-জসিম মল্লিক
এটা কোনো ভ্রমণ কাহিনী না। ভ্রমন কাহিনী যেমন খুব গোছানো আর তথ্যে ঠাসা থাকে এই লেখা তা না। এলেবেলে টাইপ লেখা। অথচ আমি ভ্রমণ কাহিনী পড়ে পড়েই বিদেশের প্রতি আকৃষ্ট হই। আমি প্রচুর ভ্রমণ কাহিনী পড়তাম একসময়। বাংলাদেশের শাকুর মজিদ এবং ফারুক মাঈনুদ্দিনের লেখা আমি পড়ি। শংকর, সুনীল, সমরেশ এদের লেখাতো পড়ে ভাজা ভাজা করেছি। আমি যখন দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াই তখন একবারও মনে হয় না এসব নিয়ে আমাকে লিখতে হবে। আমি ঘুরে বেড়াই আনন্দ পাবার জন্য। বেড়াতে আমি ভালবাসি। একটা নতুন জায়গা দেখার অন্যরকম একটা ব্যঞ্জনা আছে। নতুন জায়গার নতুন সকাল সবসময় আমাকে আন্দোলিত করে।
প্রতিটা জায়গার একটা আলাদা রুপ আছে। এমনকি আমি এখনও যখন বরিশাল যাই, বরিশাল আমার জন্মভূমি, এর প্রতিটা ধুলিকনা আমার চেনা, প্রতিটা অলি গলি আমার মুখস্থ। যখন কলেজে পড়তাম সাইকেলে চেপে চষে বেড়াতাম পুরো শহর। বিকেল হলে চলে যেতাম মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তারদের কোয়াটারে। সেখানে ডাক্তারদের সুন্দরী কন্যাদের দেখতে যেতাম। এখনও বরিশালের মাটিতে পা দিলেই আমি শিহরিত হই! ফিরে যাই আমার শৈশব, কৈশোরে।
বইয়ের পাতায় অন্য দেশের গল্প পড়তে পড়তে একটা স্বপ্নে ঘোর আমার চোখের সামনে সবসময় ঘুরপাক খেতো। সেটা ২০০০ সাল। আমি আমেরিকা যাচ্ছি বেড়াতে। ঢাকা থেকে এমিরেটসের ফ্লাইট। হিথ্রো হয়ে নিউইয়র্ক। তখনও এমরিটেসের ডিরেক্ট ফ্লাইট চালু হয়নি। হিথ্রো থেকে নিউইয়র্ক যেতে হতো আমেরিকান এয়ারলাইন্সে।
দুবাইতে বারো ঘন্টার ট্রানজিট ছিল। আমি হোটেলে চেক ইন করেই বেড়িয়ে পরলাম। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমি যেখানেই যাই না কেনো সবসময় একটা ভীতি কাজ করে আমার মধ্যে। সবসময় মনে হয় আমি হারিয়ে যাব। এই ভীতি নিয়েই অনেক ঘুরে বেড়িয়েছি। হারালেও এক সময় না এক সময় আমি ফিরব সেটা নিশ্চিত।
হোটেলের গেটেই এক শিখ ট্রাক্সি ড্রাইভার পেলাম। তাকে বললাম, সার্দারজি আমাকে দুবাই শহরটা একটু ঘুরিয়ে দেখাও।
এক ঘন্টা মাত্র ঘুরলাম। ১৮ ইউ এস ডলার বিল উঠল। এক ঘন্টায় তেমন কিছু দেখা হয় না।
এরপর আরো অনেকবার দুবাই বা আবুধাবি হয়ে কানাডা গিয়েছি বা বাংলাদেশে এসেছি। কিন্তু কখনো দুবাইতে থাকা হয়নি। কেনো হয় নি কে জানে। আমি দেশে যাওয়ার সময় মাঝে মাঝে কোথাও না কোথাও স্টপ নেই বা দেশে গিয়ে কোথাও না কোথাও ঘুরতে যাই। এক ঢিলে দুই পাখী মারা আর কি। এবারও তাই করলাম।
এ বছর ২১ জানুয়ারি সকালে দুবাই নামলাম। আমাকে পিকআপ করার কথা দিবার। অরিত্রি আমাকে আগেই হোটেল বুকিং করে দিয়েছে। হিলটন দুবাই।
ইমিগ্রেশন শেষ করে লাগেজ নিয়ে অপেক্ষা করছি। কাউকে দেখিনাতো! কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। তাহলে কি ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাব হোটেলে! দিবার সাথে আমার আগে দেখা হয়নি কিন্তু দেখলেই চিনব। ওয়াইফাই কানেক্ট করে ম্যাসেঞ্জারে ফোন দিলাম। ফোন ধরল না। মনে হয় ভুলে গেছে।
বুদ্ধি করে সুমনকে ম্যাসেঞ্জারে ফোন দিলাম। সুমন ফোন ধরল।
এসেছেন আপনি!
হ্যাঁ। কিন্তু যার পিকআপ করার কথা সেতো আসে নাই। তুমি একটা ফোন দাওতো তার নম্বরে।
আচ্ছা নম্বর বলেন, আমি কল করতেছি।
একটু পর সুমন বলল, ওনারা আসতেছেন। ওনাদের গাড়ি খারাপ হইছিল তাই দেরি হচ্ছে। গ্যারেজ থেকে আর একটা গাড়ি নিয়ে আসতেছে।
পনেরো মিনিটের মধ্যে দেখি দিবা আর ওর হাজবেন্ড এসেছে।
যেতে যেতে লাঞ্চ টাইম হয়ে গেছে। একটা বাঙ্গালি রেষ্টুরেন্ট চমৎকার লাঞ্চ করি আমরা। তারপর আমাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে ওরা চলে যায়। দুবাই সম্পর্কে কিছু তথ্যঃ
Dubai is located on the Eastern coast of the Arabian Peninsula, in the south west corner of the Arabian Gulf. It is extremely well known for its warm hospitality and rich cultural heritage, and the Emirati people are welcoming and generous in their approach to visitors. With year-round sunshine, intriguing deserts, beautiful beaches, luxurious hotels and shopping malls, fascinating heritage attractions and a thriving business community, Dubai receives millions of leisure and business visitors each year from around the world.
সুমন কোনো সেলিব্রেটি না। মানে শাহরুখ খান, সালমান খান বা শাকিব খানের মতো সেলিব্রেটি না। কিন্তু ফেসবুকে সুমনের ফলোয়ারের সংখ্যা টাসকি খাওয়ার মতো। প্রায় ৪২ হাজার! মাই গড!
সুমন তোমার এতো ফেলোয়ার কেমনে হলো!
সুমন হেসে বলল, আমিও জানি না কেমনে হলো।
রহস্যটা কি খুইলা বলো।
সুমন আমার কথায় লজ্জা পায়। তারপর কিছু কলা কৌশলের কথা বলে যার আমি কিছুই বুঝি না।
সুমন আমার ফেসবুক বন্ধু। বয়স ২৬/ ২৭ হবে। আমাদের বন্ধুত্ব খুব বেশি দিনের না। অল্প দিনের। ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তে আমাদের বন্ধুত্ব হয়। এখনও ব্যাচেলর। নিরীহ টাইপ এক যুবক। চুপচুাপ মিষ্টি স্বভাবের। প্রচুর পরিশ্রম করে এবং দেশে রেমিটেন্স পাঠায়। তার টাকায় সংসার চলে।
আমি বললাম, সুমন তুমি যে দেশে টাকা পাঠাও নিজের জন্য কিছু রাখ তো!
হ্যাঁ রাখি।
তোমাকে তো বিয়ে শাদি করতে হবে।
বিয়ের কথা শুনে সুমন লাজুক হাসে। ওর হাসিটা সুন্দর। মায়া ভরা। প্রথম দেখায়ই সুমন আমার মন কেড়ে নিয়েছে। বস্তুতঃ সে আমার বন্ধু হলেও আমার ছেলের সমান বয়স। তারচেয়েও ছোট। সে অর্থে সে আমার ছেলের মতো। দুবাই বেড়াতে যাওয়ার আগে সুমনের সাথে আমি যোগাযোগ করি। দুবাইতে আমার আরো অনেক বন্ধু আছে। কিছু ধনী বন্ধু আছে। তারা কেউ বড় চাকরি করে কেউবা ব্যবসা করে। কারো কারো সেকেন্ড হোম আছে। কিন্তু সুমন ছোট চাকরি করে। মেসে থাকে। এ রকম অসংখ্য সুমন আছে মধ্যপ্রাচ্যে।
আচ্ছা তুমি কেমন আছ দুবাইতে!
এই তো আছি।
এই কথায় ভাল মন্দ কিছুই বোঝা যায় না।
বিকেলের দিকে হোটেলের লবিতে বসে আমরা গল্প করছিলাম। সুমনকে দুর থেকে দেখেই আমি চিনেছি। ওকে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। ওর সাথে এসেছে ওর বন্ধু জামাল।
গল্পের এক ফাঁকে বললাম, টাকা পয়সা কার কাছে পাঠাও!
বড় ভাইর কাছে।
তাহলেতো ভালই। কিন্তু তোমার যখন দরকার হবে টাকা পাবা তো!
সুমন একটু চিন্তা করে বলল, পাব।
তোমার থাকার ব্যবস্থা কেমন এখানে!
ভাল।
গরমের দেশ। তোমার ডর্মে কি এসির ব্যবস্থা আছে। প্রায়ই থাকে না শুনেছি।
সুমন বলল, আমাদের আছে।
রান্না পার তুমি!
পারি টুকিটাকি।
আজকে কি রান্না করলা।
গরুর মাংস।
একদিন দাওয়াত করো।
সুমন আবার হাসল। আপনি কি আসবেন!
কেনো আসব না। বলেই দেখো না।
একটু পরেই আসল মিলন। আবু কালাম মিলন। সুদর্শন মিলন এসেছে তার এক বন্ধুকে নিয়ে। হোটেল লবিতে আমাদের আড্ডা জমে উঠল। তারপর আমরা বেড়িয়ে পরলাম রাতের দুবাই দেখতে। মিলন ঢাউস একটা গাড়ি নিয়ে এসেছে। গাড়ি ওর কোম্পানীর। ওর কাছেই থাকে। বোঝা যায় মিলন মোটামুটি ভাল চাকরি করে। চলে গেলাম দুবাই মলে। বুরজ আল খালিফায় লেজার শো দেখতে। ওখানে ঘোরাঘুরি শেষ করে আমরা গেলাম বাঙ্গালি এলাকায়। গোল্ড মাকেটের পাশেই ডেইরি দুবাই। বাংলা বাজারও বলে। দুবাইতে অনেক বাঙ্গালি থাকলেও এই এলাকায় সেভাবে ভাল মানের বাংলা খাবারের রেষ্টুরেন্ট গড়ে ওঠেনি এখনও। আমরা খুঁজে পেতে একটা ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্ট ঢুকলাম। আমাদের সাথে যোগ হলো আরো কয়েকজন।
সুমন পথেই নেমে গেছে। ওকে খুব সকালে কাজে যেতে হবে তাই।
একজন বলল, জসিম ভাই দুবাই চলে আসেন।
সত্যিকথা বলতে একসময় দুবাই আসার কথা খুব ইচ্ছে হয়েছিল আমার। রেজুমিও পাঠিয়েছি। কয়েকবার ইন্টারভ্যর জন্যও ডেকেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি। দুবাইতে আসতে চাওয়ার কারণ হচ্ছে কানাডা অনেক দুরের দেশ। দুবাই থেকে মন চাইলেই ঢাকা চলে যাওয়া যাবে। আমার যে খুব দেশে ফিরতে মন চায়।
কি করব দুবাই এসে!
বিজনেস করবেন!
আমি হাসলাম। বললাম, বিজনেস আমার কাজ না।
এখানে ভাল মানের রেষ্টুরেন্ট খুব চলবে।
কি রকম ইনভেষ্ট লাগবে রেষ্টুরেন্ট করতে!
ওয়ান মিলিয়ন ডলার হলেই শুরু করা যায়।
দেশ থেকে যে এতো টাকা পাচার হচ্ছে। অনেকে সেকন্ড হোম বানাচ্ছে তারা কেনো ইনভেষ্ট করছে না এখানে!
একজন বলল দুবাই হচ্ছে টাকা পাচারের নিরাপদ রুট। এখানে থেকে টাকা সাদা হয়ে অন্যান্য দেশে চলে যায়। সুইস ব্যাংকে যায়, কানাডা যায়, আমেরিকা যায়।
দুবাইতে বৈধ অবৈধ মিলিয়ে পনেরো লাখের মতো বাঙ্গালি আছে। যারা স্বল্প বেতনের চাকরি করে তাদের বেশিরভাগ থাকে শারজাহতে। সেখানে অপেক্ষাকৃত কম খরচে থাকা যায়। দুবাই কসমোপলিটান সিটি। সবকিছুই ব্যয়বহুল। অদরকারেও অনেক স্থপনা তৈরি হয়েছে এখানে। এক ধরনের শোআপ আছে। অসংখ্য স্কাইস্ক্রাপার, সাত আট লেনের হাইওয়ে, দামী হোটেল, অফিস বিল্ডিং। বুরজ খালিফার মতো টলেষ্ট বিল্ডিং আছে। দুবাইর আয়তন মাত্র ৩৮৮৫ স্কয়ার কিলোমিটার। দুবাইর ইকোনমি এখন সমস্যায়। রেসিশন চলছে। অনেকেই চাকরি হারানোর ভয়ে আছে।
দুবাইর দ্বিতীয় সন্ধ্যাটা ছিল ব্যতিক্রম। নতুন অভিজ্ঞতার। আমি খুবই সামান্য মানুষ। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতাগুলো অসামান্য। যেখানেই গিয়েছি তার প্রমান পেয়েছি এবং বিস্মিত হয়েছি। ভেবেছি এতোকিছু পাওয়ার যোগ্য আমি না। সন্ধ্যায় এসেছিলেন আমাদের সবার প্রিয় রেহানা রহমান ও মশিউর ভাই। টরন্টোর বাসিন্দা হলেও চাকরিসূত্রে থাকেন দুবাইতে। ছেলে মেয়েরা সবাই আমেরিকা থাকে। তাদের সাথে বেড়িয়ে পরলাম।
দুবাইয়ের সবচেয়ে অভিজাত এলাকা পাম জুমিয়ারাহ নিয়ে আসলেন। আটলান্টিস হোটেল এখানেই। সাগর কেটে এই এলাকা তৈরি হয়েছে। চোখে ধাঁধাঁনো সব স্থপনা, বাড়িঘর। চারিদিকে আভিজাত্য ছড়ানো। এখানকার বাড়িগুলো বেশিরভাগই বিভিন্ন দেশের সেলিব্রেটিদের। শাহ রুখ খানের বাড়িও আছে এখানে। দুবাইর শেখরা থাকে একেবারে ভিন্ন এলাকায়। সেখানে বাইরের মানুষদের প্রবেশাধিকার খুবই সিমীত। আমরা বুরজ আল আরব ঘুরে চলে গেলাম রাতের আড্ডায়।
আড্ডার আয়োজক সাঈদা দিবা। চমৎকার একটি পরিবার দিবার। দুবাইয়ে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে পরিচিত মুখ। দিবার ছেলেই সদ্যই কানাডা পড়তে এসেছে। সেজন্য তার একটু মন খারাপ তখন। একমাত্র ছেলে। একটুতো কষ্ট লাগবেই।
প্রায় আধাঘন্টা লেগে গেলো দিবার বাসা খুঁজে পেতে। অভিজাত আবাসিক এলাকা। মশিউর ভাই ড্রাইভ করছিলেন। গিয়ে দেখি আরো অনেকেই সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। কমিউনিটির স্বনামধন্য মানুষেরা। তার মধ্যে ছড়ালেখক ও সাংবাদিক লুৎফর রহমান একজন। লুৎফরকে আগেই জানিয়েছিলাম আমার আসার কথা। লুৎফর আমার অনেক দিনের বন্ধু। যে কেনো সাংস্কৃতিক কমকান্ডে লুৎফর আগ্রভাগে থাকে এবং সাবাইকে জাগিয়ে রাখার একটা আশ্চয ক্ষমতা তার মধ্যে আছে। আগে কখনো আমাদের দেখা হয়নি। গত বছরও আমার আসার কথা ছিল আমার কিন্তু নানা ব্যস্ততায় আসতে পারিনি।
সংহতি সাহিত্য পরিষদ আমিরাত শাখা আমার দুবাই আসা উপলক্ষ্যে এই আড্ডার আয়োজন করেছে। সংহতি পরিষদের সভাপতি সাইদা দিবা এবং সাধারন সম্পাদক লুৎফর রহমান। সেই আড্ডা হয়ে উঠেছিল মনোমুগ্ধকর। আড্ডায় কি ছিল না! সবই ছিল। গান ছিল, বক্তব্য ছিল, বই প্রদান ছিল, আর ছিল চমৎকার সব খাওয়া দাওয়া। পিঠা-পুলিও ছিল। উপস্থিত হয়েছিলেন প্রকৌশলী মশিউর রহমান, নজরুল ইসলাম চৌধুরী, রন্ধনশিল্পী ফাহমিদা চৌধুরী, আমিনুল হক, সাইফুর মাহমুদ, শাফিয়া তুহিন, সোনিয়া সিমিসহ আরো অনেকেই।
চমৎকার সঙ্গীত পরিবশেন করেন রেহানা রহমান, বঙ্গ শিমুল ও সোনিয়া সামিয়া। কবিতা পাঠ করেন টিশা সেন ও আহমেদ ইফতিখার পাভেল। টিশা অসাধারণ আবৃতি, উপস্থাপনা এবং সংবাদ পাঠ করেন টিভিতে।
দুবাইর বন্ধুদের আতিথেয়তায় আমি যারপরনাই মুগ্ধ। একটা অদ্ভুত ভাললাগা নিয়ে পরের দিন ঢাকার উদ্দেশ্যে প্লেনে চরে বসি।
টরন্টো ১৩ জুলাই ২০১৯