-শাকুর মজিদ
ক্লাসের বইয়ের বাইরে ‘আউট বই’ পড়ার নেশা প্রথম কোন লেখক আমার মধ্যে প্রথম ঢুকিয়ে ছিলেন খুব ভালো করে মনে করতে পারি না। তবে জসিম উদ্দিনের লেখা ‘বাঙালীর হাসির গল্প’ বইটি মার বিছানার সিঁথানে থাকতো। সেখান থেকে মা প্রথমে কিছু গল্প পড়ে শোনাতেন। পরে এই বইটার বাকী গল্পগুলোও আমি পড়ে ফেলি। আমার বয়স তখন নয়-দশ। সম্ভবত; এটাই আমার পড়া প্রথম কোনো আউট বই। বইটি আমার কাছে সহজ সরল মনে হতো। আমি পড়তে পড়তে একা একা হাসতাম অনেক। আমার ভালো লেগে যায়।
এরপর আরো কিছু বই পড়ি। আমার গ্রামের স্কুলের সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু খালেদ জাফরীর বাড়িতে আড্ডা দিতে গেলে তার ঘরে অসংখ্য বই দেখি। তার বাবা আকাদ্দাস সিরাজুল ইসলাম একটা টেবিলে বসে সারাদিন লিখেন। তাঁর লেখা অনেকগুলো বইও আছে। মা’র কাছে শুনি তিনি অনেক বড় সাহিত্যিক। আমি তখন প্রথম একজন সাহিত্যিক দেখি।
খালেদের পড়ার খুব নেশা। অনেক অনেক বই তার ঘরে। সে আমাকে বই পড়তে দেয়। আমি তাদের বেতের শেল্ফ্ থেকে বই নিয়ে এসে পড়ে আবার পরে ফেরত দিয়ে দেই। একবার পেলাম দস্যু বনহুর এর বই। এই বইয়ের লেখক রোমেনা আফাজ। এটা সিরিজ। এক সিরিজের গল্প যেখানে শেষ হয়, সেখানে অনেক কৌতুহল রয়ে যায়। পরের বইতে সেই কৌতুহল মেটাতে গিয়ে দেখা যায় খালেদের বাসার শেল্ফে নতুন বই নাই। বাজারের লাইব্রেরিতে আছে। ৪-৫ টাকা দাম। আমরা ভাগাভাগি করে বই কেনা শুরু করি। রোমেনা আফাজে আমার নেশা ধরে যায়।
তবে কি ‘রোমেনা আফাজ’ ছিলেন আমর প্রথম স্বপ্ন? হয়তো ছিলেন কিন্তু বেশিদিন এই স্বপ্ন আমার থাকেনি। কিছুদিনের মধ্যে নিহার রঞ্জন গুপ্তের উপন্যাস আমার ভালো লাগতে শুরু করে। ‘কিরিটি রায়’ যে বইতে থাকেন, সে বইটা আমার প্রিয় হয়ে যায়। এক টানে বই শেষ না করে নাওয়া-খাওয়া-ঘুমানো নাই।
নিহাররঞ্জনের স্বপ্নভঙ্গ হয়ে যায় আরো কিছুদিন পর ‘মাসুদ রানা’কে হাতে পেয়ে। সমান্তরালভাবে আকবর হোসেন, নিমাই ভট্টাচার্য, ফালগুনী মুখোপাধ্যায় এসে পড়েন তালিকায়। স্কুলের বইতে গল্প পড়ি রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের, কিন্তু সরস মনে হতো ফালগুনী-নিমাইকে। আমাদের গ্রামে যে সকল বাড়ির কারো সঙ্গে শহরের যোগাযোগ থাকতো, যিনি রেল ভ্রমণ করতেন, তার বাড়িতে এসব বই পাওয়া যেতো। আমার বাবাও এরকম কিছু বই নিয়ে আসতেন। শোনা যেতো ট্রেনের দীর্ঘ যাত্রায় বই পড়ে সময় কাটাবার জন্য এসব বই তাঁদের কেনা হয়েছিল। সে সময়ের জনপ্রিয় সকল লেখকদের বই-ই বিক্রি হতো রেল স্টেশনের প্লাটফর্মে। প্রায় প্রিিতটি রেল স্টেশনেই একটা বুক স্টোর ছিলো। সেখানে শরৎ-নিমাই-নিহার-ফালগুনীদের বই বিক্রি হতো বেশি। আমার বেড়ে ওঠা তাঁদের বই-ই পড়ে। তারাই আমার স্বপ্নের লেখক হয়ে যান।
কিন্তু এঁরাও সবাই বেশিদিন তাদের আসন আমার কাছে অক্ষত রাখতে পারেন না। আমার যখন ১৬-১৭ বছর বয়স, আমি পড়ি ক্যাডেট কলেজে, আমার হাতে আসেন শংকর। তার যোগ-বিয়োগ-গুণভাগ, চৌরঙ্গী, স¤্রাট ও সুন্দরী, একদিন হঠাৎ এসব বই যেখানে পাই আমি ঝাপ্টা দিয়ে নিয়ে এসে গোগ্রাসে গিলে আবার ফেরত দিয়ে আসি।
শংকরের মোহ কাটতে না কাটতেই এক সময় হাতে আসে ‘শংখনীল কারাগার’ আর ‘নন্দিত নরকে’। লেখকের এই দুটো বই পড়ার পর আগের সব লেখকদের মোহ থেকে বিচ্চুত হয়ে পড়ি। কিন্তু এই লেখককে আর পাওয়া যায় না। আমি সুনীল-শীর্ষেন্দু, বুদ্ধদেব-সমরেশ, দিব্যেন্দু-আবুল ও বশর এসবের ভেতর গড়াগড়ি দিতে শুরু করি।
মাঝখান থেকে বঙ্কিম বা রবীন্দ্রনাথ কিংবা তিন বন্দোপাধ্যায় আমার কাছে অপড়াই থেকে যান। বড় বড় আলোচকদের মুখে শুনি তাদের কথা, কিন্তু আমার তাতে আগ্রহ জন্মায় না। আমি খুঁজি বুদ্ধদেব গুহ বা সমরেশ বসু।
এর মধ্যে মাধ্যমিকে বাংলায় ভালো নম্বর পাওয়ার জন্য ‘উচ্চ নম্বরের সিঁড়ি’কে মাড়িয়ে যাওয়ার জন্য ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করি। ‘ছুটি’র অমল বা ‘শ্রীকান্ত’র ‘চরিত্র বিশ্লেষণ’ বা ছোট গল্প হিসেবে ‘ছুটি’র সার্থকতা- এসব নিয়ে নোট করতে গিয়ে ধরা খেয়ে যাই ‘রবি রাশ্মি’তে। রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রকে তখন আমার পড়া শুরু হয়ে যায়।
আমার জীবনে আউট বই পড়ার মোক্ষম সময়টা কাটিয়েছিলাম দু’বার। প্রথমবার ছিলো মাধ্যমিক পরীক্ষার পর। দ্বিতীয়বার উচ্চমাধ্যমিক শেষে। প্রথমবারের ব্যাপ্তি ছিলো তিন মাস, দ্বিতীয়বারের ব্যাপ্তি অনেক বেশি, প্রায় দেড় বছর। মূলত; এই সময়টাতেই আমি নানা লেখকের দরোজায় টোকা দিতে থাকি। নানা লেখই আমাকে নানা রঙ্গের স্বপ্নের রাজ্যে নিয়ে ঘুরে বেড়ান। বইপড়া একটা অভ্যাসের মতো হয়ে যায়। হাতের কাছে যা পাই, সহজ গদ্যে লেখা যা কিছু তা-ই আমাকে মুগ্ধ করে। নতুন নতুন লেখা বেরোতে থাকে ঈদ সংখ্যাগুলোতে। বিচিত্রা, রোববার, সন্ধানী বেরোবার আগে থেকে দোকানে টাকা অগ্রিম দিয়ে রাখতাম, আর নতুন নতুন গল্প উপন্যাস পড়ার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতাম। ভিন্ন রকমের পদ্যময় গদ্যের স্বাদ পাই সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাসে। কাড়াকাড়ি লেগে যেতো ইমদাদুল হক মিলন আর হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস নিয়ে।
হুমায়ূন আহমেদ তার নন্দিত-কারাগারে-দু’খনার পর যখন প্রায় নিখোঁজ হয়ে যান, তখন ইমদাদুল হক মিলনের লেখা প্রেমকাহিনী আমাকে আকৃষ্ট করে। রাজধানী ঢাকায় নাগরিক জীবনের কাহিনী আমি প্রথম পড়ি মিলনের লেখায়। তাঁর লেখা পড়ে আমার মধ্যে প্রেম প্রেম সুড়সুড়িও জাগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রোকেয়া হল, টিএসসি, রমনা, শাহবাগ, মৌলি রেস্তোরা কিংবা লাল মোরগের মতো একটা হানড্রেড সিসি হোন্ডা আমার ও হয়ে যায়, যতদিন পর্যন্ত না আমি নিজে এই জীবনে এসে পড়ি। আমার যখন আঠারো ঊনিশ, আমি তখন চব্বিশ পঁচিশের সেই সব তরুণের জীবনের স্বপ্ন দেখতাম মিলনের লেখায়। কিন্তু দুঃখ হচ্ছে এটুকু ভেবে যে, যখন আমার সত্যি সত্যি পঁচিশ-ছাব্বিশ হয়েই গেলো, তখন আর মিলনকে সহ্য হলো না। ক্রমেই আমি মিলনের মোহ থেকে মুক্ত হয়ে পড়ি। আমার মোহগ্রস্ততা তখন হুমায়ূন আহমেদের প্রতি।
অনেক ঘেঁটে ঘুঁটে দেখেছি- আমার আউট বইয়ের লেখকদের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদের মতো ঘোর আমাকে কেউ লাগাতে পারেনি। বালক বেলায় আবেগ অনেক বেশি থাকে, কিশোর বেলায় একটু কমে, তারুণ্যে আরো কমে, এবং বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আনুপাতিকহারে হুমায়ূন আহমেদের ঘোর লাগানো আবেষ্টনী থেকে একসময় আমিও মুক্ত হয়ে যাই। তিনি আমাকে তারপর আর টানেন না। এবং একটা সময় আমি লক্ষ্য করি য়ে, এই লেখক কোনো একটা কারণে খুব কৌশলী ছিলেন বলেই সব সময় ধরে নিয়েছিলেন যে সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ পর্যন্ত পাঠক-পাঠিকারাই তার বই পড়বে। সে কারণেই কী-না জানি না, যখন আমি তার প্রথম যুগল উপন্যাস পড়ি, তখন আমার বয়েসী ‘মন্টু’কে আমার নিজের মতো মনে হতো। রাবেয়া নামক এ মেয়েকে আমি চিন্তা করতাম, যাকে আমি ‘রায়েবা আপা’ বলে মনে মনে ডাকতাম। এই বিষ্ময়ের স্বপ্নভঙ্গ হবার জন্য হুমায়ূনের দ্বিতীয় দফায় লেখালেখিতে আসার পরও প্রায় একযুগ তিনি আমার কাছে টিকে ছিলেনÑ নীলু’ অধ্যায় পর্যন্ত। তারপর দেখি ধীরে ধীরে ‘সিলভার্স অব স্টোলেন প্রপার্টি’ গড়ে তুলছেন। ঘুরে ফিরে একই কিশোরীরি নানাবিদ বিলাপ। আমি ক্রমশ; হুমায়ূন বিমুখ হয়ে পড়ি। চোখের সামনে তার নতুন বই দেখলেও উল্টে দেখতে ইচ্ছে করে না। আমি তখন বুঝে ফেলিÑ আমার যথেষ্ট বয়স হয়ে গেছে। হুমায়ূন তখনও খুব ভালো জানেন যে, আমার বয়েসী যুবক বা প্রৌঢ়ের চাহিদা তার চায়ের পেয়ালা নয়।
আমার প্রথম কৈশোরে আমি যখন হুমায়ূনকে পাই, তখন তিনি আমার আকাশের তারা। আমি মাটির উপর দাঁড়িয়ে দেখি, তিনি আকাশে ঝিকিমিকি করছেন। এই থেকে প্রায় তিন দশক পর তার সঙ্গে যখন আমার সখ্য হয়, আমি তখন মধ্যচল্লিশের পৌঢ়। তিনি তখনো কিশোর-কিশোরীদের স্বপ্নডানায় ভর করে উড়ে বেড়াচ্ছেন। তখন তার রূপা আছে, যে নীল শাড়ি পরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে হলুদ পাঞ্জাবী পরা এক হিমু, খালি পায়ে যে ঢাকা শহর ঘুরে বেড়ায়- জ্যোৎনা রাতে যে রমনা পার্কের বেঞ্চিতে বসে রাত কাটায়. পকেটে যার পয়সা নাই, কিন্তু কলিজাটা প্রেমের জন্য হাবুডুবু, তখন তিনি আর আমাকে আকর্ষণের কথা ভাবেন না। তিনি ততোদিনে জেনে গিয়েছিলেন যে, সেই বই-ই তাকে লিখতে হবে, যে বই বিক্রি হয়। বই কেনে উটতি বয়েসী তরুন-তরুণীরা। সুতরাং তাদের হাতে একটা করে হুমায়ূন আহমেদ ধরিয়ে দেবার বাসনায় তিনি ক্রমাগতই লিখতে থাকেন। পঁচিশ বছর বয়স হলে যে তরুণ বা তরুণী তাঁকে প্রত্যাখ্যান করলো, সে বছরই আরেকদল কিশোর কিশোরী ষোলতে পা দিলো, যারা প্রথম থেকে আবার হুমায়ূনে নিমজ্জিত হলো। এবং তাদের পঁচিশ বছর বয়স পর্যন্তই তারা হুমায়ূন চর্চায় মত্ত থাকলেন।
আমি পাঠক হিসেবে লেখকদের বুনে দেয়া স্বপ্নের পৃথিবীতে বহুবার বহুভাবে বিচরণ করেছি। কিন্তু লেখক হবার জন্য কোনো লেখককে আমি আদর্শ করার ইচ্ছা পোষণ করিনি। উচ্চ মাধ্যমিকের পর আমার পড়াশুনা স্থাপত্য বিষয়ে। এই বিষয়টি এমন যে, এটা পড়তে পড়তে বিজ্ঞান ও কলা বিভাগের অনেক শাখায় আমার বিচরণ হয়ে যায়। পদার্থ বিজ্ঞান বা শব্দ বিজ্ঞান কিংবা কাঠামো বা গতিবিদ্যার মতো জটিল অংকশাস্ত্র যেমন আমাদের পড়তে হয়েছে, তার সঙ্গে হিসাব বিজ্ঞান, যুক্তিবিদ্যা, সমাজ বিজ্ঞান, মনস্তত্ব, ভাস্কর্য, আলোকচিত্র, দর্শণ, স্থাপত্যের ইতিহাস, শিল্পকলার ইতিহাস এসবও আমাদের সমান গুরুত্বের সঙ্গে পড়তে হয়েছে। পড়–য়া হিসেবে যেমন ছোটকাল থেকে আমার সুনাম ছিলো, তারই ধারাবাহিকতায় আমি কলা ও বিজ্ঞানের সমন্বিত এক প্রকার পুথিগত বিদ্যা আমার অর্জন হয়ে যায়। এর বাইরে হাতের কাছে পাওয়া বইপত্র, পত্র-পত্রিকা, খবরের কাগজ, রেডিও টিভির অনুষ্ঠান, বন্ধুবান্ধবদের আড্ডা এবং সর্বোপরি নানা রকমের মানুষের সঙ্গে মিলে মিশে যেটুকু যখন বুঝি তা আমি নানা মাধ্যমে প্রকাশ করার চেষ্ট করি।
আচ্ছা, ভেতরে ভেতরে কি আমি কোনো মহান লেখককে অনুসরণ করি? তার মতোই কি আমার হতে ইচ্ছে করে?
বারবার এমন কিছু চিন্তা করেছি। জবাব পাইনি। তবে, আমার সৌভাগ্য- এই উপমহাদেশের সবচেয়ে ঈর্ষণীয় জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদকে আমি প্রায় ৩২ বছর নানাভাবে দেখেছি। একেবারে কাছে থেকেই তাকে দেখেছি তার জীবনের শেষ চার বছর। তখনও কি হুমায়ূন আমাকে মোহগ্রস্থ করে রাখেননি?
আমার এক প্রকাশক বন্ধুকে একবার জিগ্যেস করেছিলাম বলোতো, বাংলাদেশের শীর্ষ স্থানীয় পাঁচজন লেখক কে, যাঁদের বই সবচেয়ে বেশি বিক্রিত হয় ? জবাবে তিনি বলেছিলেনÑ প্রথমত; হুমায়ূন আহমেদ, দ্বিতীয় হুমায়ূন আহমেদ, তৃতীয় হুমায়ূন আহমেদ, চতুর্থ হুমায়ূন আহমেদ, পঞ্চম হুমায়ূন আহমেদ। ষষ্ঠ থেকে অন্যদের নাম শুরু হয়। প্রথম মুদ্রনে চোখ বুজে ২০ হাজার কপি ছাপতে পারে এই লেখকের নতুন বই যেকোনো প্রকাশক। সেখানে ষষ্ঠ স্থানে থাকা লেখকের বই প্রথম মুদ্রণে ৫ হাজার কপি ছাপতে চিন্তা করে। দশম স্থানে থাকা লেখকের বই প্রথম মুদ্রণে ছাপে দুই হাজার কপি। এই যদি হিসেব, তাহলে হুমায়ূন আহমেদ আসলে কোথায় থাকেন? আমি মুখ ফিরিয়ে নিলে সে আমার অযোগ্যতা, লেখকের তো নয়! তাহলে আমার স্বপ্নভঙ্গের কারণটি কোথায়? তাঁকে খুব কাছে থেকেও দেখে আমার এই বোধ জন্মেছে যে, তিনি অন্যের চাহিদা মেটানোর জন্য লিখতেন। এই অনেকটা বড় কারণ আমাকে বিমুখ করার জন্য। আমি এও দেখেছি যে, প্রকাশকদের নগদ টাকার বস্তাকে তিনি কখনো অগ্রাহ্য করতে পাতেন না। কতগুলো অর্থ লিপ্সু প্রকাশক তাঁকে ফরমায়েস দিতেন- তার একটা হিমু চাই তার একটা মিসির আলী চাই। হুমায়ূন জানতেন, ওসব খাওয়ানো খুব সহজ। তিনি সেই পথেই হেঁটেছেন। আমার তো মনে হয় অন্তত; রবীন্দ্রনাথের মতোও স্বাভাবিক স্বচ্ছলুা তার থাকলে তিনি হয়তো আজীবন তাঁর নিজের বোধের কথাই লিখতেন। তিনি ততোদিনই আমার প্রিয় লেখক ছিলেন, যতদিন তিনি তার দেখা জগৎটাকে অতিসাধারণ পাঠকের কাছে পৌঁছাতে চেয়েছিলেন। আবার যখনই তিনি প্রকাশক নির্ভর লেখক হয়ে যান, তখন আর তিনি তাঁর মধ্যে থাকতে পারলেন না। দিনে দিনে তার বইয়ের সংখ্যা বাড়তে থাকলো, পাঠকের সংখ্যা বাড়তে থাকলো, প্রতিযোগিতা করে প্রকাশকদের সংখ্যাও বাড়তে থাকলো, কিন্তু তিনি রয়ে গেলেন তাঁর নিজের জায়গার কিশোরী তরুণীদের মুগ্ধ করার লেখকের তালিকায়।
হুমায়ূন আহমেদ অসাধারণ প্রতিভাবান মানুষ ছিলেন। মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকে বোর্ড স্ট্যান্ড করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন, ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়েছেন বৃত্তির টাকায়। মেধাবীরা যা করে ভালো করে। তিনি পলিমার কেমিস্ট্রিতে অনেক ভালো কিছু করেছেন, আরো ভালো কিছু করতে পারতেন। কিন্তু একবার চলচ্চিত্রকার হবার বাসনা নিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের চাকুরী ছেড়ে দিয়ে সিনেমা বানালেন। তার হাতে টাকা ছিলো না। তিনি বড়লোকদের কাছে ধর্না দিয়েছেন ছবির প্রডিউসার জোগড় করতে। একসময় সরকার তাকে অনুদান দিলে তিনি ছবিটি বানান। এবং পাশাপাশি প্যাকেজ নাটক প্রযোজনা ও বই লিখে অর্থ উপার্জনের জন্য ব্রতি হন।
যে অসাধারণ মেধা নিয়ে হুমায়ূন আমাদের কাছে এসেছিলেন, তার সর্বোচ্চ প্রয়োগ একটা সময় আমি আর দেখিনা। লোক হাসানো নাটক বানানো বা বালিশ ভেজানো কাহিনী লেখার মধ্যেই নিজেকে রাখলেন। মাঝে মাঝে অবশ্য সম্ভিত ফিরে পেয়েছিলেন। চেষ্ট করেছিলেন- প্রথম পর্যায়ের লেখাগুলোর মতো কিছু লিখতে। সেগুলোও এসেছে, কিন্তু সংখ্যায় খুব কম। প্রায় আড়াইশো গ্রন্থের মধ্যে থেকে ছাকনি দিয়ে বাছতে গেলে বারো আনাই যদি তার ফেলে দিতে হয়, তবে ওগুলোর জায়গা কোথায়?
আমি জানি, এসব আমার ভুল ধারণা। গত বই মেলাতেও দেখেছি, পুরনো বইগুলোর বিন্যাস-সমাবেশ করে নতুন মোড়কে বাঁধানো বইগুলোর জন্যও যথেষ্ট ভিড় ছিলো। যথেষ্ট তরুণ-তরুণীর কাছে হুমায়ূন এখনো স্বপ্নের তারকা। তিনি খুব ভালোভাবেই জানতেন, সব সময়ই তরুণ-তরুণীরা থাকবে, আরো বেশ ক’বছর হুমায়ূনও থাকবেন। কারণ, তার গদ্যশৈলী ও আবেগতাড়িত বর্ণনা নতুন যে লেখক লিখবেন, এ প্রজন্মের তরুণেরা এখানো তার দেখা পাননি। আগামীতে না পাওয়া পর্যন্ত হুমায়ূনই তাঁদের স্বপ্নের তারকা, যেমন তিন আমারও ছিলেন। তবে এক তারকা আমার আকাশ থেকে এখনো খসে পড়েননি। আর বোধহয় পড়বেন না। আমার কিশোর বয়সে পাঠ্য পুস্তকে তার ‘মিনি’, ‘অমল’ ‘হৈমন্তী’কে পেয়েছিলাম। পাঠ্যপুস্তক বাদ দিয়ে তাঁকে যতোই খোঁজার চেষ্টা করি, ততোই বিষ্ময়ের সঙ্গে তার ভাগাড় আবিস্কার করি। তিন দিনে দিনে আমার আগ্রহের কারণ হয়ে আছেন।
মোহগ্রস্থ হয়ে থাকা অনেক লেখকই এক সময় আমার মোহ থেকে গত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ বোধ হয় আর হবেন না। আর হবেনই বা কেনো, সর্বোচ্চ সময় আমাকে মোহগ্রস্থ করে রাখা হুমায়ূন আহমেদ স্বয়ং ছিলেন এই ঠাকুরের প্রতি আবিষ্ট।