‘ইন্ডিয়ান গার্ল!’ পার্ট-৯
এবার আমি একটা সিগারেট ধরাই। বুঝতে পারছি এর পরের ঘটনাটা। তবুও শুনতে চাই ওর মুখ থেকে কিভাবে মহিলা নামালো এ পথে। বলি, হুঁ তারপর?
একটু দম নেয়। তারপর বলে চলে, প্লেনে ওঠার পর একথা সেকথা শেষে এক সময় মহিলা বলে চাকরির চাইতে বিদেশে ব্যবসাতেই আয় বেশী। সে ইচ্ছা করলে হংকংয়ে চাকরি না করে ব্যবসাও করতে পারে। নিজের স্বাধীন ব্যবসা, যত কাজ তত আয়। চাকরির মতো বাধাধরা কিছু নাই। শুনে বলেছে, সে কিভাবে ব্যবসা করবে! ব্যবসা করতে টাকা লাগে। আর সে তো ব্যবসা বোঝেই না। দেশেই যা করে নাই বিদেশে তা করবে কিভাবে। মহিলা বলে যদি চায় সব ব্যবস্থা সেই করে দিতে পারবে। বলেছে, তার অত টাকা দরকার নাই। চাকরিই করবে। মহিলা বলেছে কোন অসুবিধা নাই। চাকরি তো তার রেডিই আছে।
গত মঙ্গলবার ভোরে এয়ারপোর্টে নেমে এই বিল্ডিংয়ের পাঁচ তলায় একটা গেস্ট হাউজে এসে উঠেছে। ছোট্ট একটা রুম, তাতে ছোট একটা বিছানা। দুই জন গা ঘেষাঘেষি করে থাকা যায়। ভাড়া ষাট ডলার। পরের দিন জানতে চায় কবে চাকরিতে জয়েন হবে। মহিলা বলে সবে এসেছি একটু বেড়াই দুই একদিন। একবার কাজে নেমে গেলে তো আর ফুরসুত পাবো না। ওই দিনই সন্ধ্যায় একজন লোক এসেছিলো। মহিলার পরিচিত। পরিচয় দেয় বিজনেসম্যান। প্রথমে মনে করেছিলো গার্মেন্টসয়ের মালিক বা ম্যানেজার। কিন্তু কথাবার্ত্তায় তার সন্দেহ হয়। ভালোভাবে তার সাথে কথা বলেনি কেন এ নিয়ে মহিলাটি পরে তাকে বকাঝকা করেছে। সে রাত থেকেই তাকে বোঝাতে থাকে চাকরি বাদ দিয়ে ব্যবসায় নামো, অল্প দিনে অনেক টাকা কামাই করতে পারবে। বারবার একই কথা বলায় তার সন্দেহ হয় কি ব্যবসার কথা বলছে সে। জিজ্ঞেস করে। মহিলা কোন ভাণ ভনিতা না করে সোজাসুজি প্রস্তাব দেয় দেহ ব্যবসার। শুনে সে আঁতকে উঠেছে। ঘৃণায় গা ঘিন ঘিন করে উঠেছে। বলেছে সে একটা অভিজাত বংশের মেয়ে। গরীব হলেও বংশ মর্যাদা অনেক উঁচু। তাদের পরিবারকে মহিলা জানে। কি করে ওই বংশের একটা মেয়ের কাছে সে এ প্রস্তাব দিতে পারলো! মহিলা বলেছে পেটে ভাত না থাকলে বংশ মর্যাদা কোন কাজে আসে না। দিল্লী চেন্নাই বোম্বে থেকে অনেক মেয়ে এখানে এসে এ কাজ করছে। তাদের অনেকেও ভালো ঘরের উঁচু বংশের মেয়ে। অথচ দিব্বি করে যাচ্ছে। দেশে কেউ জানতে পারেনা। ওখানে জানে বিদেশে চাকরি করে। দুই তিন মাস পর পর এরা বিস্তর টাকা পয়সা নিয়ে ফিরে যায়। তার ব্যপারটাও কেউ জানতে পারবে না। শুনে তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরে, ভয়ে শিউড়ে ওঠে। বলেছে সে গার্মেন্টসয়েই কাজ করতে চায়। মহিলা বলে ঠিক আছে। কিন্তু মালিক এখন হংকং নাই। ফিরতে দেরী হবে। সে না এলে জয়েন হবেনা। এত দিন বসে বসে কি করবে। তাছাড়া রুম ভাড়া খাওয়া খরচা এসব চলবে কিভাবে। সে যে টাকা এনেছিলো তা দিয়ে আর দুই একদিন চলতে পারে। টাকা আয় না করতে পারলে এরপর রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে, না খেয়ে থাকতে হবে। এখন সে ছাড়া আর কে আয় করবে! বিনা পূঁজিতে আয়ের ওই একটাই পথ। শুনে রেগে গিয়ে বলেছে তার চাকরি দরকার নাই ব্যবসাও দরকার নাই, তাকে যেন কালই পাঠিয়ে দেওয়া হয় চেন্নাই। মহিলা বলেছে বললেই তো আর পাঠিয়ে দেয়া যাবে না। তাকে আনতে যে খরচা গেছে সে টাকাটা কে দেবে! আয় করে ওটা দিলেই তাকে চেন্নাইয়ের প্লেনে উঠিয়ে দেওয়া হবে। ওদিকে তার টিকেট পাসপোর্ট মহিলার কাছে। আবার ভয়ও দেখায় এ শহরে তার অনেক ধরনের লোকের সাথে পরিচয়। কথা না শুনলে তার বিপদও হতে পারে। এমন একটা চাপে ফেলে যে সে দিশাহারা হয়ে পরে। বুঝতে পারে মহিলা তাকে ট্র্যাপে ফেলেছে। কি করবে কিছুই ঠাহর করে উঠতে পারছিল না। জীবনে প্রথমবারের মতো বিদেশে এসেছে। আর হংকং একটা হাইফাই শহর। কিছুই চেনেনা সে এখানকার। নিয়ম কানুন জানেনা। কোন পরিচিত লোক নাই। কোথায় যাবে, কার কাছে গিয়ে সাহায্য চাইবে। কোন উপায় না পেয়ে রাতভর একা একা কেঁদেছে।
এ পর্যন্ত বলে থামে একটু। আমি বেশ গম্ভীর হয়ে যাই। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকি ওর দিকে। সিগারেট টেনে চলেছি। হঠাৎ খেয়াল হয় এতো বন্ধ কামড়া, ওর সামনে সিগারেট টানছি! যদিও এসির এগজস্টার আছে, একটুপর গন্ধ থাকবে না। তারপরও একটা মেয়ের সামনে তার অনুমতি না নিয়ে সিগারেট টানা অভদ্রতা। একটু অপরাধীর মতো বলি, ‘সরি, আই এ্যম ষ্মোকিং-!’ একটু অবাক চোখে তাকায় আমার দিকে। বলি ‘ইটস্ নট ডিসেন্ট টু ষ্মোক ইন ফ্রন্ট অফ এ লেডি উইদাউট হার পারমিশন। আই এ্যাম সরি।’
তাকিয়েই থাকে বোকার মতো। আমি সিগারেটটা এ্যশট্রেতে পুতি। বলি, ‘ওকে, দেন ইউ কেম অন দ্য স্ট্রিট টু আর্ন মানি!’
‘নো-।’ যেন আর্ত্তনাদ করে ওঠে। একটু চুপ থেকে বলে চলে, যখন বুঝলাম সে সিরিয়াস, আমি কান্নাকাটি বাদ দিয়ে মাথা ঠান্ডা করি। ঠিক করি এখান থেকে বের হতে হবে। কিন্তু কিভাবে! শেষে বুদ্ধি বের করি। একজনকে খুঁজে বের করতে হবে, বিশ্বস্ত। যারতার কাছে সাহায্য চাইলে আবার ট্র্যাপে পরে যাবো। কিন্তু কাকে পাবো এখানে। কাউকে চিনিনা। তাছাড়া মহিলা আমাকে এনেছে থেকে রুমের বাইরে বের করে নাই কখনো। খাবার এনেছে নিজে গিয়ে। আমাকে বলেছে দরজা বন্ধ করে বসে থাকতে। এটা চীনাদের দেশ। চীনারা খুব খারাপ জাত। দরজা খোলা পেলে যা খুশী করে যাবে। আমি ভয়ে সব সময় দরজা লক করে বসে থাকতাম। দুই দিন ধরে সে আমাকে বোঝায়, কখনো রাগ করে কখনো ভয় দেখায়। বলে যদি তার কথা না শুনি আমার এলাকায় আমার পরিবারের কাছে সে আমার মান সম্মান সব শেষ করে দেবে। আমি দেশে ফিরে গিয়েও সেখানে থাকতে পারবো না। কখনো সুস্থ স্বাভাবিক জীবন পাবো না। তার চেয়ে তার কথা শুনলে সব কিছুই ঠিক থাকবে। সে যাদেরকে বিদেশে এনেছে সবাই ভালো আছে। বিদেশে ভালো আয় করছে, নিজেদের এলাকায় মান সম্মান আছে। যারা অবিবাহিতা এলাকার ছেলের সাথে প্রেম করছে, বিবাহিতারা স্বামী সন্তান নিয়ে সুখের সংসারও করছে।
কিন্তু কোন কিছুই তাকে প্রলুব্ধ করতে পারে না। দেশে তারা গরীব হতে পারে কিন্তু তাদের বংশ মর্যাদা অনেক উঁচু। তারা ব্রাহ্মিন। সমাজে তাদের যথেষ্ট সম্মান। পূর্বপুরুষ ছিলো মন্দিরের পুরোহিত। তার এক কাকা এখনো একজন পুরুত ঠাকুর। নিয়মিত পুজাঅর্চনা করে। বাবা ছোট চাকরি করে কিন্তু পাড়া প্রতিবেশী সমাজের সবাই সম্মান করে তাকে। সে নিজে ধর্মীয় আচার পালনে নিষ্ঠাবান। রোজ পুজা করে। তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ অনেক গভীর। ছোটবেলা থেকে বাবা মা তাদের সব ভাই বোনকে অন্য ধাঁচে মানুষ করেছে। সেই বংশের মেয়ে হয়ে কি করে রাস্তায় নামতে পারে! যখনই ভেবেছে গা ঘিন ঘিন করে উঠেছে।
অনেক ভেবে একটা বুদ্ধি বের করে। মহিলাকে বলে, সে করতে পারে সে কাজ, তবে যেহেতু কোনদিন করেনি, যার তার কাছে যাবেনা। শুধু যাকে তার পছন্দ হবে তার কাছেই যাবে। মহিলাকে তাতেই রাজী হতে হয়। হয়তো ভেবেছিলো প্রথম প্রথম দু’একবার বাছাবাছি করলে পরে যখন অভ্যস্ত হয়ে যাবে আর নখরামি করবে না। আজ সন্ধ্যায়ই সে প্রথম গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো রাস্তায়। শুধু কাউকে খুঁজতে যার কাছে সে সাহায্য চাইতে পারে। উৎকন্ঠায় ছিলো তেমন কাউকে পাবে কিনা। যদি না পায় কি করবে তাহলে! ভাগ্যের পরিনতি দেখে প্রায়ই কাঁদছিলো নিজের মনে। পরিবারের কেউ আসতে দিতে চায়নি। কেন সে তাদের কথা শুনলো না! শুধু একজন বলেছিলো, যেতে পারো।
শুধাই, কে সে?
আমার এক গনক ঠাকুর। আমার যে কোন ভালো মন্দের ব্যপারে জানতে আমি সবার আগে তার কাছে যাই। সে যা বলে, দেখেছি সত্য হয়েছে। এবারও আসার আগে যাই। গুনে অনেকক্ষন চুপ থেকে বলে, যেতে পারো। তার কথায় বিশ্বাষ করেই এলাম। আর এসে এই অবস্থায়-!
এতটুক বলে থামে। দম নিয়ে আবার শুরু করে। আমার সাথে দেখা হওয়ার ঘন্টা খানেক আগে এসে দাঁড়িয়েছিলো রাস্তায়। কিন্তু লজ্জায় আলোয় আসতে পারছিলো না। লুকিয়ে দাঁড়িয়েছিলো ওই অন্ধকারমতো জায়গাটায়। আরো কয়েকটা মেয়েকে দেখেছে ওখান দিয়ে ঘোরাফেরা করতে। মনে হয়েছে কয়েকজন তামিলও ছিলো তাদের মধ্যে। তবে চেনেনা কাউকে। মহিলা কয়েকজন লোককে ডেকে এনেছিলো, কিন্তু কাউকে মনে হয়নি নির্ভরযোগ্য। সবগুলো লাইনের লোক। সবাইকে না করেছে। এভাবে বেশ কয়েকজনকে ফিরিয়ে দেয়ায় মহিলা এক সময় রেগে যায়। বলে লোক সংগ্রহ করা কি সহজ কাজ? গন্ডায় গন্ডায় মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আশপাশ দিয়ে, সবাই টপাটপ কারো না কারো সাথে চলে যাচ্ছে। কাষ্টমার কি চাইলেই পাওয়া যায়! কিন্তু তার এক কথা, পছন্দ না হলে যাবেনা। এ সময়ই আমাকে দেখতে পায় মহিলার সাথে আলাপ করছি। প্রথমে মনে করেছিলো একই পথের পথিক। কিন্তু আমি যখন মহিলাকে বকা দেই ভারতীয় হয়ে এই ব্যবসায় নামার জন্য সে তাকায় আমার দিকে। এরপর গভীরভাবে লক্ষ্য করে চলে আমাকে। যখন বলি আমি এ লাইনের লোক না, রাস্তা থেকে মেয়ে টোকাই না, ওর মনে হয় এ লোককে কি বিশ্বাষ করা যায়! আমি ডাকলে কাছে গিয়ে দাঁড়ায় এবং ভালো করে দেখতে থাকে। বোঝার চেষ্টা করে আমাকে। এরপর ঠিক করে আমার সাথেই যাবে। কিন্তু আমি তাকে রুমে আনতে অস্বীকার করলে ভেঙ্গে পরে। তখনই মরীয়া হয়ে আমার রুম নম্বর জানতে চায়। এরপর সিদ্ধান্ত নেয় নিজেই আসবে আমার কাছে। রুমে ফিরে গিয়ে মহিলাকে বলে, প্রথম পুরুষ হিসেবে আমাকে তার পছন্দ হয়েছে। যদি নামতেই হয় এ ব্যবসায়, আমাকে দিয়েই শুরু করবে। তাকে যেন আমার রুমে নিয়ে আসে। মহিলা খুব একটা আগ্রহ দেখায় নাই। বলেছে এ লোক অন্য টাইপের মানুষ। এর কাছে গেলে কাজ হবেনা। কিন্তু সে জেদ ধরে বসে। বলে, যেহেতু টাকা দরকার তার, সে টাকার ব্যবস্থা করতে পারবে আমার কাছ থেকে। তাকে যেন আমার কাছে নিয়ে আসে। শেষে তার পীড়াপিরিতে মহিলা আসে এখানে।
চলবে…