলেও তোমার বাবা-মা কষ্ট পান, সেই মেয়েকে চাকরি করতে পাঠিয়েছেন ? মেয়ে আর নাতির খরচ চালাতে হিম শিম খাচ্ছেন নাকি ভদ্রলোক? শুনলাম, তোমার বাবার ব্যবসাতেও বেশ মন্দা চলছে। তাই মেয়েকে দিয়ে…
এবার আর সহ্য করতে পারলাম না স্থান কাল পাত্র ভুলে গিয়ে ওর গালে কষে একটা চড় মেরে বসলাম। বললাম- ডোন্ট ইউ ডেয়ার নাফিস! এখানে হয়তো আর আমার চাকরি করা হবে না। কিন্তু চাকরি আমি করবোই। তোমার যা ইচ্ছে হয় তুমি করতে পারো করো। ও হঠাৎ করে চড় খেয়ে হতভম্ব হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। ম্যানেজারের দিকে হাত জোড় করে বেরিয়ে এলাম ওই রুম থেকে। ডেস্ক থেকে ব্যাগটা নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে চলে গেলাম পার্কিং লটে।
বাবা মাকে এ ব্যাপারে কিছুই জানাবো না সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাকে নিয়ে এমনিতেই এতো স্ট্রেসে থাকেন ওরা সারাক্ষণ। এই ঘটনার কথা জানাজানি হলে তাঁরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়বেন। আমাকে হয়তো বাড়ি থেকে আর বেরোতে দিতেই চাইবেন না। বাসায় ফিরে দেখলাম মা শুভ্রকে নিয়ে ছোট খালার বাসায় বেড়াতে গেছেন। বাবাও বাসায় নেই। খুব স্বস্তি নিয়ে শাওয়ারে ঢুকলাম। অনেকক্ষণ ধরে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে রইলাম। মাথাটা প্রচণ্ড গরম হয়ে গিয়েছিল ম্যানেজারের রুমে নাফিসকে দেখে। স্কাউন্ড্রেলটাকে কষিয়ে একটা চড় মারতে পেরেছি আজ খুব ভালো লাগছে। যদিও অফিসের ভেতর এই কাজ করাটা খুবই অশোভন হয়েছে। কিন্তু আমি যেন আজ আমার আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছি। কাল থেকে নতুন উদ্যমে আবার নতুন চাকরি খোঁজা শুরু করতে হবে। এ নিয়ে কোনো মন খারাপ নেই আমার। বরং এখন জানতে পেরে ভালো হয়েছে যে নাফিসের বন্ধু এই ব্যাংকের ডাইরেক্টর। অন্য কোনো কারণ দেখিয়ে ওরা যদি চাকরি থেকে স্যাক করে দিতো তাহলে আরেকটা চাকরি পেতে খুব সমস্যা হতো।
শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে ব্ল্যাক কফিতে চুমুক দিতে দিতে রেজিগনেশন লেটারটা লিখে মেইল করে দিলাম অফিসের ইমেইল এ।
সকালে কোমল একটা হাতের ছোঁয়ায় ঘুম ভাঙলো। দেখলাম শুভ্র ঘুম থেকে উঠে একা একা হাত পা ছুঁড়ে খেলছে আর মুখ দিয়ে আওয়াজ করছে। হাত ছোঁড়ার সময় একটা হাত আমার গালে এসে লাগছিলো বার বার। এর মাঝেই মা এসে ঢুকলেন ঘরে। এই সকাল বেলা বিছানায় গুটি শুটি হয়ে পড়ে থাকতে দেখে বললেন – কিরে তোর অফিস নেই আজ?
খুব আলসেমী ধরা গলায় বললাম – কয়েকটা দিন ছুটি নিয়েছি। নাস্তার টেবিলে বাবাও একই কথা জানতে চাইলেন। বাবাকেও বললাম একই কথা। বাবা বললেন – শরীর ঠিক আছে তোমার ?
বললাম – ঠিক আছি বাবা। আমাকে নিয়ে এতো টেনশান করো কেন সব সময়?
বাবা কিছু বলতেই যাচ্ছিলেন, এর ভেতর বাবার সেলফোন বেজে উঠলো। দেখলাম, সেদিকে তাকিয়ে কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো। তাঁর মুখ দেখে মনে হলো এ সময় এই ফোনটা পেয়ে মোটেও খুশি হননি তিনি। নাফিস নয়তো ? তাহলেতো এখনই সব জেনে যাবেন বাবা মা। আমি তাকিয়ে রইলাম বাবার দিকে। তিনি ফোনটা রিসিভ করলেন
- কি ব্যাপার মোর্শেদ, হঠাৎ কি মনে করে?
ওদিক থেকে কি বলছেন নাফিসের বাবা, না শুনতে পেলেও কিছুটা আন্দাজ করতে পারছিলাম। কারণ বাবা কথা বলতে বলতে বার বার আমার মুখের দিকে তাকাচ্ছিলেন। তা দেখেই বেশ বোঝা যাচ্ছিলো তাঁদের ভেতর কি কথা হচ্ছে !
এরপর ফোনটা আমার হাতে দিয়ে বললেন,- নাও, কথা বলো।
আমি হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে নাফিসের বাবা বলে উঠলেন ,- তোমার কি চাকরি না করলেই নয়? আমি কিন্তু তোমার চাকরি করাটা খুব ভালো ভাবে নিতে পারলাম না। ছোট একটা দুধের বাচ্চা রেখে তোমার বাবা মা-ই বা কিভাবে চাকরি করতে অ্যালাও করলো সেটাও বুঝতে পারলাম না। তোমার বাবার কি টাকার অভাব? তোমাকে চাকরি করে বাচ্চা পালতে হবে কেন তাইতো বুঝতে পারছি না । তার ওপর সিভিতে লিখেছো তুমি সিঙ্গেল। তোমার বাবাকে এসব জিজ্ঞেস করতেই ফোনটা তোমাকে ধরিয়ে দিলো।
তোমার অফিসে আজ যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে এটা কি কখনো ঘটতো? তুমিতো জানো নাফিস কতো বড় সরকারী কর্মকর্তা। ওকে অনেক কিছু মেইনটেন করে চলতে হয়। তবে তুমি অতো মাথা গরম না করলেও পারতে। একবার ওর মান সম্মানের কথা ভাবতে পারতে ।
ওনার এমন সামঞ্জস্যহীন কথাগুলো আর নিতে পারছিলাম না। বুঝলাম ছেলের চড় খাওয়ার অপমানটা হজম করতে পারেননি। এদিকে বাবা মা দুজনই অনেকক্ষণ ধরে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। ওপাশ থেকে কি কথা বলছে উনি, হয়তো আন্দাজ করতে পারছেন তাঁরা। আমি আর সহ্য করতে না পেরে একটু রুক্ষ স্বরেই বললাম…
- আপনার কথা শেষ হলে এবার আমি কিছু কথা বলতে চাই। ওপাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না।
আমি আপনার সব প্রশ্নের উত্তর একটা একটা করে দিচ্ছি। আমার চাকরি করায় আপনাদের এতো আপত্তি? অথচ এই বিদুষী মেয়েটাকে ছেলের বউ করার জন্য সেই তখন থেকে উৎসাহী ছিলেন যখন আমি এসএসসিতে সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম হয়েছিলাম। আপনি সেদিন একটা পেন্ডেন্ট গিফট করেছিলেন আমাকে সেটা এখনো আমি খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছি। আপনি এই সেদিনও অনার্স ফাইনালে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়ার পর আপনি বাবাকে বলেছিলেন লুবনাকে বলো বিসিএস দিতে। বেশ ভালো জায়গায় যেতে পারবে ও। আজ হয়তো এ কথাগুলো আপনি বিস্মৃত হয়েছেন। কারণ, আপনি জানেন আপনার ছেলের চেয়েও অনেক বেশি ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট আমার। এজন্য আপনার ছেলে বা আপনি কেউই কখনও চাননি আমি চাকরি করি। এতে আপনাদের ইগো হার্ট হয়। কিন্তু আমার বাবাকে দিনের পর দিন মিথ্যে কথা বলেছেন আপনি। সব কিছু জেনে বুঝে একজন অ্যাডিক্টেড অ্যান্ড পার্ভারটেড ছেলের বউ হিসেবে বলি দেয়ার জন্য প্রিয় বন্ধুর মেয়েটিকেই বেছে নিয়েছিলেন তাইতো?
- এসব কি কথা? এ কোন ভাষায় কথা বলছো তুমি আমার সাথে ?
- আপনি যে ভাষায় কথা বলছেন ঠিক সে ভাষাতেই জবাব দেয়ার চেষ্টা করছি। তবে এই ভাষাটা আমার আরো আগেই রপ্ত করা উচিৎ ছিল তাহলে এই পাঁচটা বছর নষ্ট হতো না। পরিবারের সম্মানের কথা ভেবেছি সব সময়। কিন্তু তাতে যা ক্ষতি হবার আমারই হয়েছে। অন্য কারো কিছু হয়নি। সত্যি কথা আমার বাবার টাকার দিকেই আপনাদের নজর ছিল এ কথাটাও বুঝতে আমার অনেক সময় লেগেছে। কারণ যে যেমন সে অন্যকেও তার মতো করেই ভাবে। আমার বা আমার বাবা মায়ের মনে ঘুণাক্ষরেও এই প্রশ্ন জাগেনি , এতো কাছের একজন মানুষ, যে সকাল বিকেল আমাদের বাড়িতে আসা যাওয়া করে সেই মানুষটার বাড়িতে আমার অযত্ন বা অবহেলা হবে।
যাই হোক , আমি এটা আমার ভাগ্য বলেই মেনে নিয়েছি।
আমি চাকরি কেন করছি বা করবো এ ব্যাপারে কাউকে আমি জবাবদিহি করতে বাধ্য নই।
ওপাশ থেকে অন্য আর কারো গলার আওয়াজ পেলাম বলে মনে হলো। কয়েক সেকেন্ড কোনো শব্দ শোনা গেলো না। হ্যালো হ্যালো করে ফোনটা কাটতেই যাচ্ছিলাম কিন্তু তার আগেই একটা হিসহিসে গলায় কেউ বলে উঠলো … ইউ বিচ !
চলবে…