বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিস একটি অতি পরিচিত রোগ। এটা শনাক্তের পর বাকি জীবন বয়ে বেড়াতে হয়। এই রোগে প্রতিদিন খাবার খাওয়ার সময় সচেতনতা ও নিয়মিত রক্ত পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন আছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যে ধরনের ডায়াবেটিসই থাকুক না কেন, শরীরের সঠিক কার্যক্রমের জন্য রক্ত শর্করাকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। কেননা অত্যধিক রক্ত শর্করা (হাইপারগ্লাইসেমিয়া) এবং অত্যল্প রক্ত শর্করা (হাইপোগ্লাইসেমিয়া) উভয়েরই প্রতিক্রিয়া বিপজ্জনক হতে পারে।
উচ্চ রক্ত শর্করার কারণ কি?
রক্ত শর্করা বেড়ে উচ্চ হলে অবশ্যই তা কমানোর পদক্ষেপ নিতে হবে, অন্যথায় ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিস ও হাইপারগ্লাইসেমিক হাইপারোসমোলার সিন্ড্রোমের মতো মারাত্মক সমস্যার ঝুঁকি আছে- উভয়েই ডায়াবেটিস রোগীকে হাসপাতালে পাঠানোর ক্ষমতা রাখে। উচ্চ রক্ত শর্করা নিয়ন্ত্রণে যত দেরী হবে, দীর্ঘমেয়াদী জটিলতার ঝুঁকি তত বাড়বে। রক্ত শর্করার লাগাম টেনে না ধরলে সময় পরিক্রমায় চোখ, কিডনি, স্নায়ু, পা ও হার্ট ভয়াবহ পরিণতিতে ভুগতে পারে।
হাইপারগ্লাইসেমিয়াকে (উচ্চ রক্ত শর্করা) ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে এর সম্ভাব্য উদ্দীপকগুলোকে চিনতে হবে। উচ্চ রক্ত শর্করার উদ্দীপক হিসেবে অধিকাংশ লোকের মনে প্রথমে যেটা আসে তা হলো খাবার, বিশেষ করে কার্বোহাইড্রেট। আরো নির্দিষ্ট করে বলতে বললে, হাইপারগ্লাইসেমিয়ার প্রধান উদ্দীপক হলো সরল কার্বোহাইড্রেট। যেসব খাবারের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স যত বেশি তা তত দ্রুত রক্ত শর্করা বাড়াতে পারে, যেমন- সাদা পাউরুটি, আলু ও ভাত।
রক্ত শর্করা বেড়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ হলো, ইনসুলিনের ডোজ নিতে ভুলে যাওয়া। ইনসুলিন পাম্পে ত্রুটি থাকলেও রক্ত শর্করা বেড়ে যেতে পারে। ইনসুলিন তাপের সংস্পর্শে এলেও হাইপারগ্লাইসেমিয়া হতে পারে। তাপের সংস্পর্শে এলে ইনসুলিন বিষাক্ত হয় তা নয়, কিন্তু এর কার্যক্ষমতা কমে যায়। কিছু ওষুধও বিবেচনার প্রয়োজন আছে। গবেষণায় বিটা-ব্লকার্স, অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিসাইকোটিকস ও স্টেরয়েডকে রক্ত শর্করার মাত্রা বাড়াতে দেখা গেছে।
উচ্চ রক্ত শর্করা বুঝবেন কীভাবে?
গ্লুকোমিটার দিয়ে খুব সহজে রক্ত শর্করার মাত্রা জানা যায়। গ্লুকোমিটার না থাকলে কিছু শারীরিক উপসর্গ দেখেও হাইপারগ্লাইসেমিয়া সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে। সাধারণত হাইপারগ্লাইসেমিয়া হলে কিডনি চেষ্টা করে যে রক্ত শর্করাকে শরীর থেকে বের করে দিতে। এসব শর্করা নিষ্কাশন করতে পানিরও প্রয়োজন হয়। এর ফলে ঘনঘন প্রস্রাবের চাপ আসে। শরীর থেকে পানি বেরিয়ে যায় বলে ঘনঘন পিপাসাও লাগতে পারে।
উচ্চ রক্ত শর্করার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উপসর্গ হলো- মাথাঘোরানো, হাতে ঝিনঝিন করা, ক্লান্তি, বমিভাব, বমি, পেট ব্যথা ও অস্পষ্ট দেখা।এসব উপসর্গকে অবহেলার সম্ভাবনা রয়েছে বলে নিয়মিত রক্ত শর্করা মেপে দেখা উচিত। হাইপারগ্লাইসেমিয়া কমানোর পদক্ষেপ না নিলে শরীরের টিস্যু ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে।
দ্রুত উচ্চ রক্ত শর্করা কমাতে যা করবেন
- ইনসুলিন গ্রহণ করুন: ইনসুলিনের ডোজ নিতে ভুলে গেলে অথবা পাম্প কাজ না করলে প্রথমে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। ডিউক ইউনিভার্সিটির মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বিয়াট্রিস হং জানান, ‘যখন ডায়াবেটিস রোগীর রক্ত শর্করা বেড়ে উচ্চ হয়, তখন ইনসুলিন নিলে কোষসমূহে শর্করার প্রবাহ সহজ হয়। এর ফলে রক্তে শর্করার মাত্রা কমে এবং কোষসমূহ অধিক শর্করা (জ্বালানি) পেয়ে থাকে।’
- ডায়াবেটিসের ওষুধ সেবন করুন: ডা. হং বলেন, ‘আমি সাধারণত এই পরামর্শ দিই না যে, কেবলমাত্র প্রয়োজন হলেই ডায়াবেটিসের ওষুধ ব্যবহার করবেন। বরং ডায়াবেটিসের ওষুধ প্রতিদিন বা শিডিউল অনুযায়ী চালিয়ে যেতে হয়। ওষুধ গ্রহণ করতে ভুলে গেলে রক্ত শর্করা হঠাৎ করে বেড়ে যেতে পারে। যদি দেখেন যে রক্ত শর্করা উচ্চ হয়ে গেছে, তখন ওষুধ সেবন করলে নিশ্চিতভাবে কমে আসবে।’ তবে এটা মনে রাখবেন যে, ডায়াবেটিসের ওষুধ (যেমন- মেটফরমিন) ইনসুলিনের মতো খুব দ্রুত কাজ করে না।
- পানি পান করুন: ইনসুলিন বা ওষুধ ব্যবহারের পাশাপাশি হাইড্রেশনের ওপর মনোযোগ দিতে হবে, অর্থাৎ যথেষ্ট পানি পান করতে হবে। ডা. রাইট বলেন, ‘জুস বা শরবত পান করবেন না, পর্যাপ্ত পরিমাণে সাধারণ পানি পান করতে হবে।’ ডায়াবেটিস জনিত মারাত্মক সমস্যা ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিসের ক্ষেত্রে শরীর পানিশূন্য (ডিহাইড্রেটেড) হয়ে পড়ে। ডা. হং বলেন, ‘রক্ত শর্করা উচ্চ হলে শরীর বাড়তি শর্করা বের করে দিতে তুমুল প্রচেষ্টা চালায়। শরীর অতিরিক্ত শর্করাকে প্রস্রাবের সঙ্গে বের করে দেয়, এসময় প্রচুর পানিও বেরিয়ে আসে।একারণে উচ্চ রক্ত শর্করায় ডায়াবেটিস রোগী ডিহাইড্রেটেড হয়ে যান এবং প্রচুর পানি পানের প্রয়োজন পড়ে।’
- হেঁটে আসুন: শরীরে ইনসুলিন নেওয়ার পর আশপাশে হাঁটতে পারেন, যদি বমিভাব বা অসুস্থতা অনুভব না করেন। ডা. হংয়ের মতে, যেকোনো প্রকারের অ্যারোবিক এক্সারসাইজ রক্ত শর্করা কমাতে সহায়ক হতে পারে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, খাবার খাওয়ার পর ২০ মিনিট পরিমিত গতিতে হাঁটলে রক্ত শর্করা সহজেই ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কমে যায়। এসময় শরীরের মাংসপেশি বেশি জ্বালানি ব্যবহার করে বলে এমনটা ঘটে- এই জ্বালানি হলো শর্করা। সতর্কতা হলো- ইনসুলিন না নিয়ে হাঁটতে বের হবেন না। এ প্রসঙ্গে ডা. রাইট বলেন, ‘কেউ ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিসের দ্বারপ্রান্তে থাকলে তিনি ইনসুলিন না নিয়ে হাঁটতে থাকলে মারাত্মক কিছু ঘটতে পারে।’
- স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণে রাখুন: স্ট্রেস তথা মানসিক চাপ রক্ত শর্করার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে। স্ট্রেসে থাকলে করটিসোলের মতো হরমোন রক্ত শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে দেয় ও শরীরের ইনসুলিন ব্যবহারের কার্যক্ষমতা কমিয়ে ফেলে। অটোইমিউন রোগের গবেষক লিনা ভেলিকোভা বলেন, ‘রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার কিছু চমৎকার উপায় হলো- স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, শরীরচর্চা করা ও যথেষ্ট পানি পান করা। কিন্তু প্রচুর স্ট্রেসে ভুগলে এসবে কাজ নাও হতে পারে।’ তিনি স্ট্রেস কমাতে শরীরচর্চা, ধ্যান ও ডায়েরি লিখতে পরামর্শ দিচ্ছেন। এছাড়াও স্ট্রেস কমানোর আরো কার্যকর উপায় রয়েছে, যেমন- ঘুরে বেড়ানো বা প্রকৃতি দেখা।
কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন?
ডা. হংয়ের মতে, কারো টাইপ ১ ডায়াবেটিস থাকলে তার সঙ্গে সবসময় কিটোন স্টিকস থাকা উচিত। এসব স্টিকস দিয়ে প্রস্রাবে কিটোন শনাক্ত করা হয়। তিনি বলেন, ‘যদি হাইপারগ্লাইসেমিয়া দেখেন বা ডায়াবেটিস সংক্রান্ত অসুস্থতা অনুভব করেন, তাহলে প্রস্রাব পরীক্ষা করুন।পজিটিভ হলে চিকিৎসকের কাছে বা জরুরি বিভাগে যেতে হবে।’ তিনি আরো জানান, ‘যে ধরনের ডায়াবেটিসই থাকুক না কেন, খুব বেশি অসুস্থতাবোধ করলে অথবা বমিভাব-বমি-তীব্র পেট ব্যথা-বিভ্রান্তি-অস্পষ্ট চিন্তাভাবনার মতো উপসর্গে ভুগলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত।’ হাইপারগ্লাইসেমিয়া কমানোর উপায় (যেমন- ইনসুলিন নেওয়া ও পানি পান) অবলম্বনের পরও পরিস্থিতির সুরাহা না হলে অবশ্যই জরুরি চিকিৎসা নিতে হবে।