-সাবরিনা নিপু
সেদিন আজিজ সুপার মার্কেট এর এক বই এর দোকানে আচমকাই দেখা হয়ে গেল রূপার সাথে! বছর দশেকতো হবেই, নাকি তার চেয়েও বেশী? শেষ দেখা কবে হয়েছিল আজ আর মনে নেই।
সেই একই রকম স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে ছিল সারা মুখে বয়সের ছাপ কি একটু পড়েছে চোখে মুখে? নাহ! বরং, শরীরটা একটু ভারী হয়েছে বোধ হয় তবে, তাতে তার সৌন্দর্যে এতটুকু ভাটা পড়েনি কোথাও!
ও ছিল বীথির রুমমেট, ওরা থাকত রোকেয়া হলে! হল গেটে গিয়ে দাড়ালে প্রায়ই দেখা হয়ে যেত ওর সঙ্গেওর হাতেই শ্লিপ ধরিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করতাম হাকিম চত্তরে, কিংবা টিএসসির বারান্দায়।
খুব একটা কথা কখনও হয়েছে বলে মনে পড়ে না শুধু শ্লিপ দেয়া নেয়ার সময় হাতের আলতো ছোঁয়া অথবা ক্যাফেটেরিয়ায় বা লাইব্রেরিতে কখনও! চোখে চোখ পড়লেই দৃষ্টি সরিয়ে নেয়া।
আমার বিষয় ছিল ইতিহাস ওর দর্শন! ওর ডিপার্টমেন্ট দোতলায় আমার নিচতলায় নামা ওঠার পথে দেখা হয়ে যেত প্রায় দিনই নাকি ইচ্ছে করেই ওই সিঁডি ব্যবহার করতাম? কি জানি! দেখা হলেই বলত বীথিকে ডেকে দিচ্ছি, ভাল আছেনতো?
সেদিনও কুশল বিনিময় করল একই ভঙ্গিতে আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, ‘আপনার আপত্তি না থাকলে এক কাপ কফি কি হতে পারে’? আমিও মাথা নেড়ে বললাম, ‘নিশ্চই পারে’
একথা সেকথার পর জানলাম ওর স্বামী একজন গবেষক! যুক্তরাষ্ট্র এর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন এক ছেলে নিয়ে ও দেশেই থাকে, প্রবাসী জীবন ভাল লাগেনা বলে ছ’মাস পর পর আসা যাওয়া
করে।
বলল, ‘বীথি এখন ক্যালিফোর্নিয়ায় ওর দুই ছেলে, স্বামী ডাক্তার।’ এই দশ বছরে একটি বারের জন্যেও দেশে আসেনি দেশের ওয়েদার স্যুট করেনা বলে।
সব শুনে বললাম, ও সুখী হয়েছেতো? মৃদু হেসে বলল, ‘এ জীবনে সুখী হয়েছে ক’জন’? আপনি, আমি, আমরা কেউ কি সুখী? নাকি সুখী হবার অভিনয় করে যাচ্ছি সারাক্ষণ?
রুপার প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টে দিতে বললাম আকাশী রঙের শাড়ীতে তোমায় মানিয়েছে বেশ তুমি কিন্তু ঠিক আগের মতই আছো ।
এ কথা শুনে স্মিত হেসে বলল আমাদের সবুজ মুহূর্তগুলো সেই কবে অকারণে খরচ করে ফেলেছি অবলীলায় এক সমুদ্র ঢেউ রেখে গেছে তার জলছাপ ।
আমি ওর কথা শুনে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থেকে বলি এত সুন্দর করে কথা বল তুমি! শুনে আমার চোখের দিকে স্থির তাকিয়ে থেকে বলল তখনও একই ভাবে কথা বলতাম, কখনও লক্ষ্যই করেননি।
আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকাই দেখি সন্ধ্যার মতো একেবারে গুটিয়ে বসে আছে লজ্জাবতী গাছের মতো এক বিন্দু যেন ভাবি, এ রহস্যই কি আমাদের জীবন যাপন?
বীথি ছিল ভীষন অশান্ত আর একরোখা স্বভাবের এই কারণেই ওর সঙ্গ আমার ভাল লাগতো ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ঠিক বন্ধুত্বের না প্রেমের ছিল তা এখনও আমার কাছে বিস্ময়! তবে ওর সাথে দেখা না হলে অস্থির হয়ে উঠতাম মনে মনে অথচ, ওর চাওয়ার হিসেব ছিল খুব অস্পষ্ট। কত সকাল সন্ধ্যা এক সঙ্গে কেটেছে আমাদের টিএসসি, হাকিমতলায়, মলে কিংবা লাইব্রেরিতে। কতদিন বৃষ্টিতে ভিজে হাত ধরাধরি করে ঢুকেছি কলা ভবনে অথবা, রিকশায় চড়ে
শাহবাগে।
বড় দাগ কেটেছিল সেদিন ওর কথায়। যেদিন ওর বিয়ের কার্ড হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল, আমার বিয়ের সব ছবি কিন্তু তোকেই তুলতে হবে। খুব চেনা মানুষকে মনে হয়েছিল অচেনা ভীষন।
আশ্চর্য কষ্টে আমার অনুভবের ইতিকথাগুলো মুহূর্তের জন্য থেমে গিয়েছিল সেদিন। দীর্ঘ অভিমান মিশে গিয়েছিল দ্রবীভ‚ত মায়ায়। মুখ ফুটে বলা হয়নি কোনদিন। ভরা নদীরও কিছু বলার ছিল সমুদ্রের কাছে।
ভাবনার সুতো ছিড়ল রুপার ডাকে
কি অত ভেবে চলেছেন তখন থেকে ?
আড়ালে যা ছিল তা আড়ালেই না হয় থাক
চলুন, এবার ওঠা যাক।