পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেছেন, ‘আমরাই সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র জাতি, যারা মাতৃভাষার মর্যাদার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছি। আমাদের মাতৃভূমির সাহসী সন্তানেরা সেই বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।’
মঙ্গলবার (২১ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ‘শহিদ দিবস’ ও ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২০২৩’ উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রথম আঘাত আসে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার ওপর। যদিও আমরা বাঙালি জনগণ তৎকালীন পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশেরও বেশি ছিলাম, কিন্তু পাকিস্তান সরকার নির্লজ্জভাবে আমাদের মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। তৎকালীন পাকিস্তানের মাত্র ৪ শতাংশ জনগণের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করেছিল। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন এই অন্যায় পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘১৯৪৮ সালে বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাব অনুযায়ী ছাত্র সংগঠনগুলোর সমন্বয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে তারা ধর্মঘটের ডাক দেয় এবং সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে কারারুদ্ধ করা হয়।’
ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলনেও গতি ও শক্তি যুগিয়েছে, উল্লেখ করে শাহরিয়ার আলম বলেন, ভাষা আন্দোলনের বিজয় বাঙালিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সময়ে আমাদের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে ১৯৬৬ সালের ছয় দফা দাবি, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং অবশেষে ১৯৭১ সালে আমাদের মহান স্বাধীনতার মতো বিজয়গুলো ভাষা আন্দোলনের চেতনা ও আদর্শের প্রভাবেই অর্জিত হয়েছে।’
ভাষা আন্দোলনের চেতনার স্বীকৃতি প্রদানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী ভাষাগত বৈচিত্র্য এবং বহুভাষিকতার প্রচারের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা বাংলাদেশের অবদানেরই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।’
ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে আন্তর্জাতিকীকরণে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টার ফলে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘ ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করে এবং বিশ্বের সকল ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ২০০০ সাল থেকে দিবসটি ইউনেস্কোর সকল সদস্য রাষ্ট্রে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে।
ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা ও প্রসারে শেখ হাসিনার সরকার সবকিছু করছে উল্লেখ করে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘ঢাকায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট স্থাপন এবং ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে একটি ভাষা জাদুঘর স্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশে আমরা সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করেছি। এছাড়া, স্থানীয় এবং আঞ্চলিক উপভাষাগুলোকেও সমানভাবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে।’
কর্মসূচির শুরুতে সকালে শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে রাজধানীর বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমির সুগন্ধা প্রান্ত থেকে প্রভাতফেরি বের হয়। এতে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, পররাষ্ট্র সচিব (সিনিয়র সচিব) মাসুদ বিন মোমেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ফরেন সার্ভিস একাডেমির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ঢাকাস্থ বিদেশি কূটনীতিকরা অংশ নেন। প্রভাতফেরি ফরেন সার্ভিস একাডেমির মূল ভবনের সম্মুখে স্থাপিত অস্থায়ী শহিদ মিনারের সামনে এসে শেষ হয়। শহিদ মিনারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ হতে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিব (সিনিয়র সচিব), অন্যান্য কর্মকর্তা, ফরেন সার্ভিস একাডেমির পক্ষ হতে রেক্টর ও অন্যান্য কর্মকর্তা, ফরেন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির নেতৃত্বে সংগঠনের সদস্যবৃন্দ এবং ঢাকাস্থ কূটনৈতিক কোরের সদস্যবৃন্দ পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
পরে ফরেন সার্ভিস একাডেমির অডিটরিয়ামে আয়োজিত আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন ফরেন সার্ভিস একাডেমির রেক্টর মাশফি বিনতে শামস। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন ঢাকায় নিযুক্ত ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত ম্যারি মাসদুপুই।
অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র সচিব (সিনিয়র সচিব) মাসুদ বিন মোমেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিববৃন্দ, ঢাকায় নিযুক্ত কূটনীতিকবৃন্দ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ফরেন সার্ভিস একাডেমির কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক পর্বে ফরেন সার্ভিস একাডেমির প্রশিক্ষণার্থী কর্মকর্তা (বাংলাদেশি ও বিদেশি), ঢাকাস্থ বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাসের পক্ষ থেকে অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন ভাষায় সঙ্গীত ও নৃত্য পরিবেশ এবং কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে উপস্থিত দর্শকদের মুগ্ধ করেন।