হাই স্কুলে পড়ি। ক্যাসেট প্লেয়ারের যুগ। এক বৈশাখে বাজারে শুনলাম নতুন একটা গান ‘মেলায় যাইরে’। গান শুনে মন পাগলপারা। বিকেলেই যশোর শহর থেকে সেই এ্যালবাম কিনে এনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই গান বার বার শুনি। বাড়ির সবাই ত্যক্ত-বিরক্ত। তখনই মাথায় জেঁকে বসলো রমনার বটমূল আর বৈশাখী মেলা। পহেলা বৈশাখ সামনে রেখে কত বার ঢাকা আসার উদযোগ-আয়োজন করেছি। প্রতিবারই আমার বেরসিক বাবা নিরাপত্তা ও অন্যান্য অজুহাতে আমার সেসব পরিকল্পনা ভন্ডুল করে দিয়েছেন।
যশোর শহরে সীমিত পরিসরে আয়োজিত বৈশাখী মেলাতেই খুশি থাকতে হয়েছে। বন্ধুদের বেশ ক’জন এরই মধ্যে রমনার বৈশাখী মেলা ঘুরে এসেছে। তাদের মুখে কত শত গল্প – মঙ্গল শোভাযাত্রা, লাখ লাখ মানুষ, কনসার্ট ইত্যাদি। তবে সবচেয়ে বেশী শুনেছি লাল পাড় সাদা শাড়ি, চুড়ি আর টিপ পরা অপ্সরাদের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে ঢাকা এলাম। ক’দিন পরেই পহেলা বৈশাখ। হাত খরচের টাকা বাঁচিয়ে নতুন পাঞ্জাবি ও উত্তরীয় কিনেছি।
এখন শুধু দিন গোনা, কাউন্টডাউন। দু’দিন মাত্র বাকি আছে। বিকেলে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছি। এর মধ্যে সুমনের (সমাজসেবী, সোশ্যাল মিডিয়া সেলিব্রেটি ব্যারিস্টার সুমন) সাথে হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে হলের বারান্দায় পড়ে গিয়ে বাম পাটা মচকে গেল। বন্ধুদের কাঁধে চড়ে ঢাকা মেডিকেল থেকে প্লাস্টার বাঁধা পা আর পাংশু বর্ণ মুখ নিয়ে হলে ফিরলাম। পহেলা বৈশাখ এলো, সকাল বেলা ছেলেদের মধ্যে সাজ-সাজ রব। সাতটা না বাজতেই শাড়ি-চুড়ি পরে একটি দু’টি করে মেয়ে হলে আসছে ছেলেবন্ধুকে নিয়ে যেতে। নিচ থেকে হলের মামারা একেক জনের নাম ধরে হাঁক দেন, আর মুহূর্তের মধ্যেই গর্বিত ছেলেটি মেয়েটির সঙ্গে লাফাতে লাফাতে বের হয়ে যায়।
কবি জসীম উদ্দীন হলের ৩১০ নং রুমের জানালায় আমি শুকনো মুখে বসে থাকি।বন্ধু কাবুল যে কিনা ঘুমের কারণে সকাল দশটার ক্লাসও প্রায় মিস করে, সেও সাত-সকালে রেডি। পাজামা-পাঞ্জাবি পরে চটি ফটফটিয়ে সে আমার রুমে এসে ঢুকল। আমাকে সান্ত্বনা দিল। তারপর যাওয়ার সময় আমার নতুন কেনা উত্তরীয়টা নিয়ে গেল। আমি ওর চলে যাওয়া চেয়ে চেয়ে দেখলাম। চার বেডের রুমে সিনিয়র জুনিয়র মিলিয়ে ডাব্লিং, ফ্লোরিং করে আমরা হারাধনের দশটি ছেলে থাকি। সকাল নয়টা নাগাদ নয় জনই বের হয়ে গেল। আমি প্লাস্টার মোড়া পা জানালার জং ধরা গ্রিলে ঠেকিয়ে শুয়ে রইলাম। “কেনরে বিধাতা পাষাণ হেন?” তারপর প্রতি বছরই রমনার মেলায় গিয়েছি, যে বছর বোমা হামলা হলো সেবার তো অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলাম, মাত্র দশ মিনিট আগে ওই এলাকাতেই ছিলাম আমরা।
এত মানুষ, এত গরম, এত জ্যাম, এত বিপত্তি! তারপরেও পহেলা বৈশাখে ওদিকে যেতে হবে। এ এক অমোঘ টান, অনিবার্য আসক্তি। দেশের বাইরে আমার প্রথম পহেলা বৈশাখে মনটা খুব খারাপ হয়েছিল। তেমন কিছু আশা না করেই অনুষ্ঠানস্থলে এসে দেখলাম উদ্যমী কয়েকজন মিলে অনেক কষ্ট করে মুখোশ, ফেস্টুন ইত্যাদি বানিয়েছে। একজনের কাঁধে রেকর্ড প্লেয়ার, তাতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই ‘মেলায় যাইরে’ বাজছে। একজন দু’জন করে গোটা ত্রিশ লোক এলে শোভাযাত্রা হলো। খোলা জায়গায় ঝাল-মুড়ি, চটপটি, বিরিয়ানি, তেহারি বিক্রি হচ্ছে।
বিদেশ-বিভূইয়ে সেইবা কম কি!দিনে দিনে বাঙালি কমিউনিটি বড় হয়েছে, পহেলা বৈশাখের আয়োজনও বড় হয়েছে, আরও জৌলুসপূর্ণ হয়েছে। ক্যানাডার বড় শহরগুলোতে একাধিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন একাধিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, শোভাযাত্রা, মেলা, জমকালো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সবই হয়। আয়োজন ক্ষুদ্র হলেও প্রবাসীদের উদ্দীপনার ঘাটতি নেই। দেশে বলি আর প্রবাসে, পহেলা বৈশাখ শুধুমাত্র উৎসব নয়, এতো আমাদের অস্ত্বিত্বের অংশ, আমাদের শেকড়।
চিরায়ত বাংলার প্রাণের টান, অসাম্প্রদায়িক মানুষের মিলনমেলা।আমরা পহেলা বৈশাখের কোন অনুষ্ঠান আয়োজনই বাদ দিইনা। দেশ থেকে পাঠানো নতুন পাঞ্জাবি, ফতুয়া পরে বের হই, কমিউনিটির সবার সাথে দেখা হয়, সবাই মিলে আনন্দ-ফুর্তি করি। চারুকলার শোভাযাত্রার উন্মাদনা কিংবা রমনা বটমূলে ছায়ানটের সেই আবহ না থাকলেও আমাদের আবেগ উচ্ছ্বাসের ঘাটতি থাকেনা। সারা দিনের উৎসব শেষে ঘরে ফিরি আর শুরু হয় সামনের বছরের আয়োজনের জন্য দিন গোনা।হিসাবমাফিক আরেকটি বছর শেষ হচ্ছে। রাত পেরোলেই নতুন বছর, আবার পহেলা বৈশাখ।
এ যেন বহু বছর আগে আমার সেই পা মচকানো পহেলা বৈশাখ। তবে এবার আমার সাথী সবাই। আজ সারা পৃথিবীই যেন দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে। কোভিড-১৯ মাত্র কয়েক সপ্তাহে আমাদের চিরচেনা পৃথিবীকে পাল্টে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ কেবল শুরু। এই ভাইরাস কেবল লাখো প্রাণ কেড়ে নিয়ে ক্ষান্ত দেবেনা। বরং বদলে দেবে সব কিছু, আমাদের অর্থনীতি, জীবন প্রণালী, ব্যক্তিগত এবং সামাজিক সম্পর্ক, আচার-অনুষ্ঠান, জাতীয়তাবোধ, রাষ্ট্রকাঠামো, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সব কিছু।হতবিহ্বল এই পৃথিবীতে কিসের নতুন বছর! কিসের পহেলা বৈশাখ!
যখন দেশে-বিদেশে মানুষ মরছে কীটপতঙ্গের মত, যখন দেশে লাখো মানুষ বিনা চিকিৎসায় মরার আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে, যখন দিকে দিকে অনাহারী মানুষের আহাজারি, সমগ্র মানব অস্ত্বিত্ব যেখানে হুমকির মুখে, সেখানে উৎসব আয়োজন তো দূরের কথা, এ নিয়ে ভাববার অবকাশ কোথায়! কিন্তু মানুষের মনোজগত বড্ড অদ্ভুত। এই ভয়ানক আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার মধ্যেও আমার মাথায় ঘুরছে সেই সে ঢাকা, মধ্য এপ্রিলের ভ্যাঁপসা গরম, গনগনে সূর্য, চারুকলা, শত মুখোশ, টিএসসি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনার দমবন্ধ ভীড়, ঠেলাঠেলি, পুরনো বন্ধু, নতুন শাড়ি, চুড়ি, পাঞ্জাবি, উত্তরীয়র গন্ধ। উদযাপন না হয় তোলা রইলো সুদিনের জন্য। ততদিন “অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা”। চর্চা হোক অসাম্প্রদায়িকতা আর মানবিকতা।সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা।