-জসিম মল্লিক
১
আমরা এখন একটা ক্রান্তি কাল অতিক্রম করছি । সারা পৃথিবীজুড়ে শঙ্কা এবং ভয়। যখন এই লেখা লিখছি তখন পৃথিবী ভয়ে কাঁপছে । একটা ট্রমার মধ্যে আছি আমি নিজেও। কি হবে জানা নেই। পুরো পৃথিবী স্তব্দ হয়ে গেছে । থেমে গেছে স্বাভাবিক জীবন। আমি এবং জেসমিন কানাডা থেকে ঢাকা এসেছি গত ৩ ফেব্রুয়ারী। উদ্দেশ্য বইমেলায় অংশ নেয়া এবং ব্যাংকের কিছু কাজ করা। আমাদের চলে যাওয়ার ডেট নিধারিত ছিল ১০ মার্চ। আমার মেয়ে অরিত্রি হঠাৎ করে ২৯ ফে ব্রুয়ারী ঢাকা আসে এবং আমাদের সাথে চলে যাওয়া ঠিক করে আসে । ১০ মার্চ টিকিট থাকলেও আমার মনে হয়ে ছিল আমি যে কাজে এসেছি সেটা সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না।
প্রথম থেকেই আমার মনের মধ্যে ছিল যে টিকিট কয়েকদিন বাড়াবো। টরেন্টো বসেই এটা আমি ভেবেছিলোম। কিন্তু ঢাকা আসার পর জেসমিন বারবার এটার বিরোধিতা করছিল। কিছুতেই বুঝতে চাইছিল না যে এতো অল্প সময়ে কোনো কাজ বাংলাদেশে করা যায় না। আমার ব্যংকে একটা ফিক্সড ডিপোসিট আছে । সেটা ৫ মার্চ ম্যাচিউরড হবে । সে দিন বৃহষ্পতিবার। তারপর শুক্র ও শনি বার ব্যাংক বন্ধ থাকবে । হাতে থাকবে রবি ও সোমবার দু’দি ন। এই দু’দিনে এতোকিছু করা সম্ভব হবে না। সেই কারণেই টিকিট চেঞ্জ করার চেষ্টা করি ।
ঢাকা ১৫ মার্চ ২০২০
২
অনেক দ্বিধ্বাদ্বন্দ্বে ভুগে অবশেষে ঢাকার কুয়েত এয়ার লাইন্স অফিসে যাই কয়েকবার। তারা আমার চাহিদা মতো টিকিট দিতে পারছিলনা। পরে টরন্টোতে আমার ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে টিকিট চেঞ্জ করতে সক্ষম হই। আমার ২৩মার্চ রাতের ফ্লাইটে যাওয়ার ডেট ঠিক হয়। তারপর পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে থাকে। সারা পৃথিবীতে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। আমি টরন্টোতে থাকতেই জানুয়ারী মাসেই চীন থেকে আসা একজন রোগি সনাক্ত হয়। টরন্টোর সানিব্রুক হসপিটালেসে ভর্তি হয়। প্রথম এই ভাইরাস ধরা পড়ে গত বছর ডিসেম্বরে চীনের উহান প্রদেশে। কেউই ভাবতে পারেনি এই ভাইরাস পুরো পৃথিবীকে স্তব্দ করে দেবে। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ৯মার্চ হঠাৎ ঘোষনা আসে কুয়েত এয়ারলাইন্স ক্যান্সেল। শুরু হয় দৌড় ঝাপ আর টেনশন। অরিত্রিকে ১১তারিখেই অফিসে জয়েন করতে হবে।
ঢাকা ১৬মার্চ ২০২০
৩
এমিরেটস এয়ারলাইনসে জেসমিন এবং অরিত্রিকে ডাইভার্ট করে দেয়। সন্ধ্যায় সেটাও ক্যান্সেল হয়ে যায়। বলা হয় ওভার বুকড। কি একটা টেনশন। তারপর কাতার এয়ারে কোড শেয়ারিং করে ওদেরকে দেয়া হয়। অতপর ১০ মার্চ ওরা ভাল ভাবেই পৌঁছে যায় টরন্টো। পরবর্তীতে কুয়েতের ক্যান্সেলেশন বাড়তে থাকে। ২৬ মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। আমাকেও কাতারে দেয়া হয় ২৩ মার্চ রাতের ফ্লাইটে। আমার ২৫ মার্চের আগেই যাওয়ার দরকার কারন ওই দিন আমার একটা ডাক্তার এপয়নমেন্ট আছে। আমি এমআরআই করেছিলাম ব্যাকপেইনের জন্য। আমাকে নিউরো সার্জনের কাছে রেফার করা হয়।
ঢাকা ১৭ মার্চ ২০২০
৪
আল্লাহর রহমতে দেশে আসার পর থেকে ব্যাক পেইন আমাকে তেমন ভোগাচ্ছে না। আমি অনেক কষ্ট পাচ্ছিলাম কানাডায় থাকতে। যাইহোক। পরিস্থিতি অবনতি ঘটতে থাকে দ্রুততার সাথে। ২৩ তারিখের আগে যাওয়ার চেষ্টা করলেও সম্ভব হচ্ছিল না। টিকিট পাওয়া যাচ্ছিল না কোনো ভাবেই। রিটন ভাই আকস্মিক টিকিট চেঞ্জ করে ১৭ মার্চেই ফিরে গেলেন। আমি ক্যন্টনম্যান্ট এলাকায় মানিক রহমানের বাসায় অবস্থান করছিলাম। মানিক নিজেও আমেরিকা থাকে। ব্যবসার কাজে দেশে এই সময়। ওর ভাই চট্টগ্রাম ক্যান্টমেন্টের জিওসি মেজর জেনারেল মতিউর রহমান। মানিক চমৎকার একজন মানুষ। আমার সাথে অনেক দিনের সখ্যতা। মাঝে মাঝে মহাখালী যাই শুশুর বাড়ি। আমি খুবই টেনশনে পড়ে যাই। সারা পৃথিবীতে আক্রান্ত প্রায় তিনলক্ষ। মৃতের সংখ্যা ১২হাজার ছাড়িয়েছে এপর্যন্ত। প্রতিদিন এই সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে ভয় শঙ্কা টেনশন।
ঢাকা ১৮মার্চ ২০২০
৫
২১মার্চ সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুনি ৩১ মার্চ পর্যন্ত সব ফ্লাইট ক্যান্সেল। আমার ছেলে মেয়েরা আমাকে নিয়ে টেনশন করছে। কয়েক দিন ধরে গৃহ বন্দী হয়ে আছি। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া বের হইনা। কি করব বুঝতে পারছিনা। আটকে গেছি। মন খারাপ হয়েগেছে। পরিবার এক জায়গায় আমি এক জায়গায়। কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিনা। বাংলাদেশে ক্রমাগত বাড়ছে আক্রান্তর সংখ্যা। মানুষ তেমন সচেতন না। কানাডার পরিস্থিতিও খারাপের দিকে যাচ্ছে প্রতিদিন। কোথাও নিরাপদ না। সবকিছু লকডাউন হয়ে যাচ্ছে। রাস্তা ঘাটে কোনো মানুষ নাই। এমনকি বরিশালেও একই অবস্থা। কি একটা অবস্থা পৃথিবী জুড়ে। এরকম কেউ কখনো দেখেনি।কি হবে অজানা। একমাত্র আল্লাহ সংকট থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারেন।
২১ তারিখ রাতের দিকে আমি রাকিবকে ফোন করে জানতে চাইলাম কানাডা যাওয়ার কোনো উপায় আছে কিনা। রাকিব ঢাকার ট্রাভেল এজেন্ট। আমি ঢাকায় এলে ওর কাছ থেকে টিকিট নেই। চমৎকার ছেলে। সে তখনই চেষ্টা শুরু করে দিল। বিমান বাংলাদেশ এবং ক্যাথেপ্যাসিফিক তখনও চালু আছে। ২৩ তারিখ দিবা গত রাত ১টায় ক্যাথেপ্যাসেফিকের ফ্লাইট আছে বলে জানাল। টিকিটের দাম তখন ও ৬৬০০০ টাকা ওয়ান ওয়ে। বিমানে ও লন্ডন হয়ে চেষ্টা করেছিল কিন্তু লন্ডন থেকে টরন্টোর ফ্লাইট পাওয়া যাচ্ছিল না। দাম ও বেশি। আমি আশার আলো দেখলাম। আমি বুকিং দিতে বললাম ক্যাথেতে।
ঢাকা ২১ মার্চ ২০২০
৬
পরের দিন সকালে মানিককে সহ প্রথমে গেলাম গুলশানে কাতার এয়ার লাইন্সের অফিসে। গিয়ে দেখি শুনশান অবস্থা। লোকজন তেমন নেই। সর্বত্র আতঙ্ক বিরাজ করছে। কাউন্টারে যারা ছিল তারা শুধু জানাচ্ছিল এই মুহূর্তে তাদের কিছুই করার নেই। ওরা তেমন কোনো হেল্প করতে পারল না। সব কিছু স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলল। কুয়েতে ফোন দিলে ওরা বলল, তারা ক্যাথেপ্যাসিফিকে টিকিট কনভার্ট করতে পারবে না। আমি যদি পারি যেনো চলে যাই। রিফান্ডের ব্যবস্থা ট্রাভেল এজেন্ট করবে।
এরপর মানিকের সাথে গেলাম গুলশান দুই এক্যাথের অফিসে। এখানে বিশাল ভীড়। বেশির ভাগ কানাডার যাত্রী। এখানে কোনো টিকিট নাই। এদিকে আমার আর মানিকের বুকিং ক্যান্সেল হয়ে যাচ্ছে বারবার। রাকিব সারারাত বুকিং ধরে রেখেছে। রাকিব আমাদের দুজনেরই টিকিট কনফার্ম করে ফেলে। ওই দিন ২২ তারিখ দুপুরে আমরা টিকিট নেই। সন্ধ্যায় সেই টিকিটের দাম হয় প্রায় দেড়লাখ টাকা। (চলবে)
ঢাকা ২২ মার্চ ২০২০