শে খ শা হ্ ন ও য়া জ, টরন্টো
উনিশশো পঁচানব্বই সালে মার্চ মাসের শেষে এক বিকালে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ক্যাগরিতে ইমিগ্রান্ট হয়ে বড় ছেলে ও তার মায়ের হাত ধরে টরন্টো পিয়ারসন এয়ারপোর্টে হাজির হই। এয়ারপোর্টে আমাদের নিতে এসেছিলেন আমার পুরানো বন্ধু মইনুল ইসলাম খান নীরু ও পূর্ব পরিচিত আলম মোড়ল। আলম সাহেবের স্টেশন ওয়াগনে চড়ে অস্থায়ীভাবে উঠি নীরু খানের বাসায়। বাসাটি স্কারবরো মনিং সাইডে অবস্থিত একটি সরকারি বহুতলা বিশিষ্ট ভবনের এপার্র্টমেন্ট।
আলম মোড়লে সাথে আমার পরিচয় বেশিদিনের নয়। টরোন্টতে বাঙ্গালিদের আদর্শগত দ্বন্ধে বিভক্ত দুটি সংগঠনের একটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। কোন কাজে একবার তিনি নিউ ইয়র্কের ঠিকানা অফিসে গিয়েছিলেন। আমি তখন ঠিকানায় কাজ করি। সেখানেই প্রথম দেখা।
নীরু খানের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়-সত্তর দশকের শেষ দিকে তখনকার পশ্চিম জার্মানিতে। সেই সময় আমিও অনেক শিক্ষিত যুবকের মত ভাগ্যান্বেষণে বিদেশে পাড়ি জমিয়ে ছিলাম। নীরু খান যান আমার কিছু পরে। দেশে তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্রাকের সাথে যুক্ত ছিলেন। ব্রাক প্রতিষ্ঠার শুরুতেই ফজলে হোসেন আবেদ একদল সৎ, শিক্ষিত ও কর্মোদ্যোগী তরুণকে নিয়োগ দেন। নীরু খান ছিলেন তাদের একজন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বাবার বড় পরিবারের খরচ মিটানোর জন্য অধিকতর আয়ের আশায় বিদেশে পাড়ি জমান।
আয়-রোজগার ভালো হলেও পশ্চিম জার্মানিতে বিদেশিরা বেশিদিন থাকতে পারেননি। আশির দশকের গোঁড়ায় বেশির ভাগ আশ্রয় প্রার্থীকে সেদেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়। বাংলাদেশীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তখন দেশে ফেরত না গিয়ে উত্তর আমেরিকা চলে আসেন। একটি বড় অংশ আসেন কানাডায়। অনেকের মত আমার বন্ধু নীরু খান মন্ট্রিয়ল হয়ে পরে টরন্টোতে স্থায়ী হয়েছিলেন। যদিও এখন তিনি সপরিবারে স্থায়ীভাবে ফ্লোরিডায় বাস করছেন।
আশির দশকে বৃহত্তর টরন্টো এলাকায় সাকুল্যে হাজার দশেক বাঙ্গালির বাস ছিল। এদের মধ্যে মুষ্টিমেয় কিছু পেশাজীবি। তারা সেই পাকিস্তানী আমল থেকে উচ্চতর শিক্ষা-গবেষণার জন্য এসেছিলেন। পরে থেকে গিয়েছিলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাদবাকীরা বিভিন্ন উপায়ে উন্নত জীবন ধারণের আশায় চলে এসেছেন। সবাই প্রায় একাকী। কয়েকজন মিলে এক বাসায় থাকা। এই মানুষগুলো কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজের খরচ মিটিয়ে দেশে পরিবার পরিজনকে আর্থিক যোগান দিয়েছেন। বাংলাদেশের বাইরে বিভিন্ন দেশ থেকে এই শ্রেণীর মানুষের প্রেরিত অর্থ তাদের পরিবার তথা দেশের ব্যাপক উন্নতি ঘটিয়েছে। পেশাজীবীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রবাসীদের এড়িয়ে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত বাস করতেন। তাদের দেখা মিলত কোন পালা পার্বন, অথবা সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদির শোভা বর্ধনে।
নীরু খান ও তার বন্ধুরা ঠিক করলেন, শহরে নবাগত হিসাবে আমার বাসা নেওয়া উচিত ভিক্টোরিয়া পার্ক সাবওয়ে সংলগ্ন ক্রিসেন্ট টাউনে। যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই উত্তম। টরন্টোর যে কোন প্রান্তে সহজে এখান থেকে বাসে বা ট্রেনে যাওয়া যায়। ক্রিসেন্ট টাউন একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ জায়গা। তখন সবকিছুই ছিল। গ্রোসারী, ব্যাংক, রেস্তোরা, ড্রাই ক্লিনার্স, ডাক্তার, ফার্মেসী, কনভেনিয়ন ষ্টোর সবকিছুই। বাসা পাওয়া সহজ সাধ্য ছিল না। এ ব্যাপারে সাহায্য করেছিলেন টরান্টো প্রবাসী কবি ইকবাল হাসান। ক্রিসেন্ট টাউনে বাসা থাকার একটা সুবিধা হলÑ এখানে নিজের গাড়ি না হলেও চলে। এ কারণে তেইশ বছর বাস করার পরেও আজও আমার গাড়ি নেই, তার জন্য খেদও নেই। পাঁচ মিনিটের হ্যাঁ পথে ড্যনফোর্থ এভেনিউ। মাঝপথে ডেন্টোনিয়া পার্ক। সব ধরনের খেলাধুলার ব্যবস্থা আছে এখানে। বছরে কয়েকটা মেলা তো হয়ই। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খোলা মাঠে ঈদের জামাত হয়Ñ এবারের ঈদুল ফিতরের জামাতে পাঁচ সহস্রাত্বিক লোকের সমাগম হয়েছিল।
বিশ পঁচিশ বছর আগে ড্যান ফোর্থে বাঙ্গালিদের অবস্থা আজকের মত মোটেই ছিল না। আজকের লোজের জায়গায় একটা বড়সড় জেলার্স ছিল। বাইরের পর্ব দিকে অনেকটা জায়গাজুড়ে ছিল ছোঁ ছোঁ দোকান আর কফি শপ- পুরো এলাকা জুড়ে ছিলা একটা গরিবনা ভাব। তখন কাজ পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। যাদের কাজ ছিল-তারা ছিলেন বেশির ভাগ ডিস ওয়াসার, কিচেন হেল্পার ও বাস বয়। কুক বা ওয়েটারের কাজ করতেন সীমিত সংখ্যক মানুষ। দু’চারজন কারখানায় কাজ করতেন। কিছু লোক ট্যাক্সী চালাতেন। আমার জানামতে ট্যাক্সীর মালিক ছিলেন না কেউ। বেশির ভাগ মানুষ সামাজিক আর্থিক নিরাপত্তা বলয়ে এর মধ্যে ছিলেন। আমার জানাশুনা কয়েকজনের পুরানো গাড়ি ছিল। বাড়ি ছিল না কারোর। সকাল সন্ধ্যা ডানফোর্থে আড্ডা আর এ বাড়ি ও বাড়ি দাওয়াত খাওয়া ছিল সকলের মোটামুটি নৈমিত্তিক কাজ।
আর বাঙ্গালিদের ব্যবসায়? সবেধন নীলমণি- বাংলাবাজার নামে ডানফোর্থে একটা গ্রোসারী ছিল। ভিন্ন নামে পরে এটি অনেকদিন ব্যবসা করেছে। আল আমিন নামে আর একটি গ্রোসারী অল্প কিছুদিন ব্যবসা করে সম্ভবত সবার আগে স্বদেশ নামে জেরাড মার্কেটে একটি গ্রোসারী ব্যবসা শুরু করে পরে বন্ধ হয়ে যায়। হিমেল চৌধুরী নামে শুধু একজন বাঙ্গালি বাড়ি বেচা কেনা করতেন। এখানকার বঙ্গালী মুসলমানের খাওয়া দাওয়ার ক্ষেত্রে “হালাল” শব্দটি তখনও ব্যাপকতা পায়নি। বাঙ্গালির নিজস্ব কোন মসজিদ-মন্দির ছিল না সেই সময়ে। “দেশে বিদেশে’ নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশিত হতো এখান থেকে। পরে পত্রিকাটি সাপ্তাহিক হয়। কিছুদিন চলার পরে বন্ধ হয়ে যায়। আর ছিল একটি কি দুটি টেলি জার্নাল। প্রবাসীরা এইসব মাধ্যমে দেশের খবর পেতেন।
নব্বই দশকের প্রথমার্থে কানাডার অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে ছিল। লিবারেল পার্টির নেতা জন ক্রিশ্চিয়ান খুবই নাজুক অবস্থায় এদেশের হাল ধরেছিলেন। তার নেতৃতেই কানাডা আর্থিক সংকট কাটিয়ে ওঠে। নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে অবস্থাটা বিশ্লেষণ করা যায়। আমি কানাডার ইমিগ্রেশন পাই নিউ ইয়ার্ক থেকে। টরন্টোর যে ভদ্রলোক আমাকে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেছিলেন-তাকে স্বাভাবিকভাবে এ দেশের আসার প্রাক্কালে জিজ্ঞাসা করেছিলাম- কাজের সুযোগ পাওয়া যাবে তো? তিনি এ ব্যাপারে আমাকে মোটেই আস্বস্ত করতে পারলেন না। পরে তাকে বললাম- ভাই একটা অড জবও পাওয়া যাবে না! তিনি উত্তরে বললেন, ভাগ্য ভালো হলে পেতে পারেন। আমি তো অনেক খানি হতাশ। কেননা নিয় ইয়ার্কে খবরের কাগজে কাজ ছাড়াও অন্যান্য জায়গায় মোটামুটি ভাল কাজ করেছি। আর এখানে যেমন তেমন কাজও মিলবে না।
ভাগ্যগুণে কিনা জানিনা, তবে টরন্টো আসার মাস দুয়েকের মধ্যে আমার একটা কাজ হয়ে যায়- ডাউন টাউনে অবস্থিত কানাডার সবচাইতে বড় সুইজারল্যান্ডের মুভেনপিক মার্সে রেস্তরায়। কাজ পেতে সাহায্য করেছিলেন নীরু খানের খুবই ঘনিষ্ঠজন নজরুল ইসলাম নান্নু। তিনি এখানে আরও অনেককে কাজ পেতে সাহায্য করেছেন। আমি এখনে কাজ করি বারো বছর। বছর চারেক মার্কেটিয়ার, অন্য কথায় কুক হিসাবে। বাদ বাকী সময় মার্কেট ম্যানেজার। এখানে ম্যানেজার হিসাবে কাজ করেছেন আনিসুর সেলিম, ফরিদা হক ও জামাল হোসেন। জামাল হোসেন পরে যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে পরে এই প্রতিষ্ঠানের অন্য একটি শাখার জেনারেল ম্যানেজার হয়ে ছিলেন। কত নবাগত শিক্ষিত বাঙ্গালির যে এখানে প্রাথমিক কর্মসংস্থান হয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না। মুভেনপিকে অর্জিত অভিজ্ঞতা পরে অনেকেই সার্থকভাবে কাজে লাগিয়েছেন। আনিসুর সেলিম এখন একাধিক সুইজ শ্যালের মালিক। জামাল-ফরিদা দম্পতি বাড়ি বেচা কেনা ও নির্মাণের ব্যাবসা করে এখন অনেক বিত্তের অধিকারী হয়েছেন। বাঙ্গালি কমিউনিটির বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডেও তারা জড়িত।
স্বাভাবিকভাবে বাঙ্গালিরা যেখানে যাবেন বিভিন্ন রকমের সংগঠন যেখানে থাকবে। আর থাকবে দলাদলি-বিভক্তি। টরন্টোতে বাঙ্গালিদের প্রথম সংগঠন-বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অবশ্য গঠিত হয়েছিল জাতির সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সময়। একাত্তর সাথে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে কয়েকজন দেশপ্রেমিক, সাহসী মানুষ এই সংগঠনের ব্যানারে এখানে আমাদের ন্যায় সংগত যুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন। স্বাধীনতা লাভের পরে এর গুরুত্ব অনেকখানি হারিয়ে যায়। এর কার্যকারিতা মূলত বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিবস পালনে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। আর বাংলাদেশ কখনো বন্যা, দুর্ভিক্ষ হলে এই সংগঠনের মাধ্যমে সাহায্য করা হয। শুধু টরন্টো নয়- বাংলাদেশের বাইরে সর্বত্র বাঙ্গালিদের সংগঠনসমূহের চিত্র প্রায় একই।
টরন্টো বাংলাদেশ এসোসিয়েশন একসময় আদর্শিক কারণে ভাগ হয়ে যায়। এক দিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে সেকুলার কিছু মানুষ। যদিও তাদের মধ্যে আগেকার উৎসাহ পরিলক্ষিত হয় না। চোখে পড়ার মত কোন কর্মসূচী তারা নেননি বর্তমানে এই ধারাটির। কোন অস্তিত্ব অবশিষ্ট নেই। পাশাপাশি অন্য ধারাটি বেশ চাংগা হয়ে ওঠে। বাঙ্গালিদের মধ্যে পাকিস্তানী মনোভাব সম্পন্ন, বিএনপি-জামায়াত রাজনীতির সমর্থকরা এই সংগঠনে জড় হন। তারা ছিলেন খুবই তৎপর। এমন একটা আবহাওয়া তৈরি হয়েছিল যে, কেউ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী, আওয়ামী রাজনীতির সমর্থক হলে তাকে যে কোন পরিবারিক বা সামাজিক অনুষ্ঠানে এদের উপস্থিতিতে বিব্রত হতে হতো। যারা সরাসরি আওয়ামী লীগ করতেন তাদের অবস্থা ছিল সত্যি করুণ। তারা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, অপমানের শিকার হয়েছেন প্রচুর। যাইহোক, বাংলাদেশী এসোসিয়েশনগুলোর প্রয়োজন একসময় ফুরিয়ে যায়। কেন ফুরিয়ে গেলÑ বিষয়টি পরে ব্যাখ্যা করা হবে।
কোন পদ পদবীতে না হলেও টরন্টোতে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিরোধী শক্তির মুল নেতা ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী, একাত্তরে মানবতা বিরোধী অপরাধে দন্ডিত এক ব্যক্তির পুত্র। তখনকার দিনে এই লোকের কি আস্ফালন। কোন অনুষ্ঠানে কেউ বঙ্গবন্ধু বা মুক্তিযুদ্ধ উচ্চারণ করলে তিনি তেড়ে মারতে উদ্যত হতেন। অনেকবার এমন ঘটেছে। বিস্ময়ের ব্যপার হল, তার পিছনে মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিরোধী শক্তি ছিল ঐক্যবদ্ধ। পক্ষের দাবীদাররা তখনও ছিল বরাবরের মত বুহুধা বিভক্ত।
নীরু খানের সংগে সত্তর দশকে সেই যে পশ্চিম জার্মানিতে দেখা হয়েছিল- তারপর থেকে আজও আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক টিকে আছে। এক সময় আমি আমেরিকা হয়ে বাংলাদেশে ফিরে যাই, আর তিনি আবারও ভাগ্যান্বেষণে কানাডায় পাড়ি জমান। আশির দশকের পরটা আমার বাংলাদেশে কাটে। নীরু খান খবর পেয়েছিলেন, দেশে আমার সময় ভালো যাচ্ছিল না। স্বপ্রণোদিত হয়ে তিনি আমার জন্য তার জানাশুনা লোকজনকে অনুরোধ করেছিলেন- যাতে আমার কাজের একটা সুরাহা হয়।
ছাত্রজীবনে নীরু খান ছিলেন বাংলদেশ ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী। টরন্টো এসে আমি লক্ষ্য করলাম, তার সামাজিকতা সব বিএনপি-জামায়াত ঘরানার অনেকের সংগে। রাজনীতি বাদ দিলে এরা সবাই স্বজন মানুষ। আমার বিবেচনায় টরোন্ট প্রবাসী আওয়ামী ঘরানার অনেকের নৈতিক ভ্রষ্ঠতার কারণে নীরু খান এই বলয়ের বাইরে ছিলেন। আওয়ামী লীগ পন্থীরা তখন এতই দল-উপদলে বিভক্ত ছিলেন যে, একবার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী-তখনকার বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনা টরন্টো ভ্রমণে এলে তার দেখভালের দায়িত্ব বিএনপি পন্থীদের নিতে হয়েছিল।
যা হোক, বন্ধু নীরু খানের কারণে টরন্টো এসে আওয়ামী বিরোধী শিবিরের লোকদের সঙ্গে আমার এক ধরনের সম্পর্ক হয়। অচিরেই তারা বুঝতে পারেন- আমি তাদের মতের লোক নই। ফলে একসময় তাদের সাথে আমার দূরত্ব বাড়তে থাকে। কিন্তু এরা ছেড়ে দেবার পাত্র নন। একবার এরা দলবদ্ধ হয়ে তখনকার জমজম পিজা রেস্তরাঁয় আমাকে হেনস্থা করতে উদ্যত হয়েছিলেন। অনেক শুভাকাক্সক্ষী তখন আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এই সুযোগে আমি তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা জানাই।
পঁচানব্বই সালের পর থেকে টরান্টো তথা কানাডায় প্রবাসী বাঙ্গালিদের অবস্থানের দ্রুত পবিরবর্তন ঘটতে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত বাঙ্গালিরা ব্যাপকহারে ইমিগ্রেশন নিয়ে এখানে আসতে থাকেন। দেশে নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় এবং ছেলে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করতে এরা কানাডা প্রবাসী হন। এক মাত্র টরোন্টতে এ পর্যন্ত কয়েশত বাঙ্গালি প্রকৌশলী এসেছেন। সংখ্যায় অধিক না হলেও বেশ কিছু ডাক্তার। কৃষিবিদ, হিসাব রক্ষক বা অন্যান্য পেশার মানুষজন নেহাত কম নন। এর বাইরে বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ থেকে বিপুল সংখক ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন ক্ষেত্রের পেশাজীবি কানাডায় এসেছেন। ধারণা করা হয়, বৃহত্তর টরন্টোতে বর্তমানে এক লক্ষ বাংলাদেশের বাঙ্গালির বসবাস।
এই বিপুল সংখ্যক বাঙ্গালির আগমনে প্রবাসী বাঙালীর চালচিত্র সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। প্রথম দিককার প্রবাসীরা এসেছিলেন ভাগ্যান্বেষণে না জেনে শুনে। বেশির ভাগ একাকী। কেমন এটা গা ছাড়া ভাব। পরিবারের সদস্যরা পরে এসেছেন। সব ব্যাপারে সিরিয়াসনেসের অভাব। কিন্তু পরের দৃশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। যারা জেনে শুনে এসেছেন-তারা প্রথম থেকেই নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে সচেষ্ট হন। নিজের জন্য মর্যদাপূর্ণ কাজ ছেলে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষা সর্ব ক্ষেত্রেই তারা সক্রিয়।
একটা ব্যাপার লক্ষণীয় হয়ে দাঁড়ায়- সদ্য আগত অভিবাসীরা পেশার ভিত্তিতে দলবদ্ধ হতে থাকেন। প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, আইটি বিশেষজ্ঞ বা অন্যরা নিজস্ব পেশায় লোকদের নিয়ে এসোসিয়েশন গড়ে তোলেন। এমনকি অনেকেতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক ফোরাম তৈরী করেছেন। সব রকম সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকা- এরা করেন নিজেস্ব সংগঠনের ব্যানারে। ফলে, এক সময়কার বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে বা তার অস্তিত এখন নেই বললেও অত্যুক্তি হবে না।
টরন্টো প্রবাসী বাঙ্গালিদের অবস্থা এখন কেমন? ডানফোর্থ – ভিক্টোরিয়া পার্ক তো মিনি বাংলাদেশ। আশপাশ মিলিয়ে এখানে পঁচিশ হাজার বাঙ্গালির বসবাস। ড্যানফোর্থকে বলা যায় শাহবাগ বা মালিবাগ। ইষ্ট ইয়র্কের মেইন ষ্ট্রীট থেকে স্কারবোরো বার্চমাউন্ট পর্যন্ত এখন প্রবাসী বাঙ্গালির কয়েকশ’ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কী নেই এখানে। চুল কাটা থেকে ছবি আঁকা। কোনকিছু বাদ নেই। বাংলাদেশের সামাজিক, আর্থিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সব কর্মকা-ের উপস্থিতি ক্ষুদ্র পরিসরে এই টরোন্ট শহরে। তীব্র শীত উপেক্ষা করে অস্থায়ী শহীদ মিনারে হাজরো বাঙ্গালির উপস্থিতি, ঈদ পূর্ব সারারাত ড্যানফোর্থের ফুটপাতে টেন্ট টানিয়ে মেহেদি লাগানোর দৃশ্য চোখে না দেখলে বিশ্বাস করানো যাবে না।
সম্প্রতি ঘটে গেছে এক অভাবনীয় কান্ড। ডলি বেগম নামের উচ্চ শিক্ষিত এক বাংলাদেশী- ক্যানাডিয়ান তরুণী অন্টারিও প্রাদেশিক আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এই ঘটনা প্রবাসী বাঙ্গালিদের অনেক বেশি আত্মপ্রত্যায়ী করে তুলেছে। অনেক তরুণ-তরুণী ইতোমধ্যে এদেশের মূল ধারার রাজনীতিতে সংযুক্ত হয়েছেন। আশা করা যায়, নিকট ভবিষ্যতে আমার এদেশের সরকার কাঠামো বিভিন্ন স্তরে আরও নির্বাচিত প্রতিনিধি দেখতে পাবো।
এই নিবন্ধটি কোন সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে লেখা হয়নি। আমার দেখা ও অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা এটি টরোন্ট প্রবাসী বাঙ্গালি জীবনের খ-াংশ মাত্র। প্রবাসী বাঙ্গালির কর্মকা-ের উপর বরাবরই আমার একটা কৌতুহল আছে। তারই ফলাফল এই ছোট আকারের চেষ্টা।
লেখক ঃ নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ঠিকানার সাবেক সহকারী সম্পাদক।