দেলওয়ার এলাহী
১৯৯২ সালের ২০ মার্চ ভারত সরকার কর্তৃক সত্যজিৎ রায়কে ‘ভারতরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়; ঠিক তাঁর অস্কার প্রাপ্তির দুদিন পর। শরীরের ক্রমাগত অবনতির জন্য কোলকাতার হাসপাতালেই অস্কার এবং ভারত সরকার কর্তৃপক্ষ সত্যজিৎ রায়ের হাতে পুরস্কার ও সম্মান পৌঁছে দিয়েছিলেন। এটা সত্যি রায়ের প্রাপ্য ছিল। তবু, মনে হয়েছে দীর্ঘকালের পর কেন রায়ের মৃত্যুপথযাত্রার প্রাক্কালে এই আয়োজন! দেরীতে হলেও এরা এই দায় থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে চেয়েছেন। কেননা, শেষ পর্যন্ত এই উভয় প্রতিষ্ঠানই এটাকে দায় মনে করেছেন। সমালোচনা থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখতে চেয়েছেন। পুরস্কার দিয়ে নিজেদেরকে সম্মানিত করার বোধের তাগিদ অনুভব করেননি।
আমার বারবার মনে হয়েছে, এরা বড় দেরী করে ফেলেছিলেন এই কাজটি করতে। যেহেতু অস্কার পুরস্কারে একটি আজীবন সম্মাননার বিষয় যুক্ত ছিল এবং একজন ভারতীয় নাগরিক হিসেবে তাঁর ভারতরত্ন পাওয়ার ‘অধিকার’ বহু আগেই তিনি অর্জন করেছিলেন। ভাগ্যিস সেটা তাদের বোধোদয় হয়েছিল! এবং তাঁর হাতেই পুরস্কার প্রদান করে নিজেদেরকে দায়মুক্ত করতে পেরেছিলেন। এর ঠিক একমাস দুদিন পর অর্থাৎ ২৩ এপ্রিল তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। ঐ যে বললাম পুরস্কার দিয়ে ‘নিজেদেরকেই সম্মানিত করার বোধের তাগিদ’ তা প্রবলভাবে অনুভব করেছিলেন ফরাসী প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া মিতেরাঁ। এই ভদ্রলোক বেজায় শিল্পসাহিত্য প্রেমিক ছিলেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু তালিকায় সার্ত্রে, কেস্ট্রো এবং মার্কেজ প্রমুখের নাম সুবিদিত। কী আশ্চর্য, মিতেরাঁ মশাই আমাদেরকে অবাক করে দিয়ে চলে এসেছিলেন কোলকাতায়। কলকাতায় ন্যাশনাল লাইব্রেরীর বাগানে চেয়ার সাজিয়ে এক বিরল সম্মানের মুহূর্তকে রচনা করার আয়োজন হয়েছিল। রাষ্ট্রের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান তিনি বয়ে আনলেন সত্যজিৎ রায়ের গলায় পরিয়ে দেয়ার জন্য। তিনি ঘোষণা করলেন ফরাসী দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান তিনি নিজেই অর্জন করলেন এই পুরস্কারে সত্যজিৎ রায়কে সম্মানিত করার মাধ্যমে!
বাঙালি না হয়ে সত্যজিৎ রায় যে কোন দেশের মানুষ হলেও আমার গর্ব হতো! তাঁর কাজ এবং শিল্পচর্চা যে কোন ভাষায় হলেও আমার আপত্তি থাকতোনা। এবং তিনি যে কোন জাতির হলেও আমি তাঁকে ভালবাসতাম। কিন্তু তিনি যে আমাদেরই আলো হাওয়ায় মানুষ! তাঁর সব কাজেই যে বাঙালিয়ানার আদলে মঞ্জরিত। তিনি যে বাংলায়ই কথা বলেন! সত্যজিৎ রায়ের প্রতি আমার ভালবাসা আর শ্রদ্ধার শেষ নেই!