-আকতার হোসেন
জন্ম অব্ধি মানুষ ভালবেসেছে মাটিকে। টিউলিপ, গোলাপ, সূর্যমুখী যেভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, মানব শিশুও একদিন সকলকে দুটি পায়ের ওপর ভর করে অবিকল দাঁড়িয়ে যায় মাটিতে। অতঃপর সে দৌড়াতে শেখে এবং ধীরেধীরে ভাগতে কিংবা পালাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। মায়ের কোলে নির্ঝঞ্ঝাট বড় হওয়া জীবন ছুটে চলে ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে অথচ, মানুষ জানে না কতটা ছুটতে হবে তাকে, কতটা পথ বাকী রয়ে যাবে শেষ বিদায়ের আগে। অতএব যখন মাটি তাকে ফিরে পেতে চায়, নির্মোহ ইশারা দিয়ে বলে ফিরে এসো, তখন বিদায় যাত্রী সবকিছু বিসর্জন দিয়ে স্বাভাবিক মৃত্যুর কামনা করে।
স্বাভাবিক মৃত্যুর কামনা মানে। ধবধবে সাদা কাপড়ে মোড়ান শরীরটাকে জীবিত মানুষ দেখবে অশ্রু সজল নয়নে। শেষ প্রার্থনার কাছে সঁপে দেবে আপনজনকে। যিনি আর জাগবেন না, বলবেন না কাছে এসে বসতে। উষ্ণতা নিতে বাড়িয়ে দেবেন না একটি দীর্ঘ হাত। সেই লোকটাকে দেখা মাত্র বুকের ভেতর ডুকরে কেঁদে উঠবে অতীত দিনের হাসি -স্মৃতি – ভালোবাসার রোজনামচা।
আমি বহু সভা সমাবেশ অনুষ্ঠানে গিয়েছি। কিন্তু কারোর মৃত্যুর পর সমবেত লোকজনের মুখে যে পবিত্রতা দেখেছি তা চাঁদের মুখেও দেখিনি। শোকার্ত মুখ জ্যোৎস্নার চেয়ে সুন্দর। আমার সমস্ত জীবনের বিশ্বাস মৃত্যু মানুষকে কাছে টেনে আনে। দূরে থাকার সাথে মরণের আজীবন বৈরিতা। আমার কাছে তাই স্বাভাবিক মৃত্যুর কামনা মানে; কারোর মৃত্যুর খবর শোনা মাত্র বেজে উঠবে মুঠোফোন। বেড়ে যাবে পিচ ঢালা পথে কিছু অতিরিক্ত গাড়ি। ফাঁকা পড়ে থাকবে অফিস আদালতের চেয়ার টেবিল।
স্বাভাবিক মৃত্যুর কামনা মানে। কারোর মৃত্যুর খবর পেয়ে এক কাপড়ে লঞ্চ ট্রেনে লাফিয়ে ওঠা খেলার সাথীর মুখে বিষণ্ণতা। দাদা দাদীর একপাটি জুতা স্যান্ডেল ভুলে যাওয়া। চরাচরের গতির সাথে পাল্লা দিয়ে বরফ ঢাকা দেহের কাছে এসে আছড়ে পড়া।
স্বাভাবিক মৃত্যুর কামনা মানে; অনেক লোকের সমাগম অথচ মৃত মানুষের নিশ্বাস ফিরে আসে কিনা তার জন্য সমবেত নীরবতা। মৃত মানুষের মুখে দেখতে চাওয়া শেষ হাসি অথবা কঠিন যন্ত্রণার কোন ছাপ আছে কিনা তা খুঁজে দেখা।
আমার কাছে স্বাভাবিক মৃত্যুর কামনা মানে; যখন মাটির খোঁড়া একটা সুরঙ্গের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে নিথর দেহ, ভিড়করা মানুষ নিঃশব্দে বলে উঠবে, আল-বিদা, আল-বিদা। অতঃপর দূরে কিংবা কাছে দাঁড়িয়ে তারা দেখবে মাটির ছোট্ট টিবির নিচে কি করে একটি প্রদীপ চাপা পড়ে যায়। যেন টিউলিপ কিংবা গোলাপ ফুল হয়ে ফুটে ওঠার সম্ভাবনা নিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছেন একজন স্বজন। রৌদ্রোজ্জ্বল কোন এক সকালে অনায়াসে যিনি বেরিয়ে আসতে পারেন আমাদের পৃথিবীতে, ফুল কিংবা শস্য দানা হয়ে।
আজ যখন সারি সারি কফিন দেখি ইতালি কিংবা চীনের উহান শহরে। নিউইয়র্ক কিংবা টরন্টো। তখন ভাবি এই বিবর্ণ শবযাত্রা কি বাঙালি মেনে নেবে? আমাদের বুকের মধ্যে পদ্মা নদী বহমান। হোক সে দিনমজুর, গার্মেন্টস শ্রমিক কিংবা একজন সফল ব্যবসায়ী। আমাদের কেউ মারা গেলে বুক ভেসে যায় সমুদ্রে। ছোটবেলার নদী খাল বিল, মাঠ গাছ এবং একটি গৃহস্থালি কেঁদে ওঠে সকাতরে। আমরা নীরবে কাঁদতে শিখিনি। আমাদের কান্না আসমানে না পৌঁছালে অন্তিম বিদায় সম্পূর্ণ হয় না। আমিতো সেভাবেই জানিয়েছি এ যাবত সব বিদায়ের বাণী। আজ কেন জল আটকে গেছে চোখে, আজ কেন হাত ছানি দেয় না কাফন ছুঁতে চাওয়া স্বপ্ন। হোক শবযাত্রা লাশের মিছিল দেশে দেশে তবুও বলব, এটা কোন স্বাভাবিক মৃত্যু বিদায় হতে পারে না। আজ যদি অকস্মাৎ এসে যায় আমার বিদায়ের পালা, যদি হঠাৎ আসা উড়ো মৃত্যুর কারণে কাছে আসতে চাওয়া মানুষগুলো বঞ্চিত হয় তবে জেনো, মৃত্যু স্বাদ আমার অপূর্ণ থেকে যাবে। তাহলে, আমাকে আরও একবার মরার সুযোগ দিতে হবে।