‘ইন্ডিয়ান গার্ল!’ পার্ট-৩
আবার চোখ যায় মেয়েটার ওপর। ও তখনো তাকিয়ে আমার দিকে এক ঠায়। সে দৃষ্টি আবার এলোমেলো করে দেয় ভেতরটা। সামলে নিয়ে বলি মহিলাকে, শোনো, মনে হচ্ছে সে অসুস্থ। ওকে এখন তোমার রুমে নিয়ে যাওয়া উচিত।
মহিলা মুহুর্ত কয়েক ভাবে। তারপর ত্রস্তে বলে ওঠে ‘ওকে ওকে, ইউ ওয়ান্ট আস টু গো ব্যাক টু রুম নাও? উই গো ব্যাক এ্যন্ড ল্যাটার কামিং টু ইওর রুম, ওকে?’ চোখদু’টো জ্বলজ্বল করছে তার। যেন এতক্ষনে উৎকন্ঠা দুর হয়ে গেছে। মক্কেল পটে গেছে।
আমি গা ঝাড়া দিয়ে উঠি। কন্ঠটা একটু শক্ত করেই বলি, তোমাদেরকে আমার রুমে আসতে হবে না।
‘হোয়াট!’ মহিলার কন্ঠে বিষ্ময়।
‘আই ডোন্ট পিক আপ গার্লস ফ্রম দ্য স্ট্রিট, ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড?’ বলে ফিরি অন্য দিকে। হঠাৎ শুনি মেয়েটা নীচু গলায় কিছু বলছে মহিলাকে। বুঝতে পারলাম না কি বললো তামিলে। তাকাই মহিলার দিকে। শুধাই, কি বললো সে?
‘তোমার কথায় মাইন্ড করেছে। রুমে ফিরে যেতে চাইছে। এসব তার ভালো লাগছে না।’ এরপর গলাটা একটু চড়িয়ে প্রায় খেকিয়ে বলে, ‘রাস্তা থেকে মেয়ে টোকাই না তাহলে এতক্ষন রাস্তায় দাঁড়িয়ে মেয়েদের সাথে কথা বলছো কেন?’
আমি সে কথার জবাব না দিয়ে আবার তাকাই মেয়েটার দিকে। এবার সোজাসুজি তাকায় সে আমার দিকে। এক ভিন্ন দৃষ্টি। আমি কিছুটা এলোমেলো হয়ে যাই সে দৃষ্টির সামনে। চোখ ফেরাতে পারিনা। পরিষ্কার ইংরেজীতে শুধায় ‘রুম নাম্বার?’ এতক্ষনে এই প্রথম সে কথা বললো আমার সাথে। কন্ঠ বেশ দৃঢ়।
একটু হতচকিত হয়ে পড়ি যেন এ প্রশ্নে। সম্মোহিতের মতো বলে উঠি ‘টেন।’
‘ওকে’ বলে মহিলার উদ্দেশ্যে আবার কিছু বলে তামিলে। এরপর হাঁটা দেয় উল্টো দিকে।
মহিলা শশব্যস্ত হয়ে ওঠে। বুঝতে পারেনা কি করবে। ডাকতে থাকে ওকে পেছন থেকে। কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে মেয়েটি একটু এগিয়ে বাঁ ধারের গেট দিয়ে ঢুকে যায় মিরাডরে। মহিলা আমার উদ্দেশ্যে তামিলে কিছু বলতে বলতে তার পিছু নেয়। হয়তো বকাঝকা করলো। আমি দাঁড়িয়ে থাকি হতভম্বের মতো।
মাত্র কয়েক মূহুর্তে যেন ভোজবাজীর মতো সব মিলিয়ে গেলো। কেউ নেই আমার সামনে। এইযে এতক্ষন ধরে এখানে একটা নাটক হলো কোন রেশই নাই আর তার! কিন্তু মেয়েটা যাওয়ার আগে আমার রুম নম্বর জিজ্ঞেস করলো কেন! আসবে! ভাবতেই একটু আঁতকে উঠি। না না ওসব ঝামেলায় যাওয়া ঠিক হবে না বাবা! কোথাকার কারা কি মতলবে ঘুড়ছে কে জানে। শেষে কোন উঠকো ঝামেলায় পরে যাই। হঠাৎ মনে হয় আমি একা এখানে দাঁড়িয়ে আছি কেন বোকার মতো! কি ভাবছি ওদেরকে নিয়ে। চলার পথে কত ধরনের লোকের সাথে দেখা হয়। কত কীর্ত্তি মানুষের। যে যার ধান্ধা নিয়ে আছে। ওরা বেড়িয়েছে খদ্দের ধরতে। কতক্ষন ছিলো এখানে কে জানে। হয়তো আরো অনেককেই অফার করেছে। পেয়েও গেছে খদ্দের। তার প্রয়োজন মিটিয়ে আবার এসে দাঁড়িয়েছে। আমাকে চেষ্টা করলো পটাতে। কাজ হলো না। এখন নিজেদের পথ ধরেছে। এ নিয়ে আমার এতসব ভেবে কি লাভ।
তবে অবাক হচ্ছিলাম মেয়ে দু’টোর সাহস দেখে। সেই তামিলনাড়– থেকে উড়ে হংকং এসেছে। হংকং মূলত একটা বিজনেস সিটি। এখানে বেড়াতেও আসে অনেকে। তবে আমাদের উপমহাদেশের লোকজন যারা যাতায়াত করে প্রায় সবাই ব্যবসায়িক প্রয়োজনেই। বাংলাদেশ ভারত পাকিস্তান থেকে কিছু লোক আসে কাজের খোঁজে। করেও অনেকে কাজ এখানে থেকে। ব্যবসার কাজে যারা আসে কাজ শেষে দু’চার দিনেই ফিরে যায়। অবসরে দুই একদিন এদিক ওদিক ঘুড়ে দেখে। মেয়ে দু’টি শুধু দেহ ব্যবসা করতে এত দুর চলে এসেছে ভেবে বেশ অবাকই হচ্ছিলাম। নিশ্চয়ই এরাই এ কাজে এখানে প্রথম নয়। আরো আসে এবং আছে। এবং ব্যবসাটা লাভজনকও নিশ্চয়। আঁতকে উর্ঠি, এদের দেখানো পথ চিনে এক সময় আমাদের দেশের মেয়েরাও এসে উঠবে নাতো!
এবার হংকং আসা পড়েছে আমার বেশ কিছুদিন পর। এর আগে যে ক’বার এসেছি চুংকিং ম্যানশনেই উঠেছি। সি বøকের নয় তালায় চ্যাংয়ের গেস্ট হাউস। বেশ কয়েকবার এখানে এসে ওঠায় চ্যাংয়ের সাথে মোটামুটি জানাশোনা হয়ে গেছে। সে সুবাদে সে যে কোন বিশেষ ছাড় দেয় আমাকে তা নয় তারপরও গেষ্ট হাউসটা আমার পছন্দ, বেশ ছিমছাম পয়-পরিষ্কার। রুমগুলো বড়সড়। এটাচ্ড বাথ, ঠান্ডা পানি গড়ম পানি। রাস্তার উল্টো দিকের হায়াতের রুমগুলোর চেয়ে মান একেবারে খারাপ নয়। প্রথমবার হংকং এসে নামলে ট্যাক্সি এয়ারপোর্ট থেকে হায়াতে এনে উঠিয়েছিল। এক শ’ বিশ ইউএসের একটা ছোটখাট রুমে কাটিয়েছিলাম তিন চারদিন। পরেরবার সঙ্গে এসেছিলো বন্ধু আরমান। সেই তুলেছিলো চুংকিংয়ে চ্যাংয়ের গেস্ট হাউসে। বলেছিলো খামাখা ইউএস ডলার কেন গুনবো। পঞ্চাশ ইউএসে চ্যাংয়ের এখানে যে রুম হায়াতে তাই দুই শ’। কি দরকার অযথা টাকা ফেলে। থাকাই তো ব্যপার। প্রথমবার থেকে দেখেছি মন্দ না। এরপর থেকে হংকংয়ে আমার ঠিকানা চুংকিংয়ে চ্যাংয়ের গেষ্ট হাউসই। কিন্তু এবার এসে রুম পাই নাই সেখানে। সকালে নেমে এয়ারপোর্ট থেকেই কল দিয়েছিলাম। জানিয়েছে সব বুক্ড। তবে বিকল্প ব্যবস্থা করে দিয়েছে। পাশের মিরাডর ম্যানশনে ওরই ছোট ভাই আর এক চ্যাংয়ের গেষ্ট হাউসে। ওরটারই মতো। পরিচ্ছন্ন। নিরিবিলি। দুপুরে এসে সেখানেই উঠেছি। সিঙ্গেল বেডরুম খালি ছিল না, ডবলই নিতে হয়েছে। ভাড়ার খুব একটা পার্থক্য নাই। তবে রুমটা বেশ বড়। সুযোগ সুবিধা সবই সিনিয়র চ্যাংয়েরটার মতোই।
থাকা গেষ্ট হাউসে কিন্তু খাওয়া বাইরে। কিচেন আছে। কেউ ইচ্ছে করলে রান্না বান্নাও করতে পারে। তবে কে যায় একজনের জন্য ও ঝামেলায়। আমিও সব সময় বাইরের রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়া দাওয়া সারি। নীচে কয়েকটা রেস্টুরেন্ট আছে। অর্ডার করলে রুমে পৌছে দেয়। নেহায়েত ঠেকায় না পড়লে অর্ডার করি না রুমে। একটু হেঁটে চুংকিংয়ের দোতালায় নিউ পাঞ্জাব রেস্টুরেন্ট বা ভর্ত্তা চচ্চরির বাঙ্গালী খেতে হলে ই বøকের চৌদ্দ তালায় মানিকের হোটেলে যাই। সারা বিল্ডিংয়ে সম্ভবত একটাই বাঙ্গালী খাবার দোকান। এলাকার বাঙ্গালী ছেলেরা প্রায় সবাই এখানে এসে খেয়ে যায়। ডাল ভাত ফ্রি, মাছ বা মাংশসহ দুইটা তরকারি মোট দশ হংকং ডলার। এর চেয়ে সস্তায় পেট চুক্তি বাঙ্গালী খাবার আর কোথাও নাই সারা হংকংয়ে।
খাবার খেতেই যাচ্ছিলাম চুংকিং। দুপুরে এসে ওঠার পর আর বের হইনি রুম থেকে। হেলিম খাবার দিয়ে গেছে। খেয়ে ঘুমিয়ে পরেছিলাম। রাতের খাবার খাওয়ার কথা হেলিমের সাথে চুংকিংয়ের দোতালায় নিউ পাঞ্জাব রেষ্টুরেন্টে। সে এসে বসে থাকবে সেখানে। আমি রওনা হয়েছি সে উদ্দেশ্যেই। পথে এই নাটক।
মেয়ে দু’টো চলে গেছে। আমি সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে পা বাড়াই। সামনে এগুতে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো বাঙ্গালী ছেলেগুলোর ওপর চোখ যায়। একেবারে সামনে এসে পড়ায় চুপ হয়ে যায় ওরা। আমি এদিকওদিক না তাকিয়ে সোজা দৃস্টি মেলে পার হয়ে আসি জায়গাটা। ওদেরকে পেছনে ফেলে আসতেই উচ্চস্বরে কিছু হাসি শুনতে পাই। হয়তো টিটকারি বা ব্যঙ্গ করছে আমাকে নিয়ে। করতে পারে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে মেয়ে ভাও করা, ব্যপারটা আমাদের দেশে খুবই একটা বাজে কাজ। আমি এতক্ষন চেষ্টা করে সে কাজটাও করতে পারলাম না। পাখি উড়ে গেলো। এমনটাই ওদের মনে হওয়া স্বাভাবিক। এখন মজা করছে এ নিয়ে। গায়ে না মেখে এসে দাঁড়াই চুংকিংয়ের সামনে। এ সময়ই সেলে হেলিমের ফোন।
এসে বসে আছে অনেকক্ষন, জানতে চায় দেরী হচ্ছে কেন আমার। বলি, এসে গেছি। নীচে। ‘তাড়াতাড়ি আসেন’ বলে হেলিম ফোন রাখে।
বিশাল এক বিল্ডিং এই চুংকিং ম্যানশন। অনেক দিন ধরেই আসছি এখানে। কতগুলো যে তালা আর কত যে এতে রুম ঠাওর করে উঠতে পারি নাই আজ পর্যন্ত। বিশাল এলাকা নিয়ে পুরো বিল্ডিং। নীচতলা দোতালা মার্কেট। তিনতলা থেকে অফিস ওয়্যার হাউস। এর ওপরের ফ্লোরগুলোয় হোটেল, অফিস, গেস্ট হাউস, খাবার দোকান, ডরমেটরি এ্যপার্টমেন্ট, গার্মেন্টস এমনকি মার্শাল আর্টের স্কুল, কি নাই এ বিল্ডিংয়ে! ব্যাংক মানি ট্যান্সফার ট্রাভেল এজেন্সি, উকিলের চেম্বার ডাক্তারখানা দর্জির দোকান নাপিতের সেলুন সওদাগরি অফিস হোল সেলার রিটেইলার এমনকি পানের দোকান, কোনটাই বাদ নাই। একবার বিল্ডিংয়ে ঢুকলে কোন কিছুর জন্য বাইরে না গেলেও চলে।
নিউ পাঞ্জাব রেষ্টুরেন্টের মালিক একজন ভারতীয় শিখ। এ শহরে সর্দারজীদের প্রভাব প্রতিপত্তি অবশ্য বেশ। চোখে পরে। বেশ কিছু দোকানপাট বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক এরা। দাড়িওয়ালা পাগড়িপরা এক একজনকে দেখে মনে হয় বেশ কর্মঠ। পাঞ্জাব রেষ্টুরেন্টের মালিক নিজেই সব কিছু তদারকি করে। বেশ বয়ষ্ক লোক। কিন্তু কাজে কখনো অবহেলা নাই, ক্লান্তি নাই। হোটেলটাও বেশ বড়সর। প্রায়ক্ষনই ব্যস্ত থাকে। বলাই বাহুল্য খাবার সব ইন্ডিয়ান। তবে এদের লাচ্ছিটা স্পেশাল। গড়মের দিন হলে আমি মাঝে মাঝেই এসে খেয়ে যাই।
রেষ্টুরেন্টে এসে হেলিমকে পাই সামনের দিকে একটা টেবিল নিয়ে বসে থাকতে। হেলিম আমার বন্ধুমতো। পরিচয় এখানেই। হংকং আছে বছর দশেক। সি ব্লকের তের তলায় দুই রুমের একটা স্যুইট আছে তার। রুমদু’টো বেশ বড় বড়। এক একটায় পার্টিশন দিয়ে ছোট ছোট একাধিক রুম করা। তার একটা অংশে ওর অফিস কাম রেসিডেন্স। আর একটায় ডরমিটরি। স্বল্প আয়ের বাংলাদেশী ছেলেরা থাকে এখানে। এসব ছেলের অধিকাংশই অন এ্যরাইভাল ভিসায় এসে থেকে গেছে। অধিকাংশই ওভার স্টে। ফিরে গেলে পুরনো পাসপোর্টে আর ঢুকতে পারবে না হংকং। সে কারনে যত দিন পারে এভাবে থেকে এখানে ওখানে টুকটাক কাজ করে। কিছু পয়সা কামায়। তবে বাংলাদেশে সুবিধা, চাইলেই যে কোন নামে নতুন পাসপোর্ট বানিয়ে ফেলা যায়। যারা বার বার এসে থেকে যায়, অনেক দিন পরপর ফিরে গিয়ে নতুন পাসপোর্ট বানিয়ে আবার সহজেই এসে পড়তে পারে। এদের কেউ কেউ মোটা মাইনের কাজও করে এখানে। অনেকে আসে ট্রানজিট প্যাসেঞ্জার হিসেবে। মুলত: আদম ব্যপারীরাই এদেরকে এনে রাখে এখানে। এদের অবস্থান হয় স্বল্প মেয়াদি। এখান থেকে পাঠিয়ে দেয়া হয় সিওল তাইপে বা ইওরোপের বিভিন্ন গন্তব্যে। আগে তিন মাসের অন এ্যরাইভাল ভিসা পাওয়া যেতো। কিন্তু গরীব দেশগুলো থেকে লোকজন এসে এ তিন মাস কাজেকর্মে লেগে যেতো। ব্যপারটা ধরতে পেরে পরে নিয়ম পাল্টানো হয়। এখন পনেরো দিনের ভিসা। যারা আরো বেশী থাকতে চায় পনেরো দিন শেষ হওয়ার আগ দিয়ে পাশে চায়না বা ম্যাকাও গিয়ে ঘুড়ে আসে দুই এক দিনের মধ্যে। আবার পনেরো দিনের ভিসা পেয়ে যায়। এভাবে দুই তিন মাস থাকা যায়। এরপর আর ভিসা দেয়না হংকং ইমিগ্রেশন। ফিরে আসতে হয় দেশে। সে পাসপোর্ট বাদ। বানাতে হয় নতুন একটা। এভাবেই চলে আসছে। তবে ইদানিং একেবারে সাদা পাসপোর্টে এন্ট্রি পাওয়াও নাকি কঠিন হয়ে আসছে। ইমিগ্রেশনে ভালো ইংরেজী না বলতে পারলে গলা ধাক্কা নির্ঘাৎ। চায়নাও নিয়ম পাল্টিয়েছে। ভিসাছাড়া বাঙ্গালীদেরকে ঢুকতে দেয় না। ফলে বাঙ্গালীদের জন্য রি-এন্ট্রি বেশ কঠিনই হয়ে উঠেছে।
চলবে…