একদিকে আনন্দ, অন্যদিকে বিষাদের সুর। আজ শুক্রবার যুক্তরাজ্যবাসীর দিনের শুরুটা হয় এমন মিশ্র আবেগ নিয়ে। ঘড়ির কাটা স্থানীয় সময় রাত ১১টা ছোঁয়া মাত্রই ঘটে যাবে ব্রেক্সিট (ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইইউর সঙ্গে বিচ্ছেদ)। অবসান ঘটবে দীর্ঘ ৪৭ বছরের সম্পর্কের।
বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তোলা এই বিচ্ছেদ ঘিরে গত তিন বছরের বেশি সময় পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল বাগ্বিতণ্ডায় কাটিয়েছে ব্রিটিশরা। গতকাল সেই ঐতিহাসিক বিচ্ছেদের দিনেও তাদের সেই বিভক্তি বজায় থাকল।
স্থানীয় সময় বিকেল ৩টা থেকে ওয়েস্টমিনস্টারের পার্লামেন্ট স্কয়ারে জড়ো হন ব্রেক্সিট বিরোধীরা। তাঁরা শেষবারের মতো মিছিলে-স্লোগানে ব্রেক্সিটের বিপক্ষে নিজেদের অবস্থান জানান দেন। জানান ইইউর প্রতি ভালোবাসা। কোনো একদিন আবার ইইউর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রত্যয় ভেসে আসে এই সমাবেশ থেকে। বিচ্ছেদের ক্ষণটিতে তাঁরা মোমবাতি প্রজ্বলন করবেন।
ব্রেক্সিট-বিরোধীদের এই জমায়েতের আগ থেকেই ব্রেক্সিট আনন্দে সাজতে শুরু করে ওয়েস্টমিনস্টার এলাকা। পতাকার খুঁটিগুলোতে শোভা পাচ্ছে যুক্তরাজ্যের পতাকা। সকাল থেকেই চলে হোয়াইট হল খ্যাত সরকারি ভবনগুলোর দেয়ালে বর্ণিল আলোর খেলার আয়োজন। ব্রেক্সিট-বিরোধীদের ওয়েস্টমিনস্টার এলাকা ত্যাগের পরপরই ওই এলাকার দখলে নেবেন ব্রেক্সিট-পন্থীরা। নেচে-গেয়ে তাঁরা বিচ্ছেদের ঐতিহাসিক ক্ষণটি উদ্যাপন করবেন। রাত ১০টায় প্রধানমন্ত্রী ভবনের দেয়ালে আলোর ঘড়িতে শুরু হবে বিচ্ছেদের ক্ষণ গণনা। একই সময়ে প্রধানমন্ত্রী জনসন দেশবাসীর উদ্দেশে একটি ভিডিও বার্তা প্রকাশ করার কথা। রাতব্যাপী চলবে উদ্যাপন। ইইউ-বিরোধীদের কাছে এই বিচ্ছেদ যুক্তরাজ্যের স্বাধীনতা অর্জনের মতো ঘটনা।
তবে উদ্যাপনের এমন আয়োজন নিয়ে আছে সমালোচনা। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী যখন দেশবাসীকে ব্রেক্সিটের বিভক্তি ভুলে জাতীয় ঐক্য গড়ার আহ্বান জানাচ্ছেন, তার পাশাপাশি এক পক্ষের (ব্রেক্সিট বিরোধীদের) পরাজয় উদ্যাপন কতটা বিবেক প্রসূত- তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
দিবসটি স্মরণীয় করে রাখতে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এদিন সকালে সানডারল্যান্ড শহরে মন্ত্রিসভার বৈঠক করেন। ২০১৬ সালের গণভোটের প্রথম ফলাফল আসে এই শহর থেকে, যা ছিল ব্রেক্সিটের পক্ষে। গণভোটে বরিস জনসন ব্রেক্সিটপন্থীদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
শুক্রবার এই বিচ্ছেদ ঘটলেও ইইউর সঙ্গে যুক্তরাজ্যের বিদ্যমান সম্পর্কের এখনই কোনো বদল হচ্ছে না। অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে বিদ্যমান সম্পর্কগুলো আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত বজায় থাকবে। এ সময়ে যুক্তরাজ্য ইইউর আইন মেনে চলবে। কিন্তু ইইউর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার ব্রিটিশরা আর অংশ নিতে পারবে না। শুক্রবার রাত ১১টা বাজতেই ইইউ থেকে সরে যাবে যুক্তরাজ্যের পতাকা। একইভাবে রাত ১১টার পর যুক্তরাজ্যের সরকারি ভবনগুলোতেও আর ইইউর পতাকা উড়বে না।
২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত এক গণভোটে যুক্তরাজ্যের ৫২ শতাংশ মানুষ ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। আর বিপক্ষে ছিল ৪৮ শতাংশ। ২০১৯ সালের ২৯ মার্চ এই বিচ্ছেদের সময় নির্ধারিত ছিল। কিন্তু যুক্তরাজ্যে সরকার বনাম পার্লামেন্টের বিরোধের কারণে এত দিন সেই বিচ্ছেদ কার্যকর করা যায়নি। এই বিরোধের জের ধরে থেরেসা মেকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বিদায় নিতে হয়। ব্রেক্সিটপন্থী নতুন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন গত ডিসেম্বরের মধ্যবর্তী নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফেরার পর ব্রেক্সিট কার্যকরের সকল বাধা দূর হয়ে যায়।
যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেন, এই বিচ্ছেদ যুক্তরাজ্যের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তাঁর বিশ্বাস ব্রেক্সিটের লাভ-ক্ষতি নিয়ে নানা আশঙ্কা থাকলেও যুক্তরাজ্য ভালো কিছু করবে। ক্যামেরন ২০১৬ সালের ওই ব্রেক্সিট গণভোটের আয়োজন করেছিলেন। তবে তিনি ইইউতে থাকার পক্ষে প্রচার চালান। গণভোটে হেরে যাওয়ায় তিনি পদত্যাগ করেন।
লেবার নেতা জেরেমি করবিন যুক্তরাজ্যকে অন্তর্মুখী না করার আহ্বান জানিয়েছেন। সত্যিকারের আন্তর্জাতিকমনা, বৈচিত্র্যময় দেশ হিসেবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান তিনি।