– আকতার হোসেন
ঐ ব্যাটা ডাইনে যা… এইবার এই গল্লিতে ঢোক।
তিন বছর হয়ে গেল জেমস রিকশা চালাচ্ছে। ওর বাবাও রিকশা চালাত। একদিন রাস্তার এপারে রিকশা রেখে পানি খেতে গিয়েছিল চায়ের দোকানে। ফিরে আসতে গিয়ে ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে ঘটনা স্থানেই তার মৃত্যু হয়।
জেমসের বাবা মরে গেলেও রিকশাটা অক্ষত থেকে যায়। লোকে বলে আল্লাহ মাইর দুনিয়ার বাইর। তিনদিন শোক কাটিয়ে বাবার রিকশা নিয়ে জেমস পথে নেমে পড়ে। সেই থেকে তার স্কুল যাওয়া বন্ধ।
করোনার ছুটির কারণে রাস্তাঘাট ফাঁকা। ঘোড়ার পিঠে নায়ক রাজ রাজ্জাক যেমন করে ছুটে চলতো আজ জেমস ঠিক তেমনি করে রিকশা টানছে। একসময় ওর মা খুব সিনেমা দেখত। প্রথম সন্তান জন্ম নেবার পর নাম রাখল জেমস। ওর বাবা বলেছিল, রেজ্জাক রাখ, না হইলে ইলিয়াস কাঞ্চন!
জেমসের মা বলল,নাহ। আমার পোলারে ফ্লিম্মের হিরো বানামু না। ও জেমসের মত গান গাইবো।
ঐ ব্যাটা বায়ে যা… এই গল্লিতে ঢোক।
জেমস খেঁকিয়ে ওঠে, আর কত গল্লিতে ঢুকাইবেন। এই গল্লিতে ঢুকলে রিস্কা তো মাইনকার চিপায় হান্দায় যাইব।
হ্যালা দিমু নিহি একটা চটকানা। মুখে মুখে তর্ক করছ। এই গল্লি থ্যাইক্কা এক সময় লাইনে লাইনে মেথর গো গাড্ডা গাড়ি বাইর অইতো। সময় মত জন্মাইলে দেখতে পারতি গরুর গাড়ি কারে কয় বেটা। রাখ, এইখানে রাখ। দশ মিনিট খাড়া। যামু আর আমু।
লাফ দিয়ে সুলতান রিকশা থেকে নেমে পড়ল। বুড়ি মা’র ঘর খুঁজে পেতে অসুবিধা হলো না। প্রচুর মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে আসে। অনেকের হাতে সেলফোন। দু একজন ঝটপট সুলতানের ছবি তুলে ফেললো।
টুপি পড়া এক বয়স্ক লোক এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, তুমি ক্যাঠা? বুড়ি তোমার কী লাগে?
একজন যুবক ইতিমধ্যে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। সে বলল আপনি কি সুলতান মিয়া?
সুলতান মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিতে দিতে পকেট থেকে মাস্ক বের করে মুখ ঢাকল। হাল্কা নীল রঙের দুটো হ্যান্ড গ্লোবস পড়ে নিলো দুই হাতে। মাত্র দুজন লোক সুলতানের সাথে কথা বলতে এগিয়ে এসেছে। বাকীরা দূরে দাঁড়িয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করছে।
ঐ মিয়া এই জিন্দা লাশটারে জলদি এইখান থাইক্যা লইয়া যান। আমরা পোলাপান লইয়া থাকি। যেকোনো সময় আমাগো করোনা লাইগ্যা যাইতে পারে।
সুলতানের কাছে দাঁড়ানো যুবকটি বলল, চাইরদিন অইলো বুড়ির জ্বর। কেউ ওর সামনে যাইবার চায় না। আমি সাহস কইরা ভি্তরে গেলাম। যায়া দেহি অবস্থা খারাপ। চক্ষু মুক্ষু ফুইল্যা গেছে। দম উঠছে। হাতে একটা কাগজ মুরাইয়া তোষকের উপরে হুইয়া আছে। আমার হাতে কাগজটা দিয়া কইলো আপনারে এই নম্বরে ফোন দিতে। আপনা গো বাড়িতে নাকি পনেরো বছর ছুট্টা কাম করছে।
সুলতানের কানে বেজে উঠল ‘ওপেন টু বাইস্কোপ, নাইন টেন টেলিস্কোপ, সুলতানা বিবিয়ানা’.. সুলতানের ব্যাগ হাতে নিয়ে বুড়ি মা রোজ স্কুলে দিয়ে আসতো। স্কুল ছুটির একঘণ্টা আগে গিয়ে আবার বসে থাকতো। সুলতান মাথা নিচু করে গেট থেকে বের হতেই ছোঁ মেরে ওর হাত থেকে ব্যাগটা কেড়ে নিত। সকালে যেভাবে সুলতানের সাথে পাল্লা দিয়ে হেঁটে আসতো। বিকেলে অতটা পারতো না। ওদের বাড়িতে ছোট বড় সব মিলিয়ে সাতজন লোক। পেয়ারী নামে চৌদ্দ পনেরো বছরের অন্য একটা মেয়ে কাজ করলেও বেশির ভাগ কাজ পড়তো বুড়ি মায়ের ওপর। পেয়ারী বান্ধা কাজের লোক তাই বুড়ির ওপর সেও গলা চড়াত। একদিন পেয়ারির সাথে কথা কাটাকাটি হবার পর সুলতানের বাবাকে একটা সিদ্ধান্তে আসতে হয়েছিল। হয় পেয়ারী থাকবে না হয় বুড়ি মা। সেই থেকে বুড়ি মা আর কারোর বাড়িতে কাজ করে নি।
বুড়ি মা একসময় সুলতানকে মুখে তুলে ভাত খাওয়াত। খাও খাও নইলে ঐ কাউয়া সব খায়া ফালাইব। খাও খাও পেট খালি থাকলে কিন্তু খালি পেটে পিপড়া ঢুইকা যাইব।
অনেক আদর করত তাকে। বলতে গেলে বুড়ি মায়ের হাতে বড় হয়েছে সুলতান। গেল একবছরে বুড়ি মা’র কথা ভুলে গেলেও ফোন পাবার পর আজ না এসে পারলো না। সুলতানের বুকের মধ্যে একটা সুনামি চলছে। ওর পা আটকে যাচ্ছে তবুও ধীরে ধীরে বুড়ি মা’র ঘরে প্রবেশ করল সে।
ক্যাঠা, আমার সুলতান বাবা আইছ। বাবা আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করতাছি। জানতাম তুমি আইবা।
আট ফুট দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকে সুলতান। অবাক দৃষ্টি দিয়ে বুড়ি মা’কে দেখে। একটা বস্তার ভেতর সমস্ত শরীর ঢুকিয়ে কোন রকম মাথা বের করে রেখেছে। যেন এক বস্তা মানুষ সে।
সুলতানের ভয় হতে থাকে। ঘরের চারিদিকে চেয়ে দেখে হাজারো অদৃশ্য করোনা ভাইরাস বাদুরের মত ঝুলে আছে। নিজের হাত দুটো শরীরের সাথে এমন শক্ত করে বেঁধে রাখে যেন উড়ন্ত ভাইরাস এসে স্পর্শ করতে না পারে।
ফুড়ুৎ করে একটা চড়ুই পাখি উড়ে যায়। সুলতান তাতেও নড়েচড়ে ওঠে। এদিকে বস্তার ভেতর থেকে একটা পাম্প আসে আর সেটা ফুলে ওঠে। এইভাবে ওঠা নামা করতে থাকে বস্তাবন্দী এক জীবন।
বাবা সুলতান। আমারে বাচাইতে হইব না। আজ কাইলকার মধ্যে যামুগা। আমারে কেউ কবর দিব না হুনতাছি। কেউ ছুইবো না ভি কয়।
অনেক কষ্ট করে কথাগুলো বলল বুড়ি মা। যদিও মনে মনে সখ হচ্ছিল একবার সুলতানের হাতটা ধরতে। নিজের বাতের ব্যথা নিয়ে সুলতানের কচি হাত কত টিপে দিত একসময়। সুলতান মাঝে মাঝে বলতো ঈশ এতো জোড়ে টিপ ক্যান। ব্যথা লাগে তো।
আজ সেই জোড় শক্তি কিছুই অবশিষ্ট নেই। সুলতানকে সে কোন ব্যথা দিতে পারবে না। সুলতানকে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যত ব্যথা পাবার নিজের মধ্যে সেটা চেপে রাখল।
এই মেথর পট্টিতে কত নোংরা আবর্জনা নিয়ে ছোট বেলা থেকে বাস করছে সে। কখনো তেমন বড় অসুখ হয় নি। যে গলিতে বুড়ি মা থাকে সেখানে রিকশাওয়ালাও ঢুকতে চায় না। অথচ কি করে যেন ঢুকে গেল বিদেশী করোনা ভাইরাস। এত লোক থাকতে এত ঘরবাড়ি থাকতে করোনাকে কেন তারই ঘরে আসতে হলো?
বস্তার ভেতর শুয়ে শুয়ে সে অনেক কিছুই ভাবছে। ঘরের আনাচে কানাচে খুঁজলে এখনো হয়তো তার ছোট বেলার কিছু খেলনা পাওয়া যাবে। বিয়ের শাড়িটাও ট্রাঙ্কে ভাঁজ করা। কোন কিছুই ধরতে ইচ্ছে করছে না। কোন আফসোস নেই, কবর নাও হতে পারে সেটা জেনেও ঘাবড়াচ্ছে না। শুধু আজীবন ডানপিটে চঞ্চল সুলতানের এই স্থির মূর্তি তার কাছে ভালো লাগছে না। কেন যে শুধোশুধি ফোন করিয়ে আনল। কি হতো সুলতানের মুখটা না দেখলে!
উত্তপ্ত হতে লাগলো বুড়ি মা’র চট জড়ানো শরীর। হ্যাঁ ‘বুড়ি মা’ এটাই তার নাম। কবে ভুলে গেছে তার নিজস্ব একটা নাম ছিল। সবাই তাকে মনি বলে ডাকতো। ওর বাবা বলত ‘আমার মনিমালা কুথায় গো’। বিয়ের পর স্বামী ডাকতো ‘মনি রানী’।
সব কিছুর কাছে ফিকে হয়ে গিয়েছিল সুলতানের মধুর ডাক ‘বুড়ি মা’। পাড়ার লোকেরা কেন যে তাকে ‘করোনা বুড়ি’ নাম দিল সেটা সে বুঝে উঠতে পারে না। শরীর নিয়ে বাইরে যেতে পারে না ঠিকই। মনটাও আটকে আছে ছোট্ট ঘরে। কিন্তু বাইরের সবকথা সে শুনতে পায়। যে হেটে যায় সেই বলে, করোনা বুড়ি আছে না গেছে গা?
সুলতান আরেকবার ঘরের চারিদিকে চোখ ঘুরায়। মাস্ক ভেদ করে একটা উটকো গন্ধ প্রবেশ করে ওর নাকে। জং ধরা টিনের চালে অজস্র ছিদ্র। লেপ তোষক খাতা বালিশ চারিদিকে ছড়ানো ছেটান। এক কোনায় পানির জগ কাত হয়ে পড়ে আছে। পাশে শুকনো একটা গ্লাস। ঘরের মধ্যেই রান্না করে খেত বুড়ি মা। চুলোটাও শুকনো। বাসন প্লেট গায়ের জামা কাপড় কতদিন হাত দেয় নি সে শুধু বুড়ি মা’ই জানে।
সুলতান দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। দল বাঁধা লোক চিৎকার করে ওঠে, হালায় লৌড় পাড়ল কে। বুড়ি কি অফ নি!
সুলতান এক লাফে রিকশায় উঠে বলে, জলদি চল। জেমস কিছু বুঝে ওঠার আগেই আর একবার চিৎকার করে, ঐ ব্যাটা টানছ না ক্যান।
কই যামু
মিটফোর্ড চল
মিটফোর্ডের কথা কইয়া তো উঠলেন। লইয়া আইনে এই চিপায়। আবার কন মিটফোর্ড যাইবেন। আমার কি? ফাকা শহরের যেইখানে যাইবার কইবেন হেইখানে যামু।
কিছুক্ষণ পর রিকশার গায়ে টান লাগে। পালতোলা রিকসা মিটফোর্ডের দিকে এগিয়ে যায়। কোন সারা শব্দ নেই। শুধু চাকা ঘষার আওয়াজ।
ওই ছ্যাড়া তোর নাম কী
জেমস
থাকোস কই
সুযোগ পেয়ে জেমস গীতবিতান খুলে বসে। জীবন বৃত্তান্ত লাইন লেগে যায়। মঞ্চ এবার তার হাতে।
অনেকক্ষণ পর সুলতান জিজ্ঞেস করে, তোর মা কি খুব বাহাদূর?
কি কন ভাইজান, একবার জেমসের গান হুনতে গেছিলাম। এক্কেবারে স্টেজের কাছে গেছি পর সিকুরিটি আটকাইয়া দেয়। মায়ে কয় আমি জেমসের বাড়ির কামের বুয়া, জেমস ভাই আমারে গান হুনতে আইতে কইছে।
হুদাই মিছা কথা। জেমস ভাই কই থাকে না থাকে মা হেইডাও জানে না। হুদাই কয় হের বাসায় কাম করে। পরে সিকুরিটি জেমস ভাইয়ের কাছে আমাগো লইয়া গেল। হে চালাক মানুষ, সব কিছু বুঝতে পারে। আমার মাথায় হাত বুলাইয়া দেয়। মা জেমস ভাইয়ের কইলো, আমার এই পোলার নাম আপনার নামে রাখছি। ওরে লইয়া একটা গান বাইন্দেন। আমার দিল খোশ হইয়া যাইব।
সুলতান হো হো করে হেসে দেয়। তোর মায়ে গান হুনার লাইগা মিছা কথা কইছে। এইটা কি কইলি?
মিছা কথা বড় না ভাই। আমার মায়ে পারে না এমন কোন কা্ম নাই। ভয় ডর কিচ্ছু নাই।
রাখ রাখ এইখানে রাখ। আমি দোকানের ভিতরে যাইতাছি। এইটা আমার দোকান। তুই তোর মারে ফোন লাগা। কইবি আমার লগে তারে এক জায়গায় যাইতে হইবো
কই যাইতে হইবো ভাই?
কইবি ম্যাথর পট্টি।
সুলতান সোঁ করে দোকানের ভেতর ঢুকে পড়ে। ওর কর্মচারীরা ওকে সালাম দেয়। সে উত্তর দিতেও সময় পায় না। এদিকে ওদিকে হাতিয়ে ওরাল স্যালাইন, জ্বর, ব্যথার ওষুধ টেনে টেনে ব্যাগে ভরে।
কিছু খুঁজতাছেন ভাইজান? সুলতানের কম্পাউন্ডার এসে ভয় ভয়ে জিজ্ঞেস করে।
সুলতান বলে, একটা ভিটামিন আছিল না এইখানে। যাকগা, চার পাঁচদিন না খাইয়্যা আছে এমন মানুষের শরীরে শক্তি ফিরায় আনতে কী ভিটামিন দিতে হইবো জানেন?
কম্পাউন্ডার জিজ্ঞেস করে রুগীর বয়স কত?
আরে রুগী না রুগী না। গরীব মানুষ চার পাঁচদিন কোন দানা পানি জুটে নাই। জলদি একটা ভিটামিন বাইর করেন।
সুলতানের সমস্ত দিন চলে যায় অনির্ধারিত এক ব্যস্ততায়। জেমসের মাকে বুড়ি মায়ের কাছে রেখে এসেছে কয়েকদিনের জন্য। ঢাকা শহর এখন দিনের বেলায়ও ভুতুরে গলির মত লাগে। রাতে অন্ধকারে শ্মশানের জলছাপ। ভাগ্য ভালো আকাশ জ্বলজ্বল করছে রাতের তারায়। হাল্কা হাওয়া এসে দিনের ক্লান্তি মুছে দিচ্ছে শরীর থেকে।
সারাদিন পঙ্খিরাজের মত রিকশা টেনেছে জেমস। তবুও সুলতান তার সাথে মায়া মমতা মাখিয়ে কথা বলতে পারে না। এই যেমন অকারণে চেঁচিয়ে উঠে বলল,
ঐ ব্যাটা মিন মিন কইরা কি গাস? জোরে গাইতে পারস না?