তাসরীনা শিখা
আমরা কি কেউ এতো মৃত্যু দেখেছি এক বছরে। প্রতিদিন ভয়ে থাকি আজ কোন মৃত্যুর খবর পাবো পরিচিতের মৃত্যু ,পরিচিতের পরিচিতর মৃত্যু।আত্মীয়র আত্মীয়ের মৃত্যু । বন্ধুদের কয়েকজনের মৃত্যু হোল। এমন কতো মৃত্যু খবর প্রতিদিন পাই। খবর গুলো বুকটা ভেঙ্গে চুর চুর করে দেয়।সব সময় একটা আতংক জাগে মনের ভেতর মনে হয় আজ আছি কালই হয়তো আমার নাম তালিকাতে এসে যাবে। জানি না কবে আমরা আগের মতো একটা সুস্থ জীবন ফিরে পাবো ।
মাথার উপর থেকে ভালোবাসার হাত গুলো একে একে সরে যাচ্ছে। যাদের স্নেহ, আদর, ভালবাসাতে বড় হয়েছি, ভালো মন্দ বুঝতে শিখেছি। যাদের ঘিরে শৈশব , কৈশোর , তারুন্যর অনেকটা সময়ই কেটেছে। চোখ বন্ধ করে যখন ভাবতে বসি, কই কেউতো নেই। উপরের দিকে তাকালে দেখি সব শুন্য।সবাইতো আকাশের তারা হয়ে গেছে। এখন তো মাথায় হাত রেখে স্নেহ ভরা কণ্ঠে কেউ বলার নেই, ভালো থাকিস ,সুস্থ থাকিস , নিজের যত্ন নিস, নিরাপদে থাকিস।
যখন আমি নির্জন একাকীত্ব সময় নিয়ে বসি,চোখের সামনে ভেসে উঠে কতকিছু। মনে হয় আমি যেন স্লাইড শো দেখছি। একের পর এক চিত্র আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে । ছুটির দিনে বাবা মা দিবা নিদ্রা নিচ্ছেন আর আমরা ভাই বোনেরা ছুটে বেড়াচ্ছি সারা বাড়ীময়।গাছে উঠে ডাঁসা পেয়ারা পেরে এনে তেতুল মরিচ মেখে খাওয়া ।বৃষ্টির দিনে বৃষ্টিতে ভিজে আনন্দ করা। শিলা বৃষ্টি হলে বৃষ্টিতে ভিজে শীল কুড়ানোর উৎসব ।শীতের দিনে রোদে বসে মায়ের ছিলে দেয়া কমলা খাওয়া। ছুটির দিনে গানের স্যার আসতেন গান শিখাতে।বাবা তাঁর সুন্দর ভারী গলাতে আবৃতি শেখাচ্ছেন। বাড়ি ময় নানা রকম ফুলের সৌরভ । সন্ধ্যে বেলায় কামিনী আর হাস্না হেনার সুভাস । জুই ফুলের লতানো গাছ ছাদের রেলিং বেয়ে উঠে এসেছে । সে জুই ফুলের মিষ্টি গন্ধে ছাদে বসে পাড়ার বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা , বিনা কারনে হেসে গড়িয়ে পড়া । সব কিছু সপ্নের মতো লাগে।
পুকুরে সাঁতার শেখা । সাঁতার কেটে পুকুরের ওপারে যাবার প্রতিযোগীটা । পাড়ার বন্ধুদের নিয়ে আমাদের বাড়ীর বড় উঠোনে চড়ুই ভাতি খেলা। মায়ের উৎসাহ নিয়ে সব কিছু গুছিয়ে দেয়া। মা বাবার বিকেলে বারান্দাতে বসে চা খাওয়া আর নিজেদের মধ্যে গল্প গুজব করা। সন্ধ্যা বেলা কাজের লোকের দায়িত্বে ধুপের পাতিল নিয়ে ঘরে ঘরে ধুপ ছড়িয়ে দেয়া। সন্ধ্যে বেলা মুখ হাত ধুয়ে পরতে বসা । সুযোগ পেলেই চেয়ার ঘুরিয়ে বোনদের গল্প শুরু।মাকে দেখলে আবার মুখ ঘুরিয়ে জোরে জোরে পড়া শুরু। শীতের দিনে একমাস ব্যাপী একজিভিসন কুমিল্লা ষ্টেডিয়ামে । মাঝ রাত পর্যন্ত চলতো মাইকে জনপ্রিয় গান। সে গানে মন উড়ে যেতো কোন এক অজানার দেশে। কিশোর বয়েসের উচ্ছল চিন্তাহীন জীবন। শুধুই মুক্ত বিহঙ্গের মতো ঘুরে বেড়ানো ।
স্কুল পেরিয়ে কলেজ।কলেজে আশা যাওয়ার পথে অতি উৎসাহী কলেজ ফাঁকি দেয়া ছেলেদের মুখে” অনেক শিখা পুড়ে তবে অনেক প্রদীপ জ্বলে” নিয়মিত ভাবে শুনা ।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন, শামসুন্নাহার হল, ৩৩৬ নাম্বার রুম, সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ । স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়া । কলা ভবনের চার তালাতে দৌড়ে উঠা ক্লাসে যাবার জন্য। হলের রুমে বন্ধুদের সাথে আড্ডা , হৈ চৈ করে জীবনটাকে আনন্দ মুখর করে তোলা ।
টি এস সি তে বসে গল্প ,সোহরআরদি উদ্যানে বিকেলে হেটে বেড়ানো ।বাদাম কিনে খাওয়া । হলের সামনের চটপটি খাওয়া।বলাকা সিনেমা, মৌলীতে চা নাস্তা খাওয়া, চাঁদা তুলে চাইনিজ খাওয়া ।হলের বাইরে অপেক্ষমাণ কারো সাথে দেখা করতে বেড়িয়ে আসা।লেখক শিবিরের সাথে ঘুরে ঘুরে বিপ্লবী গান করা।তারপর সন্ধ্যার আগেই হলের খাঁচাতে ঢুকে পরা।”সে যে আমার নানা রঙের দিনগুলো।“
সবকিছু এখন সাদা কালো চলচিত্রের ফিরে দেখার মত লাগে। বর্তমানে নানা কাজের মাঝে পেছনের ছবি গুলো ফিরে ফিরে আসে ।
মুখর জীবন শেষে বাস্তব জীবনে পা রাখা।বাস্তবের নানা রকম কর্তব্য , দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জীবনের নির্মল উচ্ছলতা কমে আসা । এ ভাবেই জীবনের পথে এগিয়ে চলা। এভাবেই জীবনের কঠিন সত্য গুলো মেনে নেয়া।
আজো চোখ বুঝলে দেখতে পাই নিবিড় শ্রাবণ ধারার মতো ঝরে আমার শৈশব, আমার কৈশোর আমার তারুণ্য।দেখতে পাই অজস্র দৃশ্য , দৃশ্যের পর দৃশ্য যা আমার চোখের সামনে ঝিলিক দিয়ে উঠে । যা কিনা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ছায়া ছবির চাইয়ে সমৃদ্ধ ও মধুর আমার কাছে।