কাজ না থাকলে মাঝেমাঝে ছবির এ্যালবাম ঘাঁটি। কাল হঠাৎ এই ছবিটা চোখে এলো। আমার সঙ্গে যাকে দেখা যাচ্ছে আশা করি সবাই চিনতে পারছেন। একজন স্বনামধন্য চিত্রনায়িকা। কোন এক অনুষ্ঠানে এটি তোলা হয়েছিল। ছবিটি দেখে অনেকদিনের পুরোনো কিছু স্মৃতি মনে পড়লো। শেয়ার করছি। লেখাটা বেশ বড় হয়ে গেল, যাদের সময় আছে পড়লে আশা করি ভাল লাগবে।
তখন কলেজে পড়ি। আব্বার চাকরির সুবাদে জামালপুর শহরে বাসা। আইউব খানের ‘ডিকেড অব রিফর্মস’ উদযাপন উপলক্ষ্যে সরকারি উদ্যোগে সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আমি তখন শহরে একজন উঠতি মঞ্চ তারকা। বেশ কয়েকটা নাটকে অভিনয় করা হয়ে গেছে। নাটক লিখে ফেলেছি এবং নির্দেশনা দিয়ে দুই একটা মঞ্চস্থও করা শেষ। এখানে ওখানে নাটক হলে ডাক পড়তো। ফলে একটু ভাব নিয়েই চলতাম। একদিন গুরু মোজাম্মেল ভাই বললেন ওই সরকারি অনুষ্ঠান আয়োজকদের তিনিও একজন। আমাকে তার সঙ্গে থাকতে হবে, বিকালে যেন বকুলতলায় শহীদ ভাইয়ের স্টুডিওতে চলে আসি। বকুলতলার মোড় সে সময় শহরের একটা অন্যতম নামকরা জায়গা। ওখানে গেলে সাধুর দোকানের পান খেতেই হতো। ওই মোড়েই শহীদ ভাই নামের এক সাংষ্কৃতিক ব্যক্তিত্বের একটা ফটো স্টুডিও ছিল। শহীদ ভাই সম্ভবত: গানের চর্চা করতেন, ভাল বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন। স্টুডিওর পেছনের অংশে ছিল রিয়ার্সালের জায়গা। গুরুগম্ভীর এবং স্বল্পভাষী ছিলেন ভদ্রলোক।
ওখানে গিয়ে জানা যায় শহীদ ভাইও আয়োজকদের মধ্যে আছেন। মোজাম্মেল ভাই অনুষ্ঠানে ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ গানের সঙ্গে নৃত্যাভিনয় করবেন। আরো আইটেম আছে। শেষ আকর্ষন হিসাবে থাকবে নৃত্যনাট্য ‘আনারকলি’। আমাকে সেখানে শাহজাদা সেলিম সাজতে হবে। নায়কের পার্ট। খুবই লোভনীয় ব্যাপার, কিন্তু গোল বাধলো- বিষয়টা নৃত্যনাট্য। যা কিছু হবে সবই নাচের মাধ্যমে। আমি তো নাচের ন’ও জানি না! শহীদ ভাই মোজাম্মেল ভাই দুজনই কনফিডেন্ট আমি পারবো, তারা আমাকে শিখিয়ে দেবেন। আমি জানতাম না শহীদ ভাই নাচও পারেন, বললেন হাতে কয়েকদিন সময় আছে প্রাকটিস করলে হয়ে যাবে। তিনিই শেখাবেন।
সে আমলে নারী মঞ্চাভিনেতার খুব আকাল ছিল। ছেলেদেরকেই মেয়ে সাজতে হতো। বড় কোন আয়োজন হলে ময়মনসিংহ থেকে নারী অভিনেত্রী আনা হতো। মনে আছে একবার হাই স্কুল মিলনায়তনে একটা হাই প্রোফাইল নাটকের জন্য রূপবানখ্যাত চিত্রনায়িকা সুজাতাকে আনা হয়েছিল। সে উপলক্ষ্যে সারা শহরে কি সাজ-সাজ রব! এত দর্শকচাপ টিকিটেই পাওয়া যায় নাই। আনারকলি গল্পের মূল চরিত্র আনারকলি। জানলাম এই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ময়মনসিংহ থেকে নারীশিল্পী আনা হবে। সরকারি অনুষ্ঠান, আর্থিক বরাদ্দ মন্দ না। ততদিনে যে কয়টা নাটকে অভিনয় করেছি কোন নারীশিল্পীকে সঙ্গে পাই নাই। এবার যাও পাওয়া গেল একেবারে নৃত্যনাট্য। আরো জানলাম যাকে আনা হচ্ছে সে মূলত: একজন নৃত্যশিল্পী। হতেই হবে। নৃত্যনাট্যে নৃত্যশিল্পীই তো লাগবে।
রিয়ার্সাল শুরু হলো। প্রথম কয়েকদিন তা ধিন ধিন তা না তিন তিন তা, তারপর শহীদ ভাই শেখাতে লাগলেন কিভাবে শাহজাদা ঘোড়ায় চেপে আসবেন, কিভাবে তিনি পানপাত্র হাতে তুলে শরাব পান করবেন। একা একাই এসব শিখি। শোর এক-কি দুইদিন আগে নায়িকা এলো। মনে করেছিলাম বড়সড় কোন নারীশিল্পী হবে, কিন্তু এ তো একটা বাচ্চা মেয়ে! বয়স তের চৌদ্দর মত, বড় জোর পনের হতে পারে। এই বয়সেই নাকি বেশ নাম করে ফেলেছে। তুখোড় নাচিয়ে। যাহোক, ফাইনাল রিয়ার্সাল হলো। দুজনে দাঁড়ালে দেখা গেল আমি কিছুই না। মেয়েটাও সাহায্য করলো। মোটামুটি একটা কিছু দাঁড়ালো। অনুষ্ঠানের দিন বিকালে মিলনায়তনে যাচ্ছি, সামনের রিকশায় ‘আনারকলি’ এবং তার সঙ্গে বোধহয় আরো একটি মেয়ে, পেছনে এক রিকশায় আমি একা। হঠাৎ কি হলো, রিকশা দুটো কাছাকাছি আসতে সামনে থেকে ‘আনারকলি’ দুস্টামি করে একটা ফুল ছুড়ে মারলো আমার দিকে। সেই সঙ্গে পেছন ফিরে মুচকি হাসি। ব্যস!
অনুষ্ঠান খুব জমজমাট। পুরো পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তন মানুষে ঠাসা। এসেছেন এসডিও সাহেব, সব সরকারি কর্মকর্তা, তাদের পরিবারবর্গ। আম্মা জানতেন, দেখি ছোট ভাইবোনগুলোকে নিয়ে তিনিও এসেছেন। দর্শক সাড়ির দ্বিতীয় কি তৃতীয়তে বসা। দর্শকদের তুমুল করতালির সঙ্গে একটা একটা করে আইটেম পরিবেশন হয়ে চললো। অবশেষে এলো শেষ আকর্ষন। আমার মনের আর বুকের অবস্থা তখন কি আজ আর তা লিখে বোঝাতে পারবো না। শহীদ ভাই মোজাম্মেল ভাই সাহস যুগিয়ে চললেন। মেয়েটাও বললো আমি কোথাও ভুল করলে ম্যানেজ করে নেবে। অবশেষে পর্দা উঠলো। একে একে দৃশ্য অভিনীত হতে লাগলো। শেষের দিকে একটা দৃশ্য ছিল এমন আমি তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে আছি আনারকলি নাচছে আর মাঝেমাঝে কাছে এসে পানপাত্রে সুরা ঢেলে দিচ্ছে, আমি নাচের ভঙ্গিতে তা নিয়ে পান করছি। এই কাজ করতে গিয়ে হঠাৎ দর্শকদের দিকে চোখ যায়। দেখি আব্বাও বসে এক জায়গায়!
আমার আব্বা ছিলেন পরহেজগার মানুষ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজী। নাচ গান নাটক থিয়েটার দুচোখের বিষ। জীবনে কোনদিন সিনেমা দেখেন নাই। বিয়ের পর পর শালা শালীরা একবার ধরে নিয়ে গেছিলো সিনেমা হলে। মিনিট পনের থেকে এশার নামাজের আজান দিয়েছে বলে বের হয়ে এসেছিলেন। তবে যতক্ষণ ছিলেন মাথা নিচু করে বসেছিলেন। আমি যে নাটক করতাম- তাকে লুকিয়ে। কখনও জানতে দিতাম না। আমার এসব কাজে সব সময় উৎসাহ যোগাতেন আমার আম্মা। তিনি প্রটেকশনও দিতেন। এই অনুষ্ঠানে যে আমার পারফরমেন্স আছে এটাও আব্বা জানতেন না। অন্যান্য অফিসারদের সঙ্গে তিনিও সরকারি অনুষ্ঠান দেখতে এসেছিলেন। আমার নৃত্যাভিনয় প্রথম থেকেই দেখছিলেন আমি খেয়াল করি নাই, কিন্তু এবার এই সুরাপানের দৃশ্যের সময় লক্ষ্য করলাম এক পর্যায়ে তিনি উঠে চলে গেলেন। তখনই বুঝে গেছিলাম বাসায় গেলে কপালে কি আছে। তবে ওই মুহুর্তে সে চিন্তা মাথা থেকে তাড়িয়ে অভিনয়ে মনোনিবেশ করেছিলাম।
ভালোয় ভালোয় নৃত্যনাট্য শেষ হয়। সবাই ‘আনারকলির’ প্রশংসা করতে থাকে। আসলেই মেয়েটা খুব ভাল অভিনয় করেছিল। নাচে যে কতটা পারদর্শী তারও প্রমান রেখেছিল। আমিও পার পেয়ে যাই। পরদিন মেয়েটা ময়মনসিংহ চলে যাবার আগে শহীদ ভাইয়ের ওখানে দেখা হয়। বাসার ঠিকানা দেয়। যেতে বলে। কিন্তু আমার বাসায় যেটা হলো, আব্বা আষাড়ের মেঘের মত মুখ অন্ধকার করে রাখলেন। একদিন যায় দুই দিন যায় কিছু বলেন না। একটা কাল-বৈশাখীর হানা যে অপেক্ষা করছে সেটা বুঝতে পারছিলাম তবে বিলম্বের জন্য বিষ্মিত হচ্ছিলাম। এর মধ্যে কি হলো, তিনচার দিন পর কোন একটা কাজে অথবা শুধু ‘আনারকলির’ সঙ্গে দেখা করার জন্য ভোরের ট্রেনে চেপে ময়মনসিংহে চলে যাই। সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে ঠিকানা খুঁজে বাসায় গিয়ে উঠি। দেখি তিনি সামনের পুকুর পাড়ে বসে দাঁত মাজছেন। আমাকে বাসার ভেতরে নিয়ে যান। বাব-মার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। একটা সাংষ্কৃতিক পরিবার। বড় দুই বোনও অভিনয়ের সঙ্গে জড়িত। সবার বড় গীতা দি ততদিনে বেশ ব্যস্ত মঞ্চশিল্পী। মেজোজন মায়া, দেখতে খুবই সুন্দর ছিলেন। আধাঘন্টা বা ঘন্টাখানেক ছিলাম বাসায়। মাসী মা নাস্তা খাওয়ান। তারপর চলে আসি।
বিকালের দিকে বাসায় ফিরে এলে একটা ভালমত আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়। আব্বার একটা চামড়া মোড়ানো হান্টার ছিল। আনসার এ্যাডজুট্যান্ট। ওটা তিনি রেডি করেই রেখেছিলেন। শুধু জিজ্ঞেস করেন কোথায় গেছিলাম, ময়মনসিংহ শোনার সঙ্গে সঙ্গেই এস্তেমাল শুরু হয়ে যায়। আম্মা চেষ্টা করেন ফেরাতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। মাথা আর মুখ বাদে শরীরের হেন জায়গা ছিলনা যা সে যাত্রা হান্টারের স্পর্শধন্য হয় নাই। হাড়গোর কিছু ভেঙেছিল কিনা মনে নাই তবে সারা শরীর ব্যথায় জরজর হয়ে গেছিল। এতক্ষণ কাঁদি নাই কিন্তু পেটানোর পর তিনি যেটা করলেন ওটার জন্য হাউমাউ করে চীৎকার দিয়ে উঠলাম। কেচি নিয়ে এসে আমার নায়কছাটের চুলের মুঠি ধরে ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে চললেন। শেষে কি আর করা, নাপিত ডেকে এনে ন্যাড়া! কয়েক দিন পরই একটা নাটকের মঞ্চায়ন ছিল। আমি তাতে নায়কের ভুমিকায় অভিনয় করবো। মোজাম্মেল ভাইকে খবর পাঠালাম আপাতত: চুল ঠিক না হওয়া পর্যন্ত মঞ্চে ওঠা যাবে না।
সেই ‘আনারকলি’র সঙ্গে আমার আর দেখা হয় নাই। তবে খবর রাখতাম। আর একটু বড় হলে সে ঢাকায় চলে আসে। সিনেমায় নায়িকা হয়। সিনেমার জন্য একটা নামও নেয়। নাচে পারদর্শী ছিল সেই সঙ্গে ভাল অভিনয় করায় অল্প দিনে ইন্ডাস্ট্রিতে জায়গা করে নেয়। এখনও নিয়মিত অভিনয় করে চলেছে। মজার ব্যপার হচ্ছে দীর্ঘদিন বাইরে কাটিয়ে দেশে ফিরে আসার পর জানতে পাই তিনি আমাদের বিল্ডিংয়েই বসবাস করছেন। উনি সাত তলায় আমি বারোতে। মাঝে মাঝেই কথা হয়। স্বামী বাবুল সাহেব অত্যন্ত ভদ্র একজন মানুষ। তার সঙ্গেও লিফটে প্রায়ই দেখা হয়।
সেদিনের সেই ‘আনারকলি’র নাম রত্না, সিনেমায় আসার পর নাম নেন নুতন। আমি তাকে এখনও রত্নাই বলি। উনিও আগের মতই আমাকে সমীহ করেন। মানুষের জীবন কত বিচিত্র, কত ঘাট পেরোয়! কোনদিন ভাবি নাই রত্নার সঙ্গে আমার এভাবে দেখা হবে। এভাবে এক বিল্ডিংয়েই থাকবো। রত্না ভাল থাকো সুস্থ থাকো। দীর্ঘজীবি হও। তোমার জন্য শুভ কামনা নিরন্তর।