আকাশভরা সূর্য–তারা বিশ্বভরা প্রাণ…
প্রশ্নটা শুধু বিজ্ঞানীদের নয়, সাধারণ মানুষেরও। সেই আদিকাল থেকে মানুষ বিভিন্নভাবে এই প্রশ্ন করে আসছে। এর উত্তর সবাই খুঁজছে, আমরা এলাম কোথা হতে, এই বিশাল মহাবিশ্বে কি আমরা একা?
আদিম মানুষেরা রাতের অন্ধকারে অনন্ত নক্ষত্র বিথির দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে হতবাক হতো। সেই একই বিস্ময় নিয়ে এখনো বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের দিকে তাকান। জানার মাঝে অজানার খোঁজ করেন। এই উত্তর বিজ্ঞান নিশ্চিতভাবে এখনো পায়নি। তবে সেই মহাজাগতিক উত্তরের আরেকটু কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার জন্য ২০১৯ সালের পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পেলেন একজন কানাডীয়-আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং দুজন সুইস বিজ্ঞানী।
এই বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বে মানুষের যে একাকিত্বের কথা বলেন সেটা আসলে কেমন, তা বুঝতে হলে একটু আন্দাজ পাওয়া দরকার যে আমাদের মহাবিশ্ব কত বড়? কয়েক ধাপে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করা যাক। আমাদের সূর্য যে ছায়াপথে সেখানে নক্ষত্র আছে প্রায় ২৫–৪০ হাজার কোটি। আর হাবল টেলিস্কোপ দিয়ে যে আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছে, তার থেকে বিজ্ঞানীরা বলছেন দৃশ্যমান মহাবিশ্বে এ রকম ছায়াপথ বা গ্যালাক্সির সংখ্যা হতে পারে ১০০ থেকে ২০০ লাখ কোটি।
কিন্তু এগুলো তো কেবল কিছু সংখ্যা। আসলে এই মহাবিশ্ব কত বড়? আলো হচ্ছে সবচেয়ে দ্রুতগতির। এই আলো এত দ্রুত চলে যে আলোর গতিতে চলতে পারলে এক সেকেন্ডে পৃথিবীকে সাড়ে সাতবার ঘুরে আসা যাবে। আর এই আলোর গতিতে আমাদের ছায়াপথ আকাশগঙ্গা পার হতে লাগবে দেড় লাখ বছর। এখন পর্যন্ত পাওয়া হিসাবে আলোর গতিতে গেলে পুরো মহাবিশ্ব পার হতে লাগবে ৯৩০০ কোটি বছর! মনে রাখবেন এ কেবল এখন পর্যন্ত পাওয়া হিসাব। এটা আরও অকল্পনীয় রকম বড় হতে পারে।
এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে মানুষ এখন পর্যন্ত আর কোনো প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি। তাহলে কী পৃথিবী এই বিশাল মহাবিশ্ব নামক মরুতে একমাত্র সবুজ ঘাস? মহাবিশ্বের এই বিপুল বিস্তৃতি কি কেবলই প্রাণহীন অপচয়? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজায় দুভাবে অবদান রেখে এই বছরের পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পেলেন তিন বিজ্ঞানী।
কানাডায় জন্ম নেওয়া প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৪ বছর বয়সী প্রফেসর ইমেরিটাস জেমস পিবলস দিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক উত্তর। প্রায় ১৪০০ কোটি বছর আগে এই মহাবিশ্বের জন্ম এখনো পুরো না জানা এক অবস্থা হতে। একে বলা হয় বিগ ব্যাং, বাংলায় যাকে বলা যায় মহাবিস্ফোরণ। সেই বিস্ফোরণ থেকেই আজ আমরা যা দেখি, আন্দাজ করি এ রকম সবকিছুর জন্ম। কিন্তু সেই বিস্ফোরণের পর পর যখন কিছুই আজকের মতো ছিল না, সেই সময়ের কথা জানতে অবদান রেখেছেন জেমস পিবলস। পিবলস বর্তমান সময়ের একজন অন্যতম জ্যোতির্বিজ্ঞানী। বিগ ব্যাংয়ের যে চলমান অবশেষ আমরা দেখতে পাই, তাকে বিজ্ঞানীরা বলেন ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন। টিভিতে হঠাৎ করে চ্যানেল সম্প্রচার বন্ধ হলে ফাঁকা পর্দায় যে ঝিরঝির দেখতে পাই, তা এই ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন। সৃষ্টির সেই অব্যাখ্যাত সময়কে বুঝতে এই রেডিয়েশনের গুরুত্ব বুঝতে অবদান রাখেন পিবলস।
আরেক দিকে আছেন দুই সুইস বিজ্ঞানী মাইকেল মেয়র ও দিদিয়ের কুয়েলজ। দুজনই জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত। তাঁরা আবিষ্কার করেছেন সৌরলোকের বাইরে সূর্যের মতো নক্ষত্র ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে গ্রহ, যাকে বলে এক্সোপ্ল্যানেট। মেয়র ও কুয়েলজ ১৯৯৫ সালে ৫১ পেগাসি বি নামে সৌরজগতের বাইরের নক্ষত্রে বৃহস্পতির আকারের গ্রহ প্রথম আবিষ্কার করেন। সেই সময় কেউ নিশ্চিত ছিল না যে বাস্তবে বাইরের নক্ষত্রগুলোতে গ্রহ আদৌ আছে কি না। মহাবিশ্বে আমরা আদৌ একা কি না, সেই অনুসন্ধানে ছিল এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর মেয়র বলেছেন, ‘আমরা হয়তো কোনো এক রকমের প্রাণ আবিষ্কার করতে পারব। তবে সেই প্রাণের ধরন কেমন হবে, তা আমরা জানি না।’
নাসা কেপলার নামে একটি টেলিস্কোপ পাঠায় মহাকাশে। এর প্রধান দায়িত্ব ছিল পৃথিবীর মতো গ্রহ খুঁজে বের করা। ২০১৩ সালে কেপলার স্পেস মিশনের প্রাথমিক তথ্য বিশ্লেষণ করে চমকে ওঠেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা দেখলেন, কেবল আমদের ছায়াপথেই সূর্যের মতো নক্ষত্রের বাসযোগ্য এলাকাতে গ্রহের সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার কোটি। বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন চূড়ান্ত বিশ্লেষণে এই সংখ্যা হয়তো এত বেশি হবে না। কিন্তু এই বছরের আগস্ট মাসে দা অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল জার্নালের সংখ্যায় প্রকাশ পেল যে আমাদের ছায়াপথে কেবল পৃথিবীর মতো উষ্ণ আরামদায়ক গ্রহের সংখ্যা হতে পারে ১ হাজার কোটি! এগুলোতে তরল পানি থাকতে পারে, যা প্রাণের পূর্বশর্ত। সূর্যের মতো নক্ষত্রগুলোর প্রতি চারটির একটিতে পৃথিবীর মতো গ্রহ থাকতে পারে।
আজ রাতে যদি আপনি আকাশের দিকে তাকান, তাহলে ভাববেন যে তারাগুলো দেখছেন এদের ২০ থেকে ৫০ শতাংশ তারার পৃথিবীর মতো গ্রহ আছে। সেই গ্রহগুলোর কোনো একটাতে হয়তো আপনার মতো কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী আকাশের দিকে তাকিয়ে আপনার মতোই ভাবছেন—আর কোথাও কি প্রাণ আছে?