-শাহানা আকতার মহুয়া
বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন রঙে হেমন্ত আসে। কোথাও আসে শীতের আগাম বার্তা নিয়ে, কোথাও আনে শস্যের ঘ্রাণমাখা দিন নিয়ে আবার কোথাও
এই ঋতু আসে রঙের ঝর্নাধারায় স্নাত হয়ে। ছয় ঋতুর দেশ বাংলাদেশে অনেকটা চুপিসারে, নিঃশব্দে, মগজে কবিতার ছায়ার মতো আসে হেমন্তকাল। কিন্তু কানাডায় না এলে হেমন্তের যে এতো রঙ তা জানা হতো না। এ দেশে ‘ফল’ বা হেমন্ত আসে প্রকৃতি আর মানুষকে নানা রঙের আবিরে রাঙিয়ে। পাতায় পাতায়, বনে, পাহাড়ে, লোকালয়ে যেন রঙের আগুন জ্বলে ওঠে। গাছের পাতাগুলো লাল, কমলা, হলুদ এবং বাদামীতে রূপান্তরিত হয়ে চরাচরে তৈরি করে এক ঐন্দ্রজালিক আবহ।
অন্যান্য মৌসুমের মতো হেমন্তও কবিদের আলোড়িত করে, অনুপ্রাণিত করে। তবে ঝলমলে সবুজ আর রাশি রাশি পুষ্পবিছানো বসন্তের চেয়েও সোনালি-লাল-হলুদ-কমলায় মোড়ানো হেমন্ত যেন জ্বলজ্বল করে আরো বেশি, এ যেন সাদা রঙের শীতের পোশাক পরার আগে আগে প্রকৃতিতে রঙের অবর্ণনীয় এক বিচ্ছুরণ। আহা! এই স্বপ্নময় সৌন্দর্য স্তব্ধ করে দেয়। যুগে যুগে কবিরা মুগ্ধ হয়েছে হেমন্তের রূপে।
হেমন্তমুগ্ধ কবি কীটস’র কবিতায় এই ঋতু চিত্রিত হয়েছে-
While barred clouds bloom the soft-dzing daz,
And touch the stubble-plains with rosz hue;
Then in a wailful choir the small gnats mourn
Among the river sallows, borne aloft Or sinking as the light wind lives or dies;
যত যাই বলি না কেন, কানাডার চোখ ধাঁধাঁনো হেমন্তের পাশাপাশি বাংলার হেমন্তও এসে উঁকি দেয় মনের জানালায়। স্মৃতির কৌটা খুলে ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশিরকণা, হালকা কুয়াশার ঢাকা স্নিগ্ধতা মাখানো সকাল দেখি, জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকে ভেসে আসা মন কেমন করা হেমন্তের গন্ধ নিই!!
বাংলাদেশের হেমন্তকে বলা যায় শস্যের,
তৃপ্তির, বিরতির ঋতু। বাংলার হেমন্তকে কবিরা দেখেছেন প্রেমে-কামে, দেহে-দেহহীনতায়,
সৃষ্টিতে, তৃপ্তিতে, বিরহে, বিরতিতে। কবি সুফিয়া কামাল সহজ-সরল ভাষায় এঁকেছেন হেমন্তের ছবি-
‘সবুজ পাতার খামের ভেতর
হলুদ গাঁদা চিঠি লেখে
কোন্ পাথারের ওপার থেকে
আনল ডেকে হেমন্তকে?’
মজার ব্যাপার হলো এই মৌসুমে কানাডায় খাবারসহ সবকিছুতে থাকে মিষ্টি কুমড়োর স্বাদ এবং সুগন্ধ। মাইলের পর মাইল জুড়ে সবুজ পাতায় মধ্যে শুয়ে থাকেন নধর মিষ্টি কুমড়ো মানে পামকিন। সকালটা অনেকেরই শুরু হয় পামকিন ডোনাট বা স্কোন আর ল্যাটে দিয়ে। শুধু খাবারই নয়, থাকবে পামকিন সুগন্ধযুক্ত মোমবাতি, ক্রিম। আর ঘরে তৈরি পামকিন পাই ছাড়া তো হেমন্ত উদযাপন কথা ভাবাই যায় না।
এটা সত্যি যে-ঋতুচক্র প্রকৃতিতে যেমন বিপুল পরিবর্তন আনে তেমনি মানবমনেও প্রভাব ফেলে। হয়তো অনেক সময় আমরা মানে সাধারণ মানুষেরা উপলব্ধি করে উঠতে পারিনা, কেবল কখনো কখনো আনন্দ-উচ্ছ¡াস, দুঃখ-বেদনা অনুভব করতে পারি এবং এই অনুভব পরিবার-পরিজন কিংবা বন্ধু-স্বজনদের কাছে কিছুটা প্রকাশ করতে পারি। কিন্তু শিল্পী, কবিদের মনোজগতের পরিবর্তন ধরা পড়ে শৈল্পিক প্রকাশে। তারা সময় এবং ঋতুর গন্ধকে আলাদা আলাদাভাবে আবিস্কার করেন নতুন
সৃষ্টির উদ্দীপনায়, জীবনের ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশে। তাঁদের রচনায় প্রকৃতি একটি বড় অনুষঙ্গ এবং কাব্য সমৃদ্ধির এক সোনালি উদ্ভাস। অন্য ভাষার সাহিত্যের কথা না হয় বাদই দিলাম, বাংলা সাহিত্যেও হেমন্তের স্থায়িত্বকাল স্বল্প হলেও এই ঋতুর স্নিগ্ধ বন্ধন সৃষ্টিমগ্ন মানুষেরা এড়িয়ে যেতে পারেননি। বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকদের সুনিপুণ জাদুস্পর্শে, শৈল্পিক সৌকর্যে হেমন্ত অনবদ্য বাণীম‚র্তি রূপে উদ্ভাসিত হয়েছে। কবিগুরুর অসংখ্য কবিতা ও গানে হেমন্ত ঋতুর প্রসঙ্গ এসেছে বহুবার-
“হেমন্তে কোন বসন্তেরই রাণী/পূর্ণশশী ওই যে দিন আনি।
বকুল ডালের আগায়। জ্যোৎস্না যেন ফুলের স্বপন লাগায়।’
সাহিত্যের প্রাচীন যুগে বৌদ্ধ সহজিয়াগণ রচিত চর্যাপদে কোন ঋতুরই উপস্থিতি পাওয়া যায় না। তবে মধ্যযুগের কবি কংকন মুকুন্দরাম চক্রবর্ত রচিত ‘কালকেতু’ উপাখ্যানে শিশির বিন্দুর মতো হেমন্তের ছিটেফোঁটাটুকুই আমাদের মুগ্ধ করে।
‘কার্তিক মাসেতে হয় হিমের প্রকাশ
যগজনে করে শীত নিবারণ বাস’
বৈষ্ণব কবি গোবিন্দদাস পদে তৎকালীন গ্রামীণ সমাজ জীবনের নিখুঁত চিত্র ফুটে উঠেছে। অঘ্রাণে কৃষাণ-কৃষাণীর সমৃদ্ধি ও সুখের সময়ে কুলবধ‚রা স্বামীগৃহ থেকে পিতৃগৃহে নায়রে গমন করে। তার রচিত পদে চিত্রিত হয়েছে সেই ছবি-
‘আঘাণ মাস রাস রস সায়র
নায়র মাথুরা গেল।
পুর রঙ্গিনীগণ পুরল মনোরথ
বৃন্দাবন বন ভেল’
হেমন্তের রূপ লাবণ্যে নিমগ্ন কবি জীবনান্দ দাশের অজস্র কবিতায় ধূমল কুয়াশাচ্ছন্ন হেমন্ত প্রকৃতি অন্তরঙ্গ অনুভবের সংশ্লিষ্টতায় অপূর্ব বাণীম‚র্তি রূপে উদ্ভাসিত হয়েছে। হেমন্ত তাঁর প্রিয় ঋতু। অপূর্ব কাব্যিক সুষমায় হেমন্ত তাঁর তুলির আঁচড়ে বাঙময় রূপে ধরা দিয়েছে। ‘হেমন্তের কবি জীবনান্দ দাশ’ প্রবন্ধে নরেশ গুপ্ত লিখেছেন, “জীবনানন্দের কবিতা পড়তে পড়তে অজান্তে কখন আমরা সেই রূপসী হেমন্তের প্রেমে পড়ে যাই। ভেবে অবাক লাগে, কৃষির সোনার কৌটোতে আমাদের প্রাণের ভ্রমরটি যদিও ভরে রাখা আছে তাহলেও ফলন্ত ধানের ঋতু হেমন্তের গাঁথা বাংলা কবিতায় একরকম ব্যতিক্রম বললেই চলে। শুধু কি দৃশ্যের? গন্ধের, শস্যের, আলস্য পূর্ণতা-বিষাদের করুণতামাখা লাবণ্যময়ী ঋতু হেমন্ত বাংলার কাব্য বর্ষার স্তুতিতে, বসন্তের বন্দনায় মুখর এবং সে দুটি বিখ্যাত ঋতুই বিখ্যাত আরো অনেক কিছুর মতো জীবনানন্দের কবিতায় অনুপস্থিত। শেষ পর্বে জীবনানন্দের কাব্যে যখন জন্মান্তর ঘটছে, হেমন্ত তখনো তাঁর উপকরণ হয়েছিল, তার ব্যবহার যদিও তখন ভিন্ন।” হেমন্ত তাঁর চোখে কেবল রূপসজ্জা ও সৌন্দর্যের জৌলুস মাত্র নয়; হেমন্ত তাঁর কাছে প্রেম বিরহ মিলন ও সৃষ্টির এক অপার বিস্ময়। কবি হেমন্তকে ভালোবাসেন, ভালোবাসেন বিকেলের নরম হলুদ রঙের বর্ণবৈভবহীনতা এবং বিরাণ শূন্য প্রান্তরের বিবর্ণতা-
‘আমি এই অঘ্রাণেরে ভালোবাসি-বিকেলের এই রং-রঙের শূন্যতা
রোদের নরম রোম-ঢালু মাঠ-বিবর্ণ বাদামি পাখি-হলুদ বিচালি
পাতা কুড়াবার দিন ঘাসে ঘাসে কুড়ানির মুখে তাই নাই কোনো কথা,
ধানের সোনার কাজ ফুরায়েছে জীবনেরে জেনেছে সে কুয়াশায় খালি’
হেমন্তকে ছোঁয়া যায় না, ধরা যায় না।
প্রকৃতিতে তার প্রখরতা বিরাজ করে না। তাই হেমন্তকে উপলব্ধি করতে হয়, অনুভব করতে হয়। কিছুটা ধুসর আর অস্পষ্ট ঋতু সে। গ্রীষ্মের মতো খরতাপ নেই, বর্ষার বৃষ্টির মুখরতা নেই, শীতের তীব্রতার উপস্থিতিও নেই এখানে। হেমন্তকে তাই খুঁজে নিতে হয়, বুঝে নিতে হয়।
John Mark green ’র কবিতায় সেই অস্পষ্ট বেদনার মতো নেমে আসে হেমন্তকাল-
One bz one,
thez learn
the art of letting go.
Their final descent
Paints the ground Lavishlz