‘ইন্ডিয়ান গার্ল!’
থমকে দাঁড়াই কথাটা শুনে। মনে হলো এক ধরনের আহবান যেন। আওয়াজটা এলো বাঁ ধারে সামান্য দুরে একটু অন্ধকারমতো জায়গা থেকে। হলিডে ইন আর মিরাডর ম্যানশনের মাঝের রাস্তাটা বেশ কিছুদিন ধরেই বন্ধ। নাথান রোড মিনডেন এভিনিউয়ের মাঝের এই রাস্তাটার নাম মোদি রোড। গতবার এসেও দেখেছি কি যেন কন্সট্রাকশনের কাজ চলছে এতে, এবার দেখি এখনও শেষ হয় নাই। ব্লকের দুই ধারে বেরিকেড দিয়ে যান চলাচল বন্ধ সেই থেকেই। রাস্তার দুই পাশের লাইট পোস্টের কয়েকটায় আলোও জ্বলে না। ফলে এলাকাটা একটু অন্ধকারমতো। আওয়াজটা ওই প্রায়োন্ধকার জায়গার একটা কোন থেকে এসেছে।
সন্ধ্যা পেরিয়েছে বেশ আগে। নাথান রোডে চব্বিশ ঘন্টাই যান চলাচল। তবে রাত বাড়ার সাথে সাথে সংখ্যা কমে আসে। ওপাশে চুংকিংয়ের সামনে সারা দিন খেটে আসা শ্রমজীবিদের জটলাও হালকা হতে থাকে এ সময়। তবুও বিয়ারের ক্যান হাতে মঙ্গোলিয়দের ঘন আওয়াজের আড্ডা মধ্য রাত পর্যন্ত থেকে যায়। রাত তেমন না। সাড়ে নয়টার মতো হবে। খেতে যাচ্ছিলাম চুংকিংয়ে, পথে এই ডাক।
আমি থমকে দাঁড়ালে আওয়াজটা আবার কানে আসে। ‘ইন্ডিয়ান গার্ল!’ এবার খটকা লাগে। হংকংয়ে ইন্ডিয়ান গার্ল! এক ধরনের আগ্রহ জন্মে ব্যপারটা কি বুঝতে। এ শহরে আসা যাওয়া আমার বেশ কয়েক বছর ধরেই। ব্যবসায়িক কাজে আসতে হয় প্রায়ই। এলে এই এলাকা দিয়েই থাকি। কিন্তু রাস্তায় এ আওয়াজ কখনো শুনি নাই। দ্বিতীয়বার কথাটা কানে এলে তাকাই আওয়াজের উৎসের দিকে। হ্যাঁ, বাঁ ধারে একটু দুরে একটা বাল্বছাড়া লাইট পোস্টের গা ঘেষে দাঁড়ানো দু’টি নারী মূর্ত্তি। জায়গাটা ভালোই অন্ধকারমতো। ফলে বোঝা যাচ্ছিলো না কারা ওরা। আমাকে দাঁড়াতে দেখে একজন এগিয়ে আসে। অন্যজন দাঁড়িয়ে ওখানেই। মোদি রোড নাথান রোডের মোড়ের দিকটায় বেশ আলো। তারপরও কোন এক চলন্ত গাড়ীর হেড লাইটের আলোয় মুহুর্তের জন্য ঝলকে উঠলো অগ্রসরমান মূর্ত্তিটির চেহারা। এক পা দু’পা করে এগিয়ে এলো সামনে। এবার আমরা দু’জনই বেশ আলোয়।
শাড়িপরা একটা মেয়ে। মেয়ে বললে মানাবে না, প্রায় মাঝ বয়সী এক মহিলা। একটু নীচু গলায় ফিসফিস করে শুধায় ‘ইউ লাইক ইন্ডিয়ান গার্ল?’
ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কি বোঝাতে চাইছে। একটু অবাক হয়েই তাকিয়ে থাকি তার দিকে। বেঁটেখাটো গড়নের হালকা পাতলা মহিলা। একটা রঙিন সিল্কের শাড়ী পরনে। তবে পরার স্টাইলটা বাঙ্গালীমতো নয়। কপালে বড় একটা লাল টিপ। আবার একটু হেসে শুধায়, ‘ওয়ান্ট টু টেক ইন্ডিয়ান গার্ল?’
এবার ব্যপারটা ঢোকে মাথায়। রাত কি রানী। খদ্দের ধরতে বেড়িয়েছে। সব শহরেই এ ব্যপারটা আছে। আমাদের ঢাকা শহরে গুলশান পার্ক রমনা পার্কের আশে পাশে তো এদের অবাধ চলাফেরাই দেখি। তবে হংকংয়ের রাস্তায় এ দৃশ্য কখনো চোখে পড়েনি। শুনেছি থাই ফিলিপিনো কিছু মেয়ে আছে এ এলাকায় যারা এ ধান্ধা করে বেড়ায়। তবে প্রকাশ্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এভাবে খদ্দের ধরার দৃশ্য এই প্রথম দেখলাম।
সবচেয়ে বড় বিষ্ময় ভারতীয় মেয়েরা নেমে গেছে এ কাজে! এবার অবশ্য হংকং আসা পড়লো বেশ কিছুদিন পর। এর আগেরবার পর্যন্ত এমন চোখে পড়েনি। ঠিক বুঝতে পারছিলাম না ভারতে এদের ব্যবসায় আকাল নেমেছে না এ শহরে খদ্দের সহজলভ্য। অবশ্য এখানে আয় ডলারে। দেশে নিয়ে গেলে রুপীতে অনেক। আমাকে দাঁড়িয়ে তার দিকে ফিরতে দেখলে মহিলাটি একটু হেসে বলে ‘আই হ্যাভ এ ইয়ং গার্ল। ইউ টেক হার?’ অর্থাৎ আমার কাছে একটা অল্প বয়সী মেয়ে আছে। তুমি কি তাকে নেবে? ইংরেজী উচ্চারনে ইন্ডিয়ান ঢং। কথ্য ইংরেজী, ভাব বোঝাতে পারলেই হলো। তবে এ মহিলার ইংরেজী চায়নীজদের ‘মী গো’ ‘হি নো কাম’এর মতো র’ নয়। মহিলাটি ভারতীয় তবে ধরতে পারছিলাম না কোন অঞ্চলের।
মহিলার কথায় না গিয়ে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করি ‘আপ ইন্ডিয়ান হো?’ মহিলাটি মাথা ঝাকায়। এবার একটু রেগেই বলি, ‘আপ ইন্ডিয়ান হোতে হুয়ে ভি ইয়ে কাম করতে হো?’
এবার সে থতমত খেয়ে উঠলো যেন একটু। সামলে নিয়ে বললো ‘আই ডোন্ট নো হিন্দি। উই আর ফ্রম সাউথ। তামিল। উই ক্যান নট স্পিক হিন্দি।’
ঠিকই আছে। ভারতের তামিলরা হিন্দি জানে না বা বলেনা এটা জানি। তবে কেন বলে না এটা জানি না। কেন যেন মনে হলো ভারতীয় হোক এরা যেন আমাদেরই মেয়ে। আমরা তো একই অঞ্চলের। আমার রাগভাবটা রয়েই গেছে। বলি ‘হোয়াই ইউ ডু দিস?’
আমার প্রশ্নে মহিলাটি একটু অপ্রস্তুত হয় যেন। তবে মুহুর্তে সামলে নিয়ে বলে ‘ইউ লাইক অর নট?’ কন্ঠে বিরক্তি। হয়তো ধরে নিয়েছে আমি লাইনের লোক না, রং নাম্বার অথবা আমাকে পটাতে পারলো না। অতএব আমার পেছনে আর সময় নষ্ট না করা শ্রেয়।
আমি তার কথার জবাব না দিয়ে সঙ্গেরজনকে দেখতে ওদিকে তাকাই। লাইট পোস্টের গোড়ায় অন্ধকারমতো জায়গাটায় একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে আর একটা আবছা ছায়ামূর্ত্তি। বুঝলাম সে-ই হচ্ছে পন্য। এ মহিলা খদ্দের জোগাড় করা দালাল বা মাসী। হঠাৎ শুধিয়ে বসি ‘ইজ শি দ্য ইয়াং গার্ল?’
মহিলাটির চোখে যেন একটু আশার রেখা ফুটে ওঠে এবার। সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, ‘ইয়েস। ইউ ওয়ান্ট টু সী হার?’
হ্যাঁ, শাড়িপরা একটা হালকা গড়নের মেয়ে, জড়োসরো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে লাইটপোস্ট ঘেষে। আমাদের দু’জনকে তার দিকে তাকাতে দেখে যেন আরও একটু আড়স্ট হয়।
কেন যেন দেখতে ইচ্ছে হলো মেয়েটাকে। বলি, ‘ওকে, কল হার হিয়ার।’
‘ওকে ওকে’ বলে মহিলাটি গদগদ হয়ে যায় মূহুর্তে। তামিল ভাষায় কিছু বলে মেয়েটির উদ্দেশ্যে। কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া হলো না ওদিকে। দাঁড়িয়ে রইলো আগের মতোই। এবার একটু নির্দেশের মতো করে বলে কিছু। তারপরও অনড় মেয়েটি। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না ব্যপারটা। খদ্দের ধরতে বেড়িয়েছে। খদ্দের সামনে। তাহলে আসতে গড়িমসি করছে কেন!
শুধাই ‘হোয়াট হ্যাপেন্ড?’
একটু অপ্রস্তুত হয় যেন মহিলাটি। সামলে নিয়ে বলে, ‘শি শাই। নিউ কামার।
-চলবে…