প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পি কে হালদার ছিলেন গরিব পরিবারের সন্তান। তবে, তিনি মেধাবী। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পড়াশোনা শেষ করেন। এ মেধাবী শিক্ষার্থী মেধাকে কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নয়নে অবদান না রেখে তার মা, ভাইসহ ঘনিষ্ঠজনদের সহযোগিতায় অসংখ্য নামি-বেনামি প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে পাহাড়সমান অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। হয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক।
এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডসহ বিভিন্ন কাগুজে প্রতিষ্ঠান তৈরির মাধ্যমে অন্তত সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা লোপাট করে তা পাচার করেছেন পি কে হালদার। হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বিভিন্ন সময়ে ৫২টি মামলা করে। এর মধ্যে রোববার (৮ অক্টোবর) ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১০ এর বিচারক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম ৪২৫ কোটি ৯৬ লাখ ২৯ হাজার ১৪০ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও পাচারের মামলায় পি কে হালদারসহ ১৪ জনকে কারাদণ্ড দিয়েছেন। পি কে হালদারকে পৃথক দুই ধারায় ২২ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তার মা লিলাবতী হালদার, ছোট ভাই প্রিতিশ কুমার হালদারসহ ১৩ জনকে পৃথক দুই ধারায় সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অপর ৫১টি মামলা তদন্তাধীন।
রায় হওয়া মামলার নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, প্রশান্ত কুমার হালদার পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর থানাস্থ দিঘিরজান গ্রামের গরিব পরিবারের সন্তান। তার মা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। পি কে হালদার ২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকা অবস্থায় নিজের নামে ও ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের নামে অসংখ্য কাগুজে কোম্পানি গড়ে তোলেন। তিনি আয়করদাতা হিসেবে ২০২০-২০২১ করবর্ষে মোট আয় ১২ কোটি ৯ লাখ ৬৪ হাজার ৩২৬ টাকা ও মোট ব্যয় ৪ কোটি ৮ লাখ ১৬ হাজার ৫১০ টাকা এবং নিট সম্পদ ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ৫৪ হাজার ৭৪৬ টাকা দেখান।
পি কে হালদার ২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত রিলায়েন্স ফিন্যান্সে পরিচালক পদে চাকরিরত অবস্থায় ওই প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন-ভাতাসহ মোট ৫ কোটি ৬২ লাখ ৮০ হাজার টাকা নেন। ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত এনআরবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে চাকরি করেন পি কে হালদার। ওই প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন-ভাতাসহ তিনি মোট ৩ কোটি ২৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা পান। সে অনুযায়ী তিনি ২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত চাকরি থেকে বেতন-ভাতাসহ মোট ৮ কোটি ৯ লাখ ২০ হাজার টাকা উপার্জন করেন। অথচ, ২০১৩-২০১৪ করবর্ষ থেকে ২০২০-২০২১ করবর্ষ পর্যন্ত তিনি আয়কর রিটার্নে মোট ১২ কোটি ৯ লাখ ৬৪ হাজার ৩২৬ টাকা আয় প্রদর্শন করেন। এছাড়া, তার ২০২০-২০২১ করবর্ষ পর্যন্ত পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয় ৪ কোটি ৮ লাখ ১৬ হাজার ৫১০ টাকাসহ মোট ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ৫৪ হাজার ৭৪৬ টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া যায়। তিনি নামে-বেনামে এবং স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তি/কোম্পানির নামে-বেনামে ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ৩৯১ কোটি ৭৫ লাখ ৮১ হাজার ১২ টাকার স্থাবর ও ৪২ কোটি ২১ লাখ ৯৫ লাখ ৯৪৪ দশমিক ২৭ টাকার অস্থাবর সম্পদসহ মোট ৪৩৩ কোটি ৯৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯৫৬ দশমিক ২৭ টাকার সম্পদ অর্জন করে নিজ নামে ও আপনার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দখলে রাখেন। ব্যয়সহ তার মোট ৪৩৮ কোটি ৫ লাখ ৯৩ হাজার ৪৬৬ দশমিক ২৭ টাকা সম্পদের মধ্যে বৈধ আয় ১২ কোটি ৯ লাখ ৬৪ হাজার ৩২৬ টাকা। পি কে হালদার নামে-বেনামে এবং স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তি/কোম্পানির নামে-বেনামে জ্ঞাত আয়ের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ ৪২৫ কোটি ৯৬ লাখ ২৯ হাজার ১৪০ দশমিক ২৭ টাকার সম্পদ অবৈধভাবে উপার্জন করেন।
অপর আসামিরা পি কে হালদারকে অবৈধ পন্থায় মোট ৪২৫ কোটি ৯৬ লাখ ২৯ হাজার ১৪০ দশমিক ২৭ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনে সহযোগিতা করেছেন। এছাড়া, প্রশান্ত কুমার হালদার নামে-বেনামে এবং তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কোম্পানি/কাগুজে কোম্পানি/ব্যক্তির নামে-বেনামে ব্যাংক এশিয়ার ১৮টি শাখায় মোট ১৬০টি, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের দুটি শাখায় ১৪টি, সিটি ব্যাংকের তিনটি শাখায় তিনটি এবং আইএফআইসি ব্যাংকের একটি শাখায় একটিসহ চারটি ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় মোট ১৭৮টি ব্যাংক হিসাব পরিচালনা করেন। ১৭৮টি অ্যাকাউন্টে ২০২১ সালের ৩০ মে পর্যন্ত ১২ বছরে মোট ৬ হাজার ৮০ কোটি ৮৬ লাখ ৪০ হাজার ১২৫ দশমিক ২ টাকা জমা করেন এবং ৬ হাজার ৭৬ কোটি ৫১ লাখ ৮৬ হাজার ৪৫৯ দশমিক ৫৭ টাকা উত্তোলন করেন।
চারটি ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় ১৭৮টি অ্যাকাউন্টের বেশিরভাগই পি কে হালদারের বেনামি বিভিন্ন কাগুজে কোম্পানি ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট একান্ত ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের নামে পরিচালনা করা হয়। ওই হিসাবগুলোর মধ্যে আন্তঃলেনদেন হয়েছে প্রায় ৬ হাজার ৮০ কোটি টাকা। তার অবৈধভাবে অর্জিত অর্থের প্রকৃত অবস্থান গোপন করার হীন উদ্দেশ্যে নামে-বেনামে, নিজ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কাগুজে কোম্পানি এবং একান্ত ঘনিষ্ঠ সহযোগী অপর আসামিদের নামে-বেনামে অসংখ্য ব্যাংক হিসাব খুলে সেগুলোতে অসংখ্য আন্তঃলেনদেনের মাধ্যমে অবৈধ অর্জিত অর্থ হস্তান্তর, স্থানান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে মানিলন্ডারিং করেন।
উল্লেখ্য, গত বছরের ১৪ মে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা থেকে পি কে হালদারকে গ্রেপ্তার করে ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। বর্তমানে ভারতের কারাগারে আছেন পি কে হালদার।