শম্পা সাহা
কড়াইতে ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচুর শাক হচ্ছে।উনুনে তাপ কম। তবুও রান্নাটা পুড়ছে। অথচ সেদিকে খেয়াল নেই শিউলির। তার চেতনায় রয়েছে মনোজ। ওর ঐ চোখের চাহনির মধ্যেই যে সব! মনোজের চোখের চাহনির মাদকতায় ঝড় উঠে শিউলির বুকের মধ্যে। তোলপাড় করে দেয় সব কিছু। আযানের শব্দ ভেসে আসে। মনোজের তো এ সময়ই আসার কথা আজ। দ্রুত পায়ে ঘরে যায় শিউলি। মনোজের ঘরের জানালা বন্ধ। সে এখনো আসেনি তাহলে! শাক পোড়ার গন্ধ নাকে আসে শিউলির। রান্না ঘরে গিয়ে দেখে সবটাই পুড়ে শেষ। শিউলি পছন্দ করে বলেই ইলিশ মাছ আর কচুর শাক এনেছিল ওর স্বামী নিখিল। মাথায় আগুন উঠে যায়। দু’বছরের পলাশ কাঁদতে কাঁদতে এসে দাঁড়ায়। উলঙ্গ শরীরে কাদা লেগে আছে। বিষ পিঁপড়া কামড়েছে তাকে।
চিৎকার করে ওঠে শিউলি । —–রাক্ষসের ক্ষিধা তোর পেটে।
রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘরে ছেলের ওপর।লাল দাগ বসে যায় পলাশের শরীরে। কাঁদতে কাঁদতে তবুও সে এগিয়ে যায় তার মায়ের কাছে।
শিউলির সাথে অন্তরঙ্গ হতে খুব বেশি সময় নেয়নি মনোজ। দুই বাড়ির সীমানা ঘেঁসে পাশাপাশি দুটো ঘর। মুখোমুখি জানালা। মাঝে ৪ ইঞ্চি উচু দেওয়াল। জানালায় পর্দা নেই। তাই সহজেই চোখে চোখ পড়ে। শিউলি চোখ সরিয়ে নিলেও মনোজ তার চোখ সরায় না। আলাপের প্রথম কথাটাও সেই বলে-বৌদি, একদিন এসে আপনার হাতের রান্না খেয়ে যাব।
শিউলি ভাবতেও পারেনি, সেদিন সন্ধ্যায় রান্না খেতে আসবে মনোজ। তখন মাঘ মাস। দু’দিন মেঘ করে থাকার পর দুপুর থেকে টিপটিপ বৃষ্টি। এর ওপর বাতাসের দাপট শীতকে আরো বেশি বাড়িয়ে তুলেছে। সন্ধ্যার পর পরই আসে মনোজ। শিউলি তখন বুকের দুধ দিয়ে ঘুম পাড়াচ্ছিল পলাশকে। তার ব্লাউজের বোতাম খোলা। মনোজকে দেখে বুকের অবিন্যস্ত শাড়ীটা গুছিয়ে নেয় সে। সময় গড়িয়ে যায়। চা দেওয়ার পরও উঠতে চায় না মনোজ। কত কথা। তার বাড়ির কথা, চাকরির কথা। এখানে সে বেশি দিনের জন্য আসেনি। সামনে তার প্রমোশন। বাতি নেই বিকেল থেকে। ঘরে মধ্যে কোথাও হারিকেনের মৃদু আলো আবার কোথাও অন্ধকার। চা শেষে কাপটা শিউলির হাতে তুলে দেওয়ার ওছিলায় মনোজ তার হাতের আঙ্গুল স্পর্শ করে।
তারপর শিউলির চোখে চোখ রেখে বলে-
-আপনি শব্দটা অনেক দূরের। কাউকে আপন করে কাছে আনে না। আমি কিন্তু তোমাকে তুমি করে বলব। মনোজ যাবার সময় পেছনে এসে দাঁড়ায় শিউলি। ঘুরে দাঁড়িয়ে মনোজ আবার বলে-
-আয়নায় কখনো দেখেছো নিজেকে, কতটা সুন্দর তুমি!
ঘরের দেওয়ালে টানানো ছোট আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায় শিউলি। প্রতি দিনই তো সে আয়নায় মুখ দেখে। কিন্তু এভাবে তো কোনদিন মনে হয়নি তার। মনোজ তো ভুল কিছু বলেনি। এগার-বারো বছরের বিবাহিত জীবনে দু দুটো সন্তান এসেছে ঘরে। অভাবের সংসার। তবুও অটুট তার শরীরের বন্ধন। স্তন দুটো এখনো সুপুষ্ট। শিউলি চমকে উঠে নিখিলের কণ্ঠস্বরে। কাকভেজা হয়ে এসেছে সে। রাত বাড়ার সাথে সাথে বৃষ্টিও বাড়তে থাকে।
শিউলির মনে পড়ে, চৌদ্দ কি পনের বছর বয়সে বিয়ে হয়ে এ বাড়িতে এসেছে সে। বেসরকারি
স্কুলের পিয়ন নিখিল। সংসারে মাত্র তারা দুজন। শুক্ল পক্ষের আকাশে ভরা চাঁদ। পূর্ণিমার রাতে আকাশ
ভেঙে জ্যোস্না নামে। সেই জ্যোস্না ছড়িয়ে পড়ে বাড়ির সামনের মেঠো পথে, পুকুরের জলে, বাঁশঝাড়ের মাথায়। উঠানোর কোণে দাঁড়িয়ে থাকা কদম গাছের ঘন পাতার মধ্য দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়ে মাটিতে। গাছের ছায়া দোলে মাটিতে। বসন্তের মাতাল বাতাসে আমের মুকুলের গন্ধ। শিউলিকে সাথে নিয়ে জ্যোস্না দেখে নিখিল। সবকিছু স্বপ্নের মত মনে হয় তার। স্কুলের ডিউটি করার ইউনিফরমটা দুজায়গাতে ছেঁড়া। তবুও শিউলির জন্য শাড়ি কিনে আসে নিখিল। ঈদের সময় পাওয়া মাইনের অতিরিক্ত টাকা দিয়ে শিউলির জন্য পায়ের নুপুর বানায়। তবে এতেও খুশি হয় না শিউলি। একে একে ঘরে আসে বকুল, পলাশ। সংসারের বাড়তি খরচ মেটাতে স্কুল শেষে নিখিল কাজ নেয় মিষ্টির দোকানে। অভাবের সংসার। তবুও বকুলের শরীর বাড়ন্ত। স্কুল থেকে ফিরে সে শিউলির সাথে কাজে হাত লাগায়। নিখিলের হাতে এটা সেটা এগিয়ে দেয়।
হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা সব মিলে-দিন, মাস, বছর কাটে। হঠাৎই আগন্তুকের মত শিউলির জীবনে আসে মনোজ। কারণে, অকারণে প্রায়ই সে আসে এ বাড়িতে। শিউলি অবশ্য প্রতি দিনই অপেক্ষা করে থাকে মনোজের জন্য। তার ঘন কালো চোখ দুটোতে কাজল দেবার কোন প্রয়োজন পড়ে না। তবুও চোখে কাজল দেয় সে। ঘাড়ের ওপর হালকা করে হাত খোঁপা বাঁধে। শরীরে সুগন্ধি পাউডার লাগায়। পলাশের দুধ বাঁচিয়ে রেখে মনোজের চায়ে দুধ দেয়। পলাশের প্রতি মনোজের ভালোবাসাটাও যেন একটু বেশিই। হাতে করে কিছু না কিছু সে নিয়ে আসে। কোন দিন ঝুনঝুনি, তো কোন দিন কাগজের ফুল, আবার কোন দিন পলিথিনে মোড়া চাকা লাগানো লাল প্লাস্টিকের গাড়ি। এমনকি সেদিন পলাশের ঐ ধুম জ্বরে যখন ডাক্তার দেখানো হল, তখন ডাক্তার আর ঔষুধের টাকা সেই দিয়েছে। কত টাকা উপায় করে সে! মনোজ শিউলিকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে। সত্যি যদি তাই হয়, তবে ক্ষতি কি? বৈশাখ মাস। কয়েকদিন হল কাক ফাটা রোদ। কয়েকদিন তীব্র তাপদাহের পর সেদিন বিকেলে আসে কালবৈশাখী ঝড়। ঘন অন্ধকার চারদিক। তীব্র আলোর ঝলকানি আকাশ জুড়ে। তারপর গর্জন। উত্তাল বাতাসের দাপাদাপি। ঘর ছাড়ার এই তো সময়।
বৃষ্টি থেমেছে অনেক আগেই। ঝড়ের সময় থেকেই বাতি নেই। দূরের আকাশে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকানোর আলো। পথের দুপাশে গাছের ডালপালা ভেঙে পড়ে আছে। অন্ধকারে পথ হাতড়ে হাতড়ে বাড়ি ফেরে নিখিল। উঠোনের ওপর কদম গাছের ডাল ভেঙে পড়ে আছে। শিউলিকে ডাকতে থাকে সে। কিন্তু কুপি নিয়ে শিউলি এগিয়ে আসে না। ঘরের ভেতর থেকে পলাশের কান্নার শব্দ ভেসে আসে। ঝড়ের সময় কলতলায় যাবার কথা বলে ঘর থেকে বের হয়েছিল শিউলি। কিন্তু এখনো ফেরেনি। আশপাশের লাবনীদের বাড়ি, প্রতিমা কাকীমার ঘর, রতন জেঠুর বাড়ি- সব গিয়ে খুঁজে এসেছে বকুল। কিন্তু কোথাও মা নেই। আরো দূরে পাল পাড়ায় গিয়ে দেখে এসেছে নিখিল। সেখানেও যায়নি শিউলি। রাত বাড়তে থাকে। তবুও শিউলি ফেরে না। অন্ধকার ঘরে ছেলেমেয়ে দুটো না খেয়ে জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমের ঘোরে পলাশ কাঁদছে। ওদের মাথার কাছে বিছানায় বসে আছে নিখিল। কানের কাছে মশার শব্দ। হাত পা নাড়ছে বকুল। মনে হয় ওকে মশা কামড়েছে। পলাশকে প্রতিদিনই রাতে উঠায় শিউলি। তা না হলে বিছানা ভিজিয়ে ফেলে সে। মশারির দড়িগুলো লাগিয়ে দিয়ে ঘরের বাইরে আসে নিখিল। নিকোষ কালো অন্ধকার বাইরে। কলতলায় গিয়ে তিন চার গ্লাস জল খায় সে। সারা উঠোন জুড়ে গাছের ঝরা পাতা। শুকনো মাটি বৃষ্টির জল পেয়ে আজ তৃপ্ত। কয়েক দিনের তপ্ত দাবদাহের পর আজ এই শীতলতা। বারান্দার সিঁড়িতে এসে বসে নিখিল। এই শীতলতা তার শরীরে কাঁপুনি এনে দিচ্ছে। হঠাৎ পায়ের শব্দে চমকে উঠে সে। শিউলি এসেছে তাহলে! ক্ষণিকের জন্য যে চিন্তার ভার নেমে গিয়েছিল, সে আশা মনের মধ্যে জেগে উঠেছিল। মূহুর্তেই তা নিভে যায়। অন্ধকারে কিছু চোখে না পড়লেও বুঝতে পারে, অন্ধকারে যে এগিয়ে আসছে সে নারী নয়, পুরুষ। কুপিটা তুলে ধরে চেনার চেষ্টা করে নিখিল। বিশু কাকা।
-বৌমা ফেরে নায়? ঝগড়া হইছে নাকি তার সাথে? – পোলা, মাইয়া রাইখা কই যাবে? – এই ঝড়ের রাতে
কোন আপদ বিপদে পড়ছে কিনা কে জানে?
-কোথাও যাবে সে তো একবারও বলে নায় আমাকে। আশপাশের-বাড়িঘরে সব জায়গাতেই ———
। হাঁটতে হাঁটতে পাল পাড়ায় পর্যন্ত খোঁজ নিছি, কোথাও নেই। হারিকেন নিয়ে কাকীমার সাথে কানুর বৌ এসে দাঁড়িয়েছে।
-মনোজের ঘর তো তালা। দুজনকি এক লগে কোথাও গেল তাহলে? দুপুরে দেখছিলাম, দুজন কথা বলতাছে।
সন্দেহটা নিখিলের মনে আসেনি তা নয়। তবে সেই সন্দেহটা এখন সত্যি বলে মনে হচ্ছে। আকাশের দিকে তাকায় নিখিল। দু-একটা করে তারা উঠতে শুরু করেছে আকাশে। গাছের পাতার আড়ালে এক ফালি চাঁদ দেখা যাচ্ছে। পেটের ক্ষুধাকে ছাপিয়ে মনের জ্বালা পুড়িয়ে শেষ করছে তাকে। এত বছরের বিবাহিত জীবনে তার ভালবাসা শিউলিকে আপন করতে পারেনি। আর মনোজের কয়েক মাসের পরিচয় আপন করে নিল ওকে। এক জনকে মনের মধ্যে রেখে সে সংসার করেছে অন্য জনের সাথে। সারা রাত জেগে শিউলির জন্য অপেক্ষা করতে থাকে নিখিল। মনোজের সাথে রাত কাটিয়ে এলেও বকুল আর পলাশের কথা ভেবে সে শিউলিকে মেনে নেবে। কাউকে সে কিছু বলবে না। ঘরের বৌকে সংসার ছেড়ে যে বাইরে নিয়ে আসে, সন্তানের থেকে যে মাকে দূরে নিয়ে যায়, সে আর যাই হোক, ভালো মানুষ যে নয় এটা বুঝতে পারলো না শিউলি। আবার ক্ষুধায় কান্না শুরু করে পলাশ। কুপি নিয়ে শিকল খুলে রান্না ঘরে ঢোকে নিখিল। উনুনের ওপর কড়াইতে দুধ জ্বাল দেওয়া ছিল। জানালা খোলা পেয়ে বিড়াল এসে খেয়ে গেছে। রাতের ভাত, তরকারি, ডাল ঢাকা দেওয়া ছিল। ঢাকা উঠাতেই নষ্ট হয়ে যাওয়া গন্ধ নাকে এল। পলাশের কান্না থামাতে ঘরে যায় নিখিল। কোলে নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে আবার শুইয়ে দেয় বিছানায়। সারারাত নির্ঘুম কাটে তার। মোরগের ডাক ভেসে আসে। পাখিরাও জেগে উঠে। চারিদিকের অন্ধকার ধীরে ধীরে কমে এলে বাজারের দিকে পা বাড়ায় নিখিল। শিউলির যদি কোন খোঁজ পাওয়া যায়। সব জায়গাতেই গতকালের ঝড়ের চি হ্ন রয়ে গেছে। বাজার পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই দেখা হয় জব্বারের সাথে।
-তোমার বউ, কি যেন নাম——-। সাথে ছেলে মেয়ে নায়। তোমার কোন এক আত্মীয়ের লগে তারে
দেখলাম অত রাতে। মামলার জন্য কাইল জামালপুর যাইতে হইছিল। ঝড়ের জন্য ফিরতে ফিরতে অত রাত। বাস স্ট্যান্ডে দেখলাম তারে।
(চলবে)