রিজওয়ান রাহমান
গত কিছুদিনে বেশ অনেকগুলো ফোন কল আর ইমেইল পেয়েছি কানাডা ফেডারেল সরকারের ইমিগ্রেশন বিষয়ক একটি ঘোষণার ব্যাপারে। বিষয়ঃ আগামী ৩ বছরে কানাডা ১২ লক্ষ ইমিগ্র্যান্ট আনবে। গত অক্টোবরের শেষের দিকে ব্যাপক আকারে ঘোষণাটি ছড়িয়ে পড়ে, বিশেষ করে সেইসব দেশগুলোয়, যেখান থেকে ঐতিহাসিক ভাবেই ইমিগ্র্যান্টদের আগমন বেশি হয় (লিখার সুবিধার্থে চলুন ঐসব দেখগুলোকে আপাততঃ “ইমিগ্র্যান্ট প্রোভাইডার” দেশ বলি)। আমাদের বাংলাদেশও এমন একটি ইমিগ্র্যান্ট প্রোভাইডার দেশ। গত কিছুদিন পাওয়া ফোন কল আর ইমেইলে একটা বিষয় পরিষ্কার, দেশে কথা ছড়িয়ে গেছে যে কানাডা “গণহারে” মানুষ নেবে। ১২ লক্ষ – সংখ্যাটাও খুব একটা ছোট তো না। তবে সাধারন মানুষ যাতে প্রতারিত না হোন, কথার ভোজবাজিতে পরে অর্থনাশ না করেন, তাই এ নিয়ে দু-কলম লিখাটা জরুরী মনে করছি।
ফেডারেল সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ১২ লক্ষ লোক আনার লক্ষ্যমাত্রা-র খবরটা ঠিক, সন্দেহ নেই। তবে এটা স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত ১২ লক্ষ নয়। কানাডা এমনিতেই প্রতি বছর পুরো বিশ্ব থেকে প্রায় ৩ লক্ষ ইম্মিগ্রান্টকে গ্রহণ করে। যেমন ২০১৫ সালে ২৪১,০০০ জন, ২০১৬ সালে ৩২৩,০০০ জন, ২০১৭ সালে ২৭৩,০০০ জন, ২০১৮ সালে ৩০৪,০০০ জন, ২০১৯ সালে ৩১৪,০০০ জন (সূত্রঃ স্টাটিস্টিয়া। স্টাটিস্টিয়া সাধারণত তাদের ডাটা ইন্টেগ্রিটি বজায় রাখার জন্য একটু রক্ষণশীল সংখ্যা প্রকাশ করে। এর মানে হলো, স্বভাবিক সময়ের প্রতি বছরে প্রকৃত ইমিগ্রান্টের সংখ্যা খানিকটা বেশিই হবে)। তবে করোনা পেনডেমিক এর কারণে ২০২০ এ এই সংখ্যাটা প্রায় অর্ধেকের চেয়েও নিচে নেমে এসেছে। যদিও সরকার এখনো ২০২০ এর সঠিক সংখ্যাটি প্রকাশ করেননি, তবে এটা হয়তো ১ লক্ষ ৫০ হাজার এর আশেপাশেই হবে। তো এখানে স্বাভাবিকের চেয়ে কম এসেছে প্রায় দেড় লক্ষ লোক। এখন চলুন একটু সাধারণ গণিতের চর্চা করি। প্রতি বছর ৩ লক্ষ করে হলে ৩ বছরে হয় ৯ লক্ষ। ২০২০ এর ঘাটতি দেড় লক্ষ এর সাথে যোগ করুন, হবে ১০ লক্ষ ৫০ হাজার। কি, হয়ে গেলো তো প্রায় ১২ লক্ষ? পাঠকের দৃষ্টিসীমাটা আর একটু বাড়িয়ে দিতে আর একটা তথ্য যোগ করি। কানাডা যেহেতু নিজের প্রয়োজনেই বিশ্বের অন্যতম ইমিগ্র্যান্ট গ্রহীতা দেশ, তাই আপাতঃ দৃষ্টিতে “ইমিগ্র্যান্ট অবান্ধব” কনজারভেটিভ সরকারের সময়ও এই ট্রেন্ড এর খুব একটা হেরফের হয়নি। যেমন ২০১১ সাল থেকে বছরওয়ারি তথ্যটা যদি একটু দেখি : ২০১১ সালে ইমিগ্র্যান্ট এসেছেন ২৬০,০০০ জন; ২০১২ সালে ২৬০,০০০ জন; ২০১৩ সালে ২৬৩,০০০ জন; ২০১৪ সালে ২৬৮,০০০ জন; ২০১৫ সালে ২৪১,০০০ জন। দেখবেন, সময়ের সাথে সংখ্যাটা এমনিতেই সামান্য উঠা-নামা করে যেটা স্বাভাবিক, ঠিক যেমন অন্যান্য অনেক সূচকের বেলাতেও ঘটে।
এই ১২ লক্ষ এর মধ্যে আবার সবাই স্কীলড ইমিগ্র্যান্ট হবেননা। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী আগামী বছরের লক্ষ্যমাত্রাটার একটু বিশ্লেষণ করলেই বিষয়টা আর একটু খোলাসা হবে। আগামী বছর সরকার চাইবেন ইকোনোমি ক্লাস (অর্থাৎ স্কীলড, বিজনেস ইত্যাদি) এ ২ লক্ষ ৩২ হাজার, ফ্যামিলি ক্লাস (স্বামী/স্ত্রী, বাবা-মা, দাদা-দাদী/নানা-নানী অথবা কিছু কিছু ক্ষেত্রে অন্য আত্মীয়) এ ১ লক্ষ ৪ হাজার; রেফিউজি ক্লাস এ ৬০ হাজার আর হিউমেনিটারিয়ান গ্রাউন্ড এ আরো ৬ হাজার; তো সর্বমোট প্রায় ৪ লক্ষ। আবারো আগের প্যারাগ্রাফ এর অঙ্কটায় ফিরে যাই : বছরে ৪ লক্ষ করে ৩ বছরে হয় ১২ লক্ষ। সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী ২০২১ সালে লক্ষ্যমাত্রা সর্বমোট ৪০১,০০০ জন, ২০২২ সালে ৪১১,০০০ জন এবং ২০২৩ সালে ৪২১,০০০ জন। এর মাঝে স্কীলড, বিজনেস, রিফ্যুজি, ফ্যামিলি এরকম সব ক্যাটাগরির আবেদন থাকবে।
আমার এই লিখাটার উদ্দ্যেশ্য কারও ইমিগ্রেশন এর স্বপ্নকে আঘাত করা না। আমি শুধু চাই যাঁরাই কানাডা ইমিগ্রেশন নিয়ে আগ্রহী, তাঁরা যেন কোনো বিভিন্ন বাহারি বিজ্ঞাপনে প্রতারিত না হয়ে জেনে-বুঝে এর পরই সিদ্ধান্ত নেন। আমার ধারণা, যে কঠিন মানদন্ডে কানাডার ইমিগ্রেশন এর আবেদনগুলো বিবেচিত হয়, এর কোনো রকম হেরফের হবেনা। পুরো বিশ্ব থেকে স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত মাত্র ৫০ হাজার আবেদন গ্রহণ করতে কানাডা সরকারকে আবেদন বিবেচনার মানদন্ডটি নড়ানোর কোনো প্রয়োজনই হবেনা। তাই আগ্রহীদের প্রতি অনুরোধ, নিজেরা যথাযথ যাচাই-বাছাই করেই আবেদন সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো নেবেন।
লেখক: ব্যারিস্টার ও সলিসিটর