‘ইন্ডিয়ান গার্ল!’ পার্ট-৫
সব দ্যাশেরই আছে। তয় লোকাল চায়নীজরা এগো দিকে ফিরাও চায় না। পাকিস্তানী ইন্ডিয়ানরাই আসল কাস্টমার। এনাগো আবার ডিমান্ড বেশী। বাঙ্গালীরা পোষাইতে পারেনা। তয় সাদা কিছু টুরিস্টরে দেখি মাঝে মইধ্যে খাড়াইয়া দরদাম করে। আর কইয়েন না!’
হুম! খেতে খেতে ভাবতে থাকি কত দ্রুত বদলে যাচ্ছে সব কিছু। হয়তো এক সময় দেখবো বাংলাদেশ থেকেও মেয়েরা এসে দাঁড়িয়ে গেছে লাইনে। বলি আচ্ছা, প্রস্টিটিউশন তো নিষিদ্ধ এ শহরে। এরা কিভাবে চালিয়ে যাচ্ছে এ ব্যবসা!
আড়ালে আবডালে। দেখবেন পুলিশ দেখলেই সব হাওয়া।
পুলিশ ধরতে পারে না?
কেমনে ধরবো? কোন কমপ্লেন তো নাই। তারপরও রাস্তায় শাড়িপরা মাইয়া খামাখা ঘোড়াঘুরি করতে দেখলে জিজ্ঞাসটিজ্ঞাস করে। তয় রাইত দশটার পরে এরা একটু সাবধান হইয়া যায়। এই সময় এইখান দিয়া পুলিশের টহল বাইড়্যা যায় আইজকাইল।
একটু চুপ থাকি। তারপর বলি, শোনেন, কোনদিন যদি কোন বাঙ্গালী মেয়েকে দেখেন, ঘাড়টা ধরে নিয়ে সোজা প্লেনে উঠিয়ে দেবেন। ভাই এটা দেশের একটা মান সম্মানের ব্যপার।
হেলিম একটা ছোট শ্বাস ছেড়ে বলে, ভাইরে, এইটা হংকং শহর। এইখানে কে কার ঘাড় ধরে। তয় মনে হয়না আমাগো দ্যাশের মাইয়ারা এই পর্যন্ত আইতে সাহস পাইবো।
কথা বলতে বলতে আমাদের খাওয়া শেষ হয়। এ রেস্টুরেন্টে বিয়ার সার্ভ করে। সেলিম অর্ডার করে দু’টো। স্যাম মিগুয়েল। হংকংয়ে এই ব্রান্ডটাই চালু। দামও বেশ সস্তা। পথেঘাটেই পাওয়া যায়। দোকানে ছয় ক্যানের কেস দশ কি বারো হংকং। বাঙ্গালী ছেলেরা হংকং এসে আর কিছু না করুক সস্তায় পাওয়া এই বিয়ারটা খুব খায়। আগে নাকি খেয়ে চুংকিংয়ের সামনের রাস্তায় মাতলামিও করতো। দুই একবার মাথা ফাটাফাটি হওয়ায় এখন বিল্ডিংয়ের সিকিউরিটির লোকেরা সেখানে জটলা হতে দেয়না।
বিয়ার জিনিষটা আমার কখনোই পছন্দ না। পুরোটাই কার্বো হাইড্রেট। এক নাগাড়ে মাসখানেক খেলে পেট বড় হয়ে যায়। যারা প্রচন্ড শারিরীক পরিশ্রম করে তাদের জন্য ঠিক আছে। আমরা যারা বসেই থাকি সারাক্ষন, তাদের জন্য এ জিনিষ শত্রু। তার চেয়ে একটু নেশা করতে হলে লিকার খাওয়াই ভালো। হংকংয়ে লোকাল ব্যান্ডের মধ্যে জ্যাক লর্ডটাই আমার পছন্দ। দামও বেশী না। ব্র্যাক লেবেল বা ভ্যাট সিক্সটিনাইন না পাওয়া গেলে এই ড্রিংকটাই আমি নেই।
রেষ্টুরেন্টে লিকার সার্ভ করেনা। বিয়ারটা চলে। বেয়ারার এনে দেয় দু’টো গ্লাস। অগত্যা চুমুক দেই। কথায় কথায় হেলিম আসে তার সেই পুরনো কথায়। আমি শুনতে খুব একটা মন দিচ্ছিলাম না। নতুন কি আর বলবো। ও বলে চলছিলো, বিশটা ছেলেকে যদি পাঠাতে পারি, দুই লাখ করে মোট চল্লিশ লাখ পাবো আমি। তাতেও উৎসাহ বোধ করিনা। হাতে ধরা গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলি, আচ্ছা এসব এখন রাখেন তো। কোরিয়া থেকে ঘুড়ে আসি। ওদের সাথে কথাবার্ত্তা বলে বুঝি ব্যপারটা। তারপর চিন্তা করবো।
হেলিম তারপরও নাছোড়বান্দা। ভ্যানভ্যান করেই চলে। মোটামুটি ঘন্টাখানেক কাটিয়ে আমরা উঠি। এর মধ্যে গোটা তিনেক করে স্যাম চালান হয়ে গেছে এক একজনের পেটে। তার আছড় পরেছে মাথায়। সেখান থেকে সারা শরীরে। পুরো নেশা নয়, তবে বেশ হালকা বোধ হচ্ছিলো। রেস্টুরেন্টে লোকজন কমে এসেছে বেশ আগেই। ছেলেগুলো ঝাড়পোছ শুরু করেছে। বিল চুকিয়ে দিয়ে বের হয়ে আসি আমরা।
হ্যা, পা একটু অসংলগ্ন যেন। আসলে অল্প সময়ে পরপর তিনটা খাওয়াতেই এ অবস্থা। ধরে গেছে চট করে। নীচে এসে দেখি দোকানপাট প্রায় সবই বন্ধ। পেছন দিকটায় পান সিগারেটের দোকানে আলো জ্বলছে। এটা খোলা থাকে অনেক রাত পর্যন্ত। হেলিমকে বলি ‘চলেন, একটু ওই দোকানটায় যাই।’
অবাক হয় যেন। বলে, পান খাইবেন!
আরে না। একটা বোতল নেবো।
পানের দোকানটায় স্ট্রং লিকার পাওয়া যায়। রুমে নাই। একটা জ্যাক লর্ড থাকা ভালো। দুপুরে অনেকক্ষন ঘুমিয়েছি, এখন যদি ঘুম না আসতে চায় ঘুমপাড়ানি অষুধ হিসেবে কাজ দেবে।
হেলিম হেসে দেয়। বলে, তিনট্যা খাইলেন, তাতেও নেশা হয় নাই!
বলি, নেশার জন্যে নারে ভাই, ঘুমের অষুধ হিসাবে দরকার হতে পারে। একটা নিয়ে রাখলে দোষ কি। যদি না খাই কাল সন্ধ্যায় বসে দুইজনে সাবাড় করে দেবো।
হেলিম হেসে বলে, ওকে নো প্রব্লেম। তাইলে দুইটাই নেন।’
আমি কিছু না বলে একটা বোতল নেই। দাম মাত্র চল্লিশ হংকং। মন্দ না। টাকা দিয়ে প্যাকেটটা নিয়ে ফেরার পথ ধরি। হেলিম আমাকে এগিয়ে দেয় কিছুটা। চুংকিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে কালকের কাজ নিয়ে কথাবার্ত্তা সেড়ে হাঁটা দেই মিরাডরের দিকে। বিল্ডিংয়ের সামনের জটলা কমে গেছে। বাঙ্গালী পাকিস্তানী ছেলেগুলোকে দেখা গেলোনা আশে পাশে। তবে কিছু নতুন ছেলে মেয়েকে দেখলাম এখানে ওখানে বসে আছে। হাতে বিয়ারের বোতল। চেহারা স্বাস্থ্য গড়নে বোঝা গেলো সবগুলো মঙ্গোলিয়ান। বছর দুই আগেও এতো দেখা যেতো না এদেরকে। এবার দেখছি সংখ্যায় যেমন বাড়তি বেশ বেপরোয়াও। রাস্তায় বসেই ড্রিংক করছে, মাতলামো করছে। একটু আড়ালমতো জায়গায় বসে ধুম্রপানও চলছে। টানার ভঙ্গিতে মনে হয় গাঁজা চরশ জাতীয় কিছু হবে। দিনের বেলা এদেরকে খুব একটা দেখা যায় না। কি করে ওরাই জানে। সারা রাত যেভাবে ঘুড়ে বেড়ায় মনে হয় দিনভর ঘুমায়। সন্ধ্যার পর থেকেই এ বিল্ডিংয়ের সিড়ি, সামনের রাস্তা, মিরাডরের পাশের গলির আলো আধারিতে, রাস্তার ধারের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে বা নেভা লাইট পোস্টের গোড়ায় দেখা যায় এদের জটলা।
আমি একটা সিগারেট টানতে টানতে বেশ রিলাক্সড্ মুডেই হাঁটতে থাকি। বিয়ারের গুনে বেশ হালকা লাগছিলো মনটা। যেন অনেকটা ফুরফুরে মেজাজ। গুন গুন করে একটা হিন্দি গানের কলি ভাজতে ভাজতে এসে যাই মিরাডরের লিফটের গোড়ায়। দাঁড়াতে হয় না। লিফট সামনেই খোলা। দিনের বেলা এমন কখনো পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার। মিনিট পাঁচ সাতেক না দাঁড়ালে তাতে ওঠার সুযোগ হয়না। এ বিল্ডিংয়ে লিফট বেশ কয়েকটা। তারপরও ভীড় সব সময় লেগেই আছে। হলেও চুংকিংয়ের মতো না।
সিগারেটের উচ্ছিস্ট পায়ে পিষে ঢুকি ভেতরে। বোতাম টিপতেই দরজা বন্ধ হয়ে যায়। সাঁই করে একটানে চলে আসি আমার ফ্লোরে। উঁচুতে বলে নীচের কোলাহল রাস্তায় গাড়ীর আওয়াজ এখানে নাই বললেই চলে। রুমে গিয়ে ঢুকলে মনে হয় কোন এক নির্জনপুরীতে এলাম। একদম বাইরের কোন আওয়াজ নাই। গানের কলি তখনও কন্ঠে। বেশ আয়েশী ঢংয়ে হাঁটতে থাকি লবি ধরে। পুরোটাই ফাঁকা। গেস্ট হাউজের সামনে আসতে মনে হলো এক পাশে কারা যেন দাঁড়িয়ে। মেইন গেটের নবে চাবি ভরতে যাবো হঠাৎ মনে হলো কোন মেয়ে যেন! এবং শাড়ি পরা। স্যাম মিগুয়েলের গুনে ঠাহর করতে পারছিলাম না শাড়িপরা মেয়ে এত রাতে এখানে কি করছে! একটু অবাকই হই। চোখ যায় ওদের ওপর। হ্যাঁ দু’টি মেয়েই। একজন এগিয়ে আসছে আমার দিকে।
একটু সামনে আসতেই হেসে দেয়। বলে ‘ইউ লেট। উই ওয়েটিং ফর ইউ।’
বিষম খেয়ে উঠি যেন! ওয়েটিং ফর ইউ মানে! আমার জন্যে অপেক্ষা করছে! হঠাৎ মনে পড়ে যায়, আরে এরা তো সেই মেয়ে দু’টি যাদের সাথে সন্ধ্যা রাতে রাস্তায় দেখা হয়েছে। রাত কি রানী! কিন্তু ওরা এখানে আমার জন্য অপেক্ষা করছে কেন!
ভ্রু কুচকে শুধাই ‘ওয়েটিং ফর মি! হোয়াই?’
মহিলাটি বলে ‘ইউ টেল আস টু কাম।’
‘মী!’ বেশ অবাকই হয়ে যাই। ‘হোয়েন!’
‘দ্যাট টাইম। ইউ ফরগেট?’
মনে পড়লো মহিলা শুধিয়েছিলো আমার রুমে আসবে কিনা। কিন্তু নেশা যতই হয়ে থাকুক, পরিষ্কার মনে আছে আমি তো তাদেরকে আসতে বলি নাই। বলি, ‘বাট আই ডিডন্ট টেল ইউ টু কাম হিয়ার!’
এবার একটু অপ্রস্তুত হয় মহিলা। সামলে নিয়ে বলে, কিন্তু তুমি তো আমাদেরকে তোমার ঠিকানা রুম নম্বর দিয়েছো! এসে রিসেপশনে জিজ্ঞেস করলাম, বললো এখনো ফেরোনি। বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি।
বলি, তুমি তখন জানতে চেয়েছো কোথায় থাকি, আমি বলেছি। তার মানে কি এটা যে তোমাদেরকে এখানে আসতে বলেছি?
একটু থমকে যায়। যেন বুঝতে পারছেনা এরপর কি বলবে। ইতস্তত করতে থাকে। এবার আমার চোখ যায় একটু দুরে দাঁড়ানো অল্প বয়সী মেয়েটার দিকে। তখনকার মতোই মাথা নীচু করে রয়েছে। মহিলাটি এবার গুছিয়ে নিয়ে বলতে থাকে, তুমি বলেছো রুমে ফিরে যাও, আমরা চলে এসেছি। তার মানে তুমি কনফার্ম করেছো। সে কারনে আমরা আর কাউকে চেষ্টা করিনি। এখন আসতে বলো নাই বললেই হবে! এই মাঝরাতে আমরা কোথায় যাবো! কাকে পাবো এখন! তোমার জন্য আমরা রাতটা নষ্ট করছি।
চলবে…