বরগুনা জেলার ১২ লাখ মানুষ রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হলে বাঁচার জন্য ছুটে আসেন জেনারেল হাসপাতালে। কিন্তু তাদের যারা চিকিৎসাসেবা দেবেন, সেই চিকিৎসকই এই হাসপাতালে নেই বললেই চলে। এখানে চিকিৎসক থাকার কথা ৪৩ জন হলেও আছেন মাত্র ১১ জন। ফলে ৩২টি চিকিৎসকের পদ খালি রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে।
হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সরা জানান, চিকিৎসকের অভাবে হাসপাতালের গাইনী বিভাগে ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসা দেওয়া যায় না। গাইনী রোগীদের ক্লিনিক অথবা জেলার বাইরে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার পরামর্শ দিতে বাধ্য হন তারা।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তথ্য মতে, জেলার প্রধান এই হাসপাতালে চিকিৎসকের পদ রয়েছে ৪৩টি। এর অনুকূলে আছেন মাত্র ১১ জন। বাকি ৩২টি পদ শূন্য। এরমধ্যে ২১ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পদের ১৭ টিই শূন্য। আর চিকিৎসা কর্মকর্তার ১৯টি পদের মধ্যে ১৪টি পদশূন্য। জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ ২১ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মধ্যে নাক –কান, গলা, শিশু, গাইনি, প্যাথলজিস্ট, মেডিসিন, চক্ষু, কার্ডিওলোজিস্ট, অ্যানেসথেটিস্ট, অর্থোপেডিকস, রেডিওলজিস্ট এবং সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকের পদ শূন্য অবস্থায় রয়েছে।
বর্তমানে যে ১১ চিকিৎসক রয়েছেন, তারা হলেন- হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক, আবাসিক চিকিৎসা কর্মকতা (আরএমও), একজন হোমিও চিকিৎসক, চারজন চিকিৎসা কর্মকর্তা, সার্জারি ও অ্যানেসথেসিয়া, গাইনী ও অর্থোপেডিকস বিভাগের কনিষ্ট বিশেষজ্ঞ চারজন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৯৭ সালে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালটিকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও শয্যা ছাড়া আর কিছুই বাড়েনি। ২০১০ সালে হাসপাতালটিকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর এখানে ছয়তলা একটি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ২০১৮ সালে নতুন ভবনটি উদ্বোধন হওয়ার পর বর্তমানে সেখানে করোনা ইউনিট করা হয়েছে।
হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলছেন, এই হাসপাতালে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ রোগী ভর্তি থাকেন। এছাড়া বর্হিবিভাগে গড়ে সাড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ রোগীর চিকিৎসা দিতে হয়।এরপর প্রশাসনিক কাজ, ময়নাতদন্ত, ধর্ষণের আলামত পরীক্ষাসহ অফিসিয়াল বিভিন্ন কাজকর্ম এই ১১ জন চিকিৎসককেই করতে হয়। এতো রোগীর চিকিৎসা সেবা দেওয়া একরমের অসাধ্য হয়ে পড়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুন একজন মেডিকেল অফিসার বলেন, আমরা চেষ্টা করি সাধারণ রোগীরা যাতে সঠিক চিকিৎসা পান। আমরা সবাই আন্তরিকভাবেই হাসপাতালে রোগীদের সেবা করি। কিন্তু এতবড় একটি হাসপাতাল, এতো রোগীর চাপ মাত্র ১১ জন চিকিৎসককে দিয়ে কোনোভাবেই সামলানো সম্ভব নয়।
হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, পুরনো ভবনের বর্হিবিভাগে রোগীদের দীর্ঘ সারি। রোগীদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। সবাই অপেক্ষা করছেন সেবার আশায়।
বরগুনা সদরের সোনাখালী এলাকা থেকে আসা কুলসুম আক্তার রাইজিংবিডিকে বলেন, সকাল ৯টা থেকে দাঁড়িয়ে আছি। চার বছরের ছেলে অসুস্থ তাই এখানে এসেছি। কিন্তু মনে হয় না আজ ডাক্তার দেখাতে পারবো। অনেক রোগী, ডাক্তার একজন। তাও আবার শিশু বিশেষজ্ঞ না।
চিকিৎসা নিতে আসা অপর রোগী বরগুনা সদরের কোরক এলাকার বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম বলেন, সকাল ৯টার আগেই এখানে এসেছি। অনেককেই দেখলাম হতাশ হয়ে চলে গেলো। এখানে সবাই রোগী। কে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে বলেন। মনের আনন্দে এখানে কেউ আসে না। চিকিৎসকদের দোষ দিচ্ছি না আমরা। কার্ডিওলোজিস্ট বিভাগের এখানে কোনো চিকিৎসক নেই। আমরা দরিদ্র, তাই বাধ্য হয়ে এখানে মেডিসিনের চিকিৎসক দেখাতে এসেছি।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীরা অভিযোগ করে বলেন, দিনে একবার করে চিকিৎসক আসেন। সকালে যে সুস্থ্য, বিকেলে তিনি অসুস্থ হলে তখন আর চিকিৎসক থাকে না। জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ছাড়া আর চিকিৎসক পাওয়া যায় না।
বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের জুনিয়র সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. মো. তারেক হাসান বলেন, অপারেশন করার সময় সহযোগী দরকার, হাসপাতালে জনবল না থাকায় ওয়ার্ড বয় ও নার্সদের নিয়ে অপারেশন করতে হয়। এছাড়া অপারেশনের পর সহকারী দরকার ,যাতে তারা রাউন্ড দিতে পারে।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, চিকিৎসক সঙ্কটের কারণে ছুটি নিতে পারি না। তিন বছর ধরে বাড়িতে যেতে পারি না। কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই যে কেউ সাহায্য করবে। জনবল সঙ্কট থাকায় সেবাপ্রত্যাশী রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাদের।
জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ লোকমান হাকিম বলেন, এই হাসপাতালে চিকিৎসক সঙ্কট চরমে। সঙ্কট নিরসনে এর আগের তত্ত্বাবধায়করাও চেষ্টা করেছেন, বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে সঙ্কটের বিষয়ে জানানো হয়েছিল। কিন্তু সমাধান হয়নি। গত মার্চ মাসে যোগদান করে নতুন করে মন্ত্রণালয় সঙ্কটের বিষয়ে লিখিতভাবে জানিয়েছি।
বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, হাসপাতালে রোগীদের চাহিদা অনুযায়ী সেবা দিতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। চিকিৎসকরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তবে, তীব্র চিকিৎসক সঙ্কট থাকায় সেটি সম্ভব হচ্ছে না। জেলা প্রশাসনের সমন্বয় সভায় চিকিৎসক সঙ্কটের বিষয়ে রেজুলেশন করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।