-মোরসালিন মিজান
সুদূরের দেশ কানাডায় বসে, জানি, বহু বাঙালী অমর একুশে গ্রন্থমেলার খোঁজ খবর নিয়েছেন। বাংলাদেশে আয়োজিত মেলায় নতুন কী বই আসছে? বিখ্যাত লেখকেরা কবিরা তাদের কোন কোন রচনার জন্য বিশেষভাবে আলোচিত হচ্ছেন? বিক্রিতে কে এগিয়ে? আরও কত প্রশ্ন! সবই বলা চলে গত হলো। শেষ হলো একমাস বয়সী মেলা। মনেই হয় না একমাস ধরে চলেছে, যেন সেই দিন শুরুটা হলো, এখনও অনেকদিন বাকি, আসলে শেষ। বাঙালীর ভাষা চেতনার উজ্জ্বল প্রকাশ অমর একুশে গ্রন্থমেলা শেষ হয়েছে।
ফেব্রæয়ারির আয়োজন হিসেবে আলাদা ভাব ও বৈশিষ্ট্য অর্জন করা মেলা এবার মার্চে গড়ায়। বৃষ্টি হানা দিয়েছিল। কিছুটা বিঘিœত হয়েছিল মেলার কার্যক্রম। এ কারণে সময় বাড়ানো। নির্ধারিত সময়ের দু’দিন পর পরিসমাপ্তি ঘোষণা করা হয় মেলার। হ্যাঁ, শেষ। তবে রেশ রয়ে গেছে। এখনও বইমেলার এটা নিয়ে ওটা নিয়ে আলোচনা চলছে ঢাকায়। বাংলাদেশের প্রতি প্রান্তে ছড়িয়ে গেছে মেলায় প্রকাশিত বই। কানাডা থেকে একাধিক কবি ও লেখক এ উপলক্ষ্যে দেশে এসেছিলেন। কারও কারও বই বের হয়েছে। হোসনে আরা জেমী বাংলাদেশে যখন ছিলেন, আবৃত্তি করতেন। এবার মেলায় এসেছে নিজের লেখা প্রথম কবিতার বই। এ নিয়ে দারুণ উচ্ছ¡াস। উত্তেজনা। মেলায় সবগুলো বই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। নিজের কপিটাও নেই! এই না থাকার আনন্দ আছে। আনন্দ নিয়ে ফিরে গেছেন কানাডায়। ব্যস্ত জীবনে ফিরেছেন অন্য প্রবাসীরাও। কিন্তু মেলায় ¯^শরীরে উপস্থিত থাকার মধুর স্মৃতি তারা নিশ্চয়ই ভুলতে পারেননি। প্রতিদিন শাহবাগ- টিএসসি-দোয়েল চত্তর হয়ে বাংলা একাডেমিতে প্রবেশ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘুরে বেড়ানো। গল্প আড্ডা। সে কি ভুলা যায়? বরং বারবারই পেছনে ফিরে দেখছেন হয়ত। কী দেখা যায় পেছন ফিরে তাকালে? চলুন তবে দেখে আসা যাক।
অমর একুশে গ্রন্থমেলা বাংলাদেশে বইকেন্দ্রীক সবচেয়ে বড় আয়োজন। কালক্রমে আয়োজনটি বঙ্গ সংস্কৃতির মহোৎসবে পরিণত হয়েছে। প্রতিবারের মতোই বাঙালী জাতিসত্তা ও বুদ্ধিত্তিক উৎকর্ষের প্রতীক বাংলা একাডেমি এ মেলার আয়োজন করে। একাডেমি প্রাঙ্গণে ১ ফেব্রæয়ারি মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দেশের প্রায় সব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এ মেলায় অংশ নেয়। প্রায় ৩ লাখ বর্গফুট আয়তনের মেলা। একাডেমি প্রাঙ্গণে ছিল ১০৪ সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। তারুণ্যের প্ল্যাটফর্ম লিটল ম্যাগাজিন চত্বরও ছিল এ অংশে। বয়ড়াতলায় ১৮০ লিটলম্যাগকে বরাদ্দ দেয়া হয় ১৫৫টি স্টল।
বইয়ের মূল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে। চার চত্বরে বিন্যস্ত উদ্যানে ৩৯৫ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান স্টল ও প্যাভিলিয়ন সাজায়। বাংলা একাডেমিসহ ২৪ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পায় ২৪টি প্যাভিলিয়ন। সব মিলিয়ে মেলায় অংশ নেয় ৪৯৯ প্রতিষ্ঠান।
মেলার প্রতিদিন এসেছে নতুন নতুন বই। সংখ্যায় বেশি ছিল কবিতা। প্রচুর এসেছে গল্প উপন্যাস। ইতিহাস প্রবন্ধ মুক্তিযুদ্ধসহ নানা বিষয়ে গবেষণামূলক বই প্রকাশিত হলেও সংখ্যায় ছিল খুবই কম। ৩০ দিনে মেলায় নতুন বই আসে মোট ৪ হাজার ৮৩৪টি।
মেলায় কত বই বিক্রি হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বইয়ের হিসেবে থেকে অন্যদের বিক্রি সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব জালাল আহমেদ জানিয়েছেন, ৩০ দিনে একাডেমির মোট বিক্রি প্রায় ২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। অন্যান্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের বিক্রিও এবার বেড়েছে বলে মত দেন তিনি। তার মতে, মেলার মোট বিক্রি গত বছরের তুলনায় ১০ ভাগ বেড়েছে। বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ ও পর্যবে¶ণের তুলে ধরে জালাল আহমেদ জানান, মেলায় সব মিলিয়ে ৮০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে।
অবশ্য প্রকাশকরা একাডেমির দেয়া বিক্রির হিসাব মানতে নারাজ। এ সম্পর্কে মেলার শেষ দিন প্রকাশক নেতা ও অন্যপ্রকাশের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। প্যাভিলিয়নে বসে তিনি বলছিলেন, মেলায় ৮০ কোটি টাকা বিক্রি হওয়ার তথ্য অবাস্তব। তিনি বলেন, গত বছর একাডেমি জানিয়েছিল, ৭০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। এক বছরের ব্যবধানে ১০ কোটি টাকা বেড়ে গেল, এটা কী সম্ভব? প্রশ্ন রাখেন তিনি।
একই বিষয়ে উৎস প্রকাশনের কর্ণধার মোস্তফা সেলিম বলছিলেন, বিক্রির যে হিসাব একাডেমি দিয়েছে সেটি তাদের কল্পনা মাত্র। অনুমানের ওপর ভিত্তি করে এমন হিসাব দেয়া অনুচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি। তাহলে প্রকৃতপক্ষে কত টাকার বই বিক্রি হয়েছে বলে মনে করেন আপনি? এমন প্রশ্নে হিসাব করে বলতে হবে বলে জানান তিনি।
ল¶ণীয় প্রবণতা : এবারও মেলায় পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত লেখকদের বই ছিল মূল আকর্ষণ। কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হক, সেলিনা হোসেন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, শাহাদুজ্জামান, নাসরিন জাহানের নতুন বই এসেছে। জনপ্রিয় ধারার রচনা সম্ভার নিয়ে মেলায় ছিলেন ঔপন্যাসিক ইমদাদুল হক মিলন, আনিসুল হক, সুমন্ত আসলাম, সাদাত হোসাইনসহ কয়েকজন। আর ছোটরা ঘিওে রেখেছিল তাদের সবচেয়ে প্রিয় সায়েন্স ফিকশন লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালকে। কিশোরদের আরেক প্রিয় লেখক মোশতাক আহমেদ। তার কল্পবিজ্ঞানও পড়ছে ছোটরা। ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে লেখা মুনতাসীর মামুনের বই মেলাকে সমৃদ্ধ করেছে। এসেছে বিশিষ্টজনদেও লেখা স্মৃতিকথা। আবার তাদের নিয়ে অন্যদেও লেখা বইও আলোচনায় এসেছে। এ ধরনের রচনাগুলোর মধ্যে বিশেষ আলোচিত ছিল ‘আমি সিরাজুল আলম খান: একটি রাজনৈতিক জীবনালেখ্য।’ রাজনীতির রহস্য পুরুষ সিরাজুল আলম খানের অজানা অনেক কিছু বইতে ওঠে এসেছে। মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত বইয়ের সমস্ত কপি ফুরিয়ে যায় মেলা শেষ হওয়ার আগেই।
চিরায়ত সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ ছিল সব সময়ের মতোই। প্রয়াত লেখকদের বিখ্যাত রচনাগুলোও সংগ্রহ করেছেন নবীন পাঠকেরা।
তবে চোখের সামনে বেশি ঘুরঘুর করেছেন মৌসুমি লেখকরা। তাদের অ¯^স্তিকর প্রচার চোখে পড়েছে প্রতিদিনই। সাহিত্যমান ও বিক্রির জায়গা থেকে এ অংশটির অবদান শূন্যেও কোটায় বলে প্রতীয়মান হয়েছে। মেলায় আসা মোট বইয়ের তুলনায় মানসম্পন্ন বইয়ের সংখ্যা তাই অনেক কম। বাংলা একাডেমি মানসম্পন্ন বই খুঁজে দেখার একটি চেষ্টা করেছিল। তাতে দেখা যায়, মানসম্পন্ন বই এসেছে প্রায় ১হাজার ২০০টি।
মৌসুমি লেখকদের মতো মেলায় ছিলেন মৌসুমি প্রকাশকরাও। মূলত দোকানদারি করেছেন তারা। মেলার নীতিমালা ভঙ্গের অপরাধে এ ধরনের ১১ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শাও নোটিস দেয় বাংলা একাডেমি।
এবারও মানসম্পন্ন বইয়ের সংখ্যা কম হওয়ায় খারাপ লাগা আছে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লা সিরাজীর। বিষয়টি নিয়ে কয়েকদিন কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, মেলায় প্রচুর বই আসছে। আমরাও চাই, আসুক। কিন্তু মান বৃদ্ধি করা খুব জরুরী। এ জন্য মৌসুমি লেখক ও প্রকাশকদের দায়ী করে তিনি বলেন, আগামী মেলায় বাজারি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুৎসাহিত করা হবে। মানসম্পন্ন বই ছাড়া মেলায় স্টল দেয়া হবে না তাদের। এ লক্ষ্যে আগামী মেলায় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমিয়ে আনা হবে বলেও ইঙ্গিত দেন তিনি।
মেলায় নতুন সংযোজন : মেলায় নির্বাচিত নতুন বই নিয়ে এবার প্রথমবারের মতো আয়োজন করা হয় ‘লেখক বলছি’ শীর্ষক অনুষ্ঠান। এই মঞ্চে প্রতিদিন ৫ জন লেখক তাদের বই নিয়ে পাঠকের মুখোমুখি হন। প্রত্যেকে নিজের বই সম্পর্কে আলোচনা করেন। পাঠকের প্রশ্নের উত্তর দেন।
এবারও মেলার দ্বিতীয় দিন থেকে প্রতিদিন বিকেলে বইমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় গুরুত্বপূর্ণ সেমিনার। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি-সমকালীন প্রসঙ্গ নিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। চলে আলোচনা। একই সঙ্গে বিশিষ্ট বাঙালী মনীষীদের জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা হয়। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আর এবার নতুন যোগ হয় কবিতা। প্রতিদিনই ছিল কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ এবং আবৃত্তি। শিশু কিশোরদের জন্যও ছিল নানা আয়োজন।
এভাবে পুরো একটি মাস। এ সময়ের মধ্যে বইয়ের মেলা বাঙালী সংস্কৃতির উৎসবে পরিণত হয়েছিল। অমর একুশে যেমন গর্বের, তেমনি বাঙালি গর্ব করতে পারে অমর একুশে গ্রন্থমেলা নিয়েও।
সিনিয়র রিপোর্টার, দৈনিক জনকণ্ঠ, ঢাকা