শম্পা সাহা
জব্বারের সঙ্গে আর কথা বাড়ায় না নিখিল। শুধু তার যাবার পথে তাকিয়ে থাকে। পূব আকাশ আলো করে সূর্য উঠেছে। কাঁচা সোনার মত রোদ। কাল সারারাত ধরে ছেলে মেয়েগুলো না খেয়ে আছে। তাড়াতাড়ি পা চালাতে চায় সে।কিন্তু পারে না। যেন অসম্ভব ভারী। মাথার ভেতরটা কেমন করে উঠে। সন্তান, সংসার সব ছেড়ে শিউলি তার জীবন থেকে চলে গিয়েছে । কি দিয়েছে মনোজ তাকে? আর কি পায়নি সে তার কাছ থেকে? বকুল, পলাশের কাছে গিয়ে কি বলবে সে? রাগে, দুঃখে, অপমানে, ঘৃণায় চোখে জল আসে নিখিলের। এর চাইতে শিউলির মৃত্যু সংবাদ দুঃখের হলেও এর মাঝেও সান্ত্বনা ছিল। কিন্তু আজ শিউলির বেঁচে থাকার এই সংবাদ তার কাছে নিরানন্দের, ঘৃণার, অপমানের, লজ্জার।
শিউলি চলে গেছে আজ অনেক দিন। দিন গড়িয়ে মাস। এরপর মাস ও শেষ হতে চলল। প্রথম প্রথম আত্মীয়-অনাত্মীয়, পরিচিদ-অপরিচিত অনাহুত সবাই এসেছে বাড়িতে। শিউলির কথা সবাই শুনতে চায়, জানতে চায়। এর মাঝে কেউ কেউ মুখ টিপে হাসে, অন্যের শরীরে টিপন্নী কাটে। দুই/চার দিন পাড়া প্রতিবেশীরা খাবার দিয়ে গিয়েছে। তারপর কখনো স্কুলে যাবার আগে ভোরে, কখনো দুপুরে, কখনো রাতে রান্না করে নিখিল। উনুন ধরানো, ভাত রান্না কত সহজ কাজ। অথচ- কখনো এই ভাত গলে চালের গুঁড়ার কাই হয়ে যায়, কখনো আধা সিদ্ধ, আবার কখনো ভাত পুড়ে গন্ধে ভরে উঠে চারিদিক। কয়লা, খড়ি, পাঠকাটি দিয়ে উনুন জ্বালানোও কত কঠিন। সহজে আগুন জ্বলে না। সারা ঘরময় ধোঁয়া। শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়ায় ভরে উঠে। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। উনুনের গর্তে তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করে শেষ পর্যন্ত আগুন জ্বালায় বকুল। ধোঁয়া শেষে উনুনে আগুন জ্বালাতে পেরে খুশিতে ভরে উঠে বকুলের চোখ। খুশিতে, আনন্দে নিখিলকে ডাকে উনুনের আগুন দেখাতে। বকুলের মুখের দিকে তাকিয়ে থমকে যায় নিখিল। শ্যামলা মুখে বকুলের ঘন কারো চোখ দুটি অবিকল শিউলির মত। ওর দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা হুহু করতে থাকে নিখিলের। মা চলে গেছে পর পুরুষের সাথে। সংসারের জোয়াল দিয়ে গেছে তার কাঁধে। এটুকু বুঝতে পারছে না মেয়েটা। উনুনের আগুন জ্বালাবার মত তুচ্ছ, নগণ্য ঘটনায় সে কত খুশি। অবোধ নিষ্পাপ শিশু। ঘেমে নেয়ে উঠেছে মেয়েটা। অযত্নে অবহেলায় থাকা চুলগুলো ঘামে কপালের সাথে লেগে আছে। বুকটা ভারি হয়ে আসে নিখিলের। এগিয়ে এসে বকুলের কপালের উপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে সে। মা নেই ওদের। সব কিছু এলোমেলো। অগোছালো হয়ে গেছে ওদের জীবন। কোন বাঁধা নিষেধ নেই, নিয়ম নেই, সময়মত ঘুম থেকে উঠা নেই, খাওয়া নেই। স্কুলও নেই বকুলের। সপ্তাহের পাঁচ দিন বকুল অপেক্ষা করে থাকে দুদিন স্কুল ছুটির জন্য। বাবা বাড়ি থাকলে সেদিন বকুলের আনন্দ দেখে কে ! রান্নার সময় বাবার হাতের কাছে সব কিছু এগিয়ে দেয় বকুল।স্নানের সময় বাবা বকুলের মাথায় তেল দিয়ে দেয়। মায়ের মত করে রাতে চুল বেঁধে দেয়। আদর করে খাইয়ে দেয়। অন্য দিন তাকেই পলাশকে খাইয়ে দিতে হয়। স্নান করিয়ে দিতে হয়। মাকে না পেয়ে পলাশও সারাদিন বকুলের পিছে পিছে ঘোরে। কলতলা, রান্না ঘর সব জায়গাতেই। বকুলও যদি তাকে ছেড়ে চলে যায়। তাই পিছন থেকে পলাশ এসে বকুলের ফ্রকটা শক্ত করে ধরে রাখে। বর্ষা নামে। বর্ষার জলে আগাছা, ঘাস, লতাপাতা সব নিলর্জ্জের মত বেড়ে উঠে। গাছের পাতা পড়ে নোংরা হয়ে থাকে উঠোন। রান্না ঘরের মরচে পড়া টিনের চাল দিয়ে বৃষ্টির জল পড়ে। খড়ি, পাঠকাঠি সব ভিজে যায়। তরকারির ঝুড়িতে রাখা আলু, পেঁয়াজ পচে বিশ্রী গন্ধ বের হয়। ঘরে ঢুকলেই বিছানা, বালিশ, মশারির স্যাঁতস্যাঁতে, ভাপসা গন্ধ নাকে আসে। উঠোনের তারে মেলে রাখা জামা-কাপড়গুলো বৃষ্টির জলে ভিজে চুইয়ে চুইয়ে জল পড়তে থাকে। কোন কোন দিন হয়ত নিখিল মিষ্টির দোকান থেকে ফিরে দেখতে পায় পলাশ আর বকুল ঘর খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছে। সত্য মিথ্যার বীজ থেকে গাছ জন্মে। সেই গাছের ডালপালা ছড়ায় আরো দূরে। হাট বাজার, স্কুল-দোকান, পাড়া-প্রতিবেশী সবজায়গাতেই নিখিলকে নিয়ে আলোচনা। নিখিলকে দেখে কেউ কেই চাপা গলায় কথা বলে, আবার কেউ কেউ একে অপরের চোখে চোখে হাসে। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কখনো কখনো কত কথা কানে আসে। নিখিলকে নিয়ে এই সমালোচানা, এই উপেক্ষা যেমন শেষ হয় না, তেমনি-নিখিলের মনেও শিউলির ফিরে আসার স্বপ্নও ভাঙে না। কখনো মনে হয়, স্কুল থেকে ফিরে গিয়ে দেখবে শিউলি রান্না শেষে বিছানা, আলনা সব গুছিয়ে রেখেছে।
নিখিলকে দেখে অনুযোগের স্বরে বলে উঠছে;
-কদিন মাত্র আমি ছিলাম না, আর ঘর বাড়ির কি অবস্থা করে রেখেছো সব?
আবার কখনো কখনো সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখ আটকে যায় লেবু গাছের আড়ালে। মনে হয় শিউলি এসে দাঁড়িয়ে আছে ঔ গাছ তলায়, নিখিলকে দেখে কাছে এসে বলছে-
-জানি আমি ভুল করেছি। তবে, তুমি আমায় ক্ষমা করে দাও।
মনের মধ্যে ঐ আশা বেঁচে আছে বলেই হয়ত আলনায় রেখে যাওয়া শিউলির কাপড়গুলো সে সাবান জলে পরিস্কার করে ট্রাঙ্কের নীচে রেখে দিয়েছে। স্কুলে যাবার সময় কতবার সে শিউলিকে ডেকে বলতে যায়- আমার স্কুলের জামা, কলম সব একসাথে রেখে দাও। থমকে দাঁড়াতে হয় নিখিলকে। তবে এই থমকে তার যাওয়া নিজের সাথে। কিন্তু সেদিন! সেদিন সে শুধু থমকে দাঁড়ায়নি, চমকে উঠেছিল। কি কারণে সেদিন স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়েছিল। বাড়ি ফেরার পথে নিখিল দেখে, বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে রেললাইনের ধারে পােরশর হাত ধরে বকুল দাঁড়িয়ে আছে। এই পথেই মা আসবে। তাই ওরা দাঁড়িয়ে আছে এখানে। প্রায়ই আসে। মায়ের ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকে। কথা শুনে নির্বাক হয়ে যায় নিখিল। সে জানে, পলাশ আর বকুলের এই অপেক্ষা অর্থহীন। শিউলি কোন দিনই ফিরে আসবে না তাদের জীবনে। তবুও একথাটা সে বলতে পারে না। সত্যি হোক, মিথ্যা হোক তবুও ত আশা। মনের কোণে স্বপ্ন দেখতে, অপেক্ষায় থাকতে কোন বাঁধা নেই। মনের জামিনেই তো দিনের পর দিন স্বপ্নেরা বড় হয়। এই স্বপ্ন, এই আশা পূরণের আকাঙ্খাই তো জীবন। এই মিথ্যা স্বপ্ন হৃদয়ে লালন করেই না হয়, ওদের জীবনের পথ লা শুরু হোক।
আরো পড়ুন: আঁধারে আলো || ১ম পর্ব
গতকাল স্কুলে যেতে পারেনি নিখিল। খুব জ্বর ছিল পলাশের। ওকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে স্কুলে গিয়েছে সে।ঘুম ভাঙার পর কিছুতেই ওর কান্না থামাতে পারছে না বকুল। পলাশকে কোলে নিয়ে হারু চাচার দোকানে আসে সে। কাঠি লজেন্স কিনে দেয়। দোকানের সামনে আম গাছের ছায়ায় পাতা বেঞ্চে বসে আছে পাড়ারই তপন, আমিন, নুরুল। বকুলকে দেখে প্রশ্ন করে-
-কিরে, তোর মা কার লগে গেছে? কই গেছে?
লজেন্সটা হাতেও নেয় না পলাশ। আরো বেশি কাঁদতে শুরু করে। জ্বর হয়ত এখন বেশি। বকুলের কথার উত্তর না পেয়ে ওরা আবার বলে,
-তোর মা ক্যান চলে গেছে, জানতে চাস না?
ওদের চোখে মুখে অন্য এক ধরণের হাসি। বিকৃত সে আনন্দ। সালামের দাদী মারা গেল, মাটিতে চাপা দিল। শ্যামল কাকার বাবা মারা গেল, শ্বশ্বানে গিয়ে পুড়িয়ে দিল। মারা গেলে কেউ ফিরে আসে না। তাহলে
————— । তার মা নিশ্চয় ফিরে আসবে। দৃঢ় গলায় বকুল বলে
-মা একদিন আসবে।
-হ্যাঁ, সাথে করে তোদের নতুন বাবা নিয়ে আসবে।
বকুল চলে এলেও ওদের কথা, হাসি কিছুই থামে না। দূর থেকে তার কানে আসে-তোদের দুই বাবা হবে। তারপর অনেক মজা। হা————-হা———– হি হি।
এই বিকৃত আনন্দ, এই কথা, এই হাসি প্রথম নয়, আবার শেষও নয়। বহু জায়গায়, বহু জনের কাছে সে শুনেছে এই সব। আর এই সব কিছুই বকুলকে বুঝিয়ে দিয়েছে তার মা আর কোন দিন ফিরে আসবে না। তাই সে, এখন সন্ধ্যা বেলা তুলসী তলায় মার ফিরে আসার জন্য বলে না। কতদিন হয়ে গেল, সে এখন আকাশে সূর্য ডোবা দেখে না, সকালে সন্ধ্যায় গাছের মাথায় পাখির কিচির মিচির শব্দ শোনে না। বৈশাখের ঝড়ে পারুলদের বাগানে গিয়ে আম কুড়ায় না। শিলা বৃষ্টিতে গামছায় শিল জমা করে না, গরমের দুপুরে সীমা, নার্গিস, বানু, রত্না সবার সাথে পুকুরের জলে গিয়ে দাপাদাপি করে না। বর্ষায় কালো আকাশ দেখে না। দিনের আলো উঠার আগে শিউলি ফুল কুড়িয়ে আনে না। স্কুলের পুরোনো টিনের বাক্সে বকুলের পুতুলের সংসার। দুটো ছেলে, দুটো মেয়ে। বিনুদের বাড়ির উঠোনে লেবু গাছের নিচে ওরা খেলত। লাবনীর ছেলের সাথে বকুলের মেয়ের বিয়ে হবার কথা ছিল। খাটের তলায় কোন কোনায় সেই বাক্স পড়ে আছে। ধুলার ওপর ধুলা জমেছে সেখানে। লাবনী, রত্না, নার্গিস লতা ওদের সাথে পুকুর পাড়ে খড়ের গাদার ছায়ায় ছোট ছোট এলুমিনিয়ামের হাড়ি কড়াইতে ভাত, তরকারি, রান্না করত। লাবনীর মা মাটি দিয়ে ছোট একটা উনুন বানিয়ে দিয়েছিল, সেই উনুনে বালি দিয়ে ভাত রান্না হত। জলের মধ্যে ইটের গুড়া মিশিয়ে ডাল আর ঘাস, লতাপাতা দিয়ে তরকারি। বিপুল, কামাল, রঞ্জিত সুযোগ পেলের এসে সব উল্টে দিয়ে ভেংচি কাটত। সেই ছোট ছোট বাসনগুলো রান্না ঘরে পাটকাঠি রাখার চৌকির ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। রত্না এসে একদিন সেগুলো নিয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকে সেগুলো ওদের দখলে। খেলার সময় ওরা প্রথম প্রথম ডাকতে আসত। পলাশকে কোলে নিয়ে বকুল মাঝে মাঝে গিয়ে দাঁড়াত খেলার কাছে। তবে এখন আর সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেও ইচ্ছে হয় না তার।
চলবে…