আওয়ামী লীগ সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার পথে ছাত্রলীগ কাণ্ডারির ভূমিকা পালন করবে প্রত্যাশা রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংগঠনটির নেতাকর্মীদের দেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন।
শুক্রবার (১ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রলীগ আয়োজিত ছাত্র সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে এ কথা বলেন তিনি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব স্মরণে ‘স্মরণকালের সর্ববৃহৎ ছাত্র সমাবেশ’ আয়োজন করে ছাত্রলীগ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার একটাই লক্ষ্য, বাংলাদেশকে উন্নত করা। ’৪১ এর স্মার্ট বাংলাদেশের কাণ্ডারি হবে ছাত্রলীগ, সেটাই আমি তোমাদের কাছে চাই। শুধু ’৪১ সালে থেমে থাকবে না, ডেল্টা প্ল্যানও করে দিয়েছি। কেউ বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা থামাতে পারবে না। এজন্য অতন্দ্র প্রহরীর মতো থাকতে হবে।
স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে তার সরকার প্রযুক্তিকে তৃণমূল পর্যায়ে নিয়ে যেতে যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, তা উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।
এ সময় দেশের প্রতিটি অধিকার আদায়ের সংগ্রামে ছাত্রলীগের অগ্রণী ভূমিকা পালনের বিষয়টি উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন,‘ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাই হয়েছিলো মুক্তিকামী মানুষকে মুক্তি দেওয়ার জন্য। বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া এই সংগঠন, যে সংগঠন প্রতিটি অর্জনের সঙ্গে জড়িত। শহীদের তালিকায় ছাত্রলীগই অগ্রণী। এদেশের প্রতিটি অধিকার আদায়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের ইতিহাস ছাত্রলীগেরই ইতিহাস।’
‘১৫ আগস্টের পর ছাত্রলীগই প্রথম প্রতিবাদ করে। আমাকে যখন গ্রেপ্তার করা হয় ছাত্রলীগই প্রথম প্রতিবাদ করেছিলো। ছাত্রলীগই হচ্ছে সেই তারুণ্যের শক্তি, যে শক্তি একদিন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। ছাত্রলীগ যেকোনো সময় দুর্যোগ-দুর্বিপাকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ১/১১ এর সময়ে ছাত্রলীগ আপস করেনি সর্বপ্রথম মাঠে নেমে এর প্রতিবাদ করেছে। করোনার সময়ে ছাত্রলীগকে দেখেছি মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। তাদের হাসপাতালে নেওয়া, খাদ্যের ব্যবস্থা করা, চিকিৎসার জন্য যা কিছু প্রয়োজন ছাত্রলীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। করোনার সময়ে শ্রমিক সংকটে ছাত্রলীগ কৃষকের ধান কেটে দিয়েছে।”
তিনি মানুষের পাশে থাকায় ছাত্রলীগের প্রতিটি সদস্যদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির পিতাকে হত্যার পর যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা বিজয়ের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর নাম, ৭ মার্চের ভাষণ, জয় বাংলা স্লোগান নিষিদ্ধ, রেডিওসহ সব নাম পরিবর্তন করেছে মোশতাক-জিয়ারা। জিয়া ক্ষমতায় এসেছিলো আমাদের চেতনাকে ধ্বংস করার জন্য। আজকে অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা মানবাধিকারের কথা বলে। আমার প্রশ্ন, ১৫ আগস্ট যখন মা-বাব সব হারালাম, আমাদের তো বিচার চাওয়ার অধিকার ছিলো না। আমরা তো বিচার চাইতে পারিনি।’
আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়ে দেশে ফিরে আসার সময়ে বাধা বিপত্তির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, মৃত্যুকে কখনো ভয় করিনি। দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে যে স্বপ্ন নিয়ে আমার বাবা সারাজীবন কষ্ট সহ্য করেছেন, সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য এসেছি। সারাদেশ ঘুরে বেরিয়েছি। কখনো রিকশা, কখনো ভ্যান, ছোট্ট ডিঙ্গি, নৌকা রেল, খালি পায়ে নদীর পাড় ধরে হেঁটেছি। দেখতে চেয়েছিলাম এদেশের মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি না?’
তিনি বলেন, স্বাধীনতা যাতে নস্যাৎ হয় কিছু লোক এটা চেয়েছিলো। এজন্য স্বাধীনতার পরই ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিলো। তারা স্বাধীনতাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলো। স্বাধীনতার পর যে চক্রান্ত শুরু হয়েছিলো, সেটা শেষ হয়নি। ২০০১ সালে গ্যাস বিক্রি করতে আমি রাজি হয়নি। খালেদা জিয়া রাজি হয়েছিলো। নির্বাচনে আমার নেতাকর্মীরা ভোট কেন্দ্রে যেতে পারেনি। নির্বাচনের পর অকথ্য অত্যাচার করেছে, হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিলো।
‘ক্ষমতায় এসে পাঁচ বার দেশকে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ান করেছিলো। সেশনজটে যাতাকলে ছাত্ররা, শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট, ক্যাম্পাসে অস্ত্রের ঝনঝনানি শুরু করলো বিএনপি। হাওয়া ভবন খুলে সারাদেশে লুটপাট শুরু করলো।’
বিএনপি কখনো দেশের কল্যাণ চাইতে পারেন না মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই লুটেরা, সন্ত্রাসে বিশ্বাসী। এরা মানুষের কল্যাণ করতে পারে না। দশ ট্রাক অস্ত্র, জঙ্গি, প্রতিটি ক্ষেত্রে দেশকে হেয় করেছে। তারা জনগণের ভোটের অধিকার নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে চায়। তাদের জন্মই অবৈধ মিলিটারি ডিক্টেটরের হাতে। তারাই এখন গণতন্ত্রের কথা বলে। তারা এদেশের কল্যাণে চাইতে পারে না।
যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে মানুষের কল্যাণ হয়েছে উল্লেখ করে দলের সভাপতি বলেন, রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে ছিলাম, নিজের জন্য কিছু করতে আসিনি। দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে এসেছি। সন্তানদের শিক্ষা দিয়েছি, ধন সম্পদ কোনো কিছুই কাজে লাগে না।
মিথ্যা অপবাদে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়া এবং নিজের টাকায় তা বাস্তবায়নের প্রসঙ্গ তুলে শেখ হাসিনা বলেন, ‘একটা ব্যাংকের এমডি পদের জন্য, সেটাও সরকারি, সেই সরকারি বেতনধারী…আইনে আছে ৬০ বছরের বেশি থাকতে পারবে না। তারপরও ১০ বছর বে-আইনিভাবে থেকে আরো থাকতে হবে। এ নিয়ে একটি বড় দেশের আমাদের ওপর চাপ। এমডি না রাখলে নাকি পদ্মা সেতুর টাকা বন্ধ করবে। আমাদের বিরুদ্ধে, সরকারের বিরুদ্ধে সেই লোক মামলাও করেছে, মামলায় হেরে যায়। তারপর বিদেশি বন্ধু দ্বারা…বিশ্বব্যাংকের বোর্ডে এই সিদ্ধান্ত হয়নি। হিলারী ক্লিনটন বিশ্বংব্যাকের সভাপতিকে দিয়ে বন্ধ করে।
‘নিজের টাকা পদ্মা সেতু করে বিশ্বকে দেখিয়েছি এদেশের মানুষ পারে, তা করে দেখিয়েছি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না। বাঙালি জাতিতে দাবায়ে রাখতে পারে নাই। দেখিয়েছি চাইলে আমরা নিজের টাকায় করতে পারি। এরপরই এ দেশের প্রতি বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গেছে।”
যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের চিত্র তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, যখন এসব শুরু করি অনেকে সমালোচনা করেছে। যেভাবে রাস্তাঘাট করে দিয়েছি যেকোনো জেলা থেকে দ্রুত মানুষ ঢাকায় আসতে পারে।
সরকারের উন্নয়ন যারা দেখে না তাদের ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে চক্ষু ইনস্টিটিউটে চোখের চিকিৎসা নেওয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
এ সময় বঙ্গবন্ধুর লেখা বইগুলো পড়তে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এখান থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। একই সঙ্গে দেশের খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে অনাবাদী জমিকে চাষাবাদের আওতায় আনতে এবং বৃক্ষরোপণ করাতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান।
সর্বজনীন পেনশনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি দেখলাম বিএনপির কিছু নেতা বললেন, এটা নাকি নির্বাচনের ফান্ড তৈরি করার জন্য। এরচেয়ে লজ্জার কিছু হতে পারে না। নিজেরা কিছু দিতে পারেনি, এখন মানুসের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে।
এর আগে বেলা ৩টায় সমাবেশ শুরুর কথা থাকলেও এর আগেই পূর্ণ হয়ে যায় সমাবেশস্থল। সমাবেশস্থলের প্রবেশ করতে নেতাকর্মীদের দীর্ঘ লাইন ছিল। সমাবেশ শুরুর আগেই সারা দেশ থেকে আসা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। বেলা ৩টা ৪০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী সমাবেশের মঞ্চে আসেন। তার আগমনে স্লোগান দিতে থাকেন নেতাকর্মীরা।
প্রধানমন্ত্রী মঞ্চে আসার পরে জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। এরপর ছাত্রলীগের দলীয় সংগীত এবং দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করে মাতৃভূমি সাংস্কৃতিক সংসদ। এরপর জাতির পিতার ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। শোক জানানো হয় এক মিনিট নীরবে দাঁড়িয়ে।
প্রধানমন্ত্রীকে ছাত্রসমাবেশে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে স্মারক উপহার দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুকন্যার হাতে স্মারকটি তুলে দেন ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। ছাত্রলীগের অভিভাবক শেখ হাসিনাকে ব্যাচ পরিয়ে দেন সংগঠনের চার নারী নেত্রী। এ সময় ছাত্রলীগের ম্যাগাজিন ‘মাতৃভূমি’র মোড়ক উন্মোচন করা হয়। উন্মুক্ত করা হয় শোক দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত ছাত্রলীগের পোস্টার।
সমাবেশে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
সভাপতিত্ব করেন ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালি আসিফ ইনান।
সমাবেশ মঞ্চে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও মন্ত্রিপরিষদ সদস্যসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন।