দেলওয়ার এলাহী
আরামবাগের একটি কক্ষে ভুলক্রমে উঁকি দিতেই দত্তদা (কথাসাহিত্যিক হরিপদ দত্ত) বললেন -দেলওয়ার ও ঘরে নয়। এদিকে আসুন। আমি চলে এলাম হরিপদ দত্তর আরেকটি কামরায়। কিন্তু উঁকি দেওয়া ঘরটিতেই আমার মন পড়ে রইলো। একটি বিস্ময়ও মনের কোণে তোলপাড় শুরু করে দিলো। ছোট্ট সেই কামরার চারিদিকে অজস্র বই। মেঝেয়। বিছানায়। চৌকির উপরে। চারিদিকে ছড়ানো। আমার আর বিস্ময় কাটেনা। দত্তদার সাথে সকালের চা নাস্তা খেয়ে আমরা রিক্সা করে রওয়ানা দিলাম অধ্যাপক আহমদ শরীফ স্যারের বাসায়। পথে যেতে যেতে দত্তদার কাছে আমার কেবলই জানতে ইচ্ছে করে সেই ছড়ানো বইয়ের কামরার অধিবাসী কে! দত্তদা আমাকে বললেন – আরে, ঐ ঘরে থাকেন আমাদের খসরু। মুহম্মদ খসরু। ‘ধ্রুপদী’ পত্রিকার কথা মনে আছে? ফিল্ম নিয়ে যে একটি পত্রিকা বেরোয়- ‘ধ্রুপদী’। সেই ধ্রুপদী পত্রিকার সম্পাদক খসরু। হ্যাঁ, ধ্রুপদী পত্রিকা আমি পড়েছি। এই পত্রিকার সম্পাদক যে মুহম্মদ খসরু সেটাও জানি। কিন্তু, দত্তদা আমার কাছে এমনভাবে বর্ণনা করলেন, যেন অবধারিতভাবে মুহম্মদ খসরুকে আমার খুবই চেনা জানা!
তারপর ঢাকায় আমি স্থিত হলাম। টিএসসি, আলিয়ঁস ফ্রাঁসেস, রাশান কালচারাল সেন্টার, গ্যেয়টে ইনস্টিটিউট ইত্যাদি জায়গায় যাতায়াত বাড়তে লাগলো। খসরু ভাইও আমার পরিচিত হয়ে গেলেন। এক সময় খসরু ভাই আর আমি পাশাপাশি বাড়িতে বাস করতে লাগলাম। ছবি বা অন্য যে কোন জমায়েতে তাঁর সাথে দেখা হলেই দূর থেকে পরস্পর ইশারায় পরবর্তী সময় যাপনের ইঙ্গিতটি আমরা একে অন্যকে দিয়ে দেই। ছবি শেষ হয়। আমরা চুপি চুপি সাকুরা বা এর পেছনের রেস্তোরাঁর চলে আসি। একেবারে তাড়িয়ে দেওয়ার আগে পর্যন্ত আমাদের পর্ব চলতে থাকে৷ একেবারে শেষ রাতে আমরা যখন গরম পানির গলির ভিতরে আসি তখন ছিঁচকে চোর, কিংবা আড়াল খোঁজা বেশ্যার আনাগোনা ছাড়া আর কোন জনপ্রাণী জেগে নেই। দূর থেকে পাহারাদারের হাঁকডাক শুনে আমরা টলটলায়মান পা নিয়ে খসরু ভাইয়ের ছোট্ট এক কামরায় এসে পৌঁছাই। প্রকৃতপক্ষে আমাদের রাত শুরু হয় তখনই। খসরু ভাই ঘরে থাকা দামী পানীয়টি বের করে দেন। ফরাসি ভাষায় ফিল্মের পত্রিকাটি আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে গ্লাসে চুমুক দিয়ে হাতে নেন বাঁশী।
কী অসাধারণ বাঁশী বাজাতেন খসরু ভাই! বাঁশের অনেকগুলো বাঁশি ছিল খসরু ভাইয়ের সংগ্রহে৷ একা, নীরবে, নিভৃতে বাঁশী বাজাতেন৷ লম্বা লম্বা সেসব বাঁশী৷ ফরাসি, স্কটিশ, ইতালীয় সাধ্যমতো পানীয় পানের পর বাঁশীর বেদনাকরুণ সুর অকারণে চোখে জল নিয়ে আসতো। জীবনানন্দ সাধে কি লিখেছেন- কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে! বিসিকের মতিঝিল অফিসে একটি সরকারি চাকুরীও ছিল খসরু ভাইয়ের। ভোর হলে বলতেন – বাসায় গিয়ে কিছু সময় ঘুমাইয়া অফিসে আহো! কথা আছে। মাঝে মাঝে অফিসে গেলে দেখতাম সাজেদুল আউয়াল, মানজারে হাসিন, সুশান্ত মজুমদার বসে আছেন খসরু ভাইয়ের অফিসে। কী আর কথা! শিল্প, চলচ্চিত্র, নন্দনতত্ত্ব, লুই বুনুয়েল, ঋত্বিক ঘটক, কুরোসাওয়া, সত্যজিৎ আরো কত কী! কত খিস্তিখেউড়!
এমন কণ্ঠস্বর হয়তো কঠোর রেওয়াজে করা যেতেও পারে। কিন্তু এমন আত্মশক্তিতে দীপ্তিময় কণ্ঠ কোথায় পাবো! সারাক্ষণ কুঁজো হয়ে হাঁটা এমন দৃঢ় ঋজু মানুষ কোথায় খুঁজে পাবো, আমাদের ঢাকায়, সারা বাংলাদেশে! মাথা উঁচু করে জীবনযাপন করা শিল্প তৃষ্ণার্ত এক কিংবদন্তীর নাম মুহম্মদ খসরু।
তাঁর মহিমামণ্ডিত জীবনের প্রতি আমার অভিবাদন। শ্রদ্ধা। তাঁর অম্লান স্মৃতির প্রতি আমার ভালোবাসা।