সাঈদ তারেক
অনেকেরই ধারনা ঘর থেকে বের হলেই বুঝি করোনায় ধরে বসবে। ব্যপারটা ঠিক তেমন না। খোলা মাঠে নদীর ধারে বাসার ছাদে করোনা থাকার সম্ভাবনা কম- যদি না এলাকাটা হয় লকডাউনের অধীন। এটি ছড়ায় বাহকের সংষ্পর্শে এলে। আক্রান্ত ব্যাক্তির সাথে করমর্দন বা কোলাকুলি করলে অথবা কথা বলার সময় নি:শ্বাষ প্রশ্বাষের মাধ্যমে। বাইরে যেহেতু আমরা জানিনা কে বাহক সে জন্যই মুলত: সতর্কতা হিসাবে মাষ্ক গ্লভ্স পরিধান এবং সোস্যাল ডিসট্যান্সিং বা সামাজিক দুরত্ব হালে ব্যক্তি দুরত্ব বজায় রাখার ওপর জোর দেয়া হচ্ছে।
এ জন্যই লকডাউন। বাসার ভেতরে কিন্তু আমরা সবসময় দুরত্ব বজায় রেখে চলিনা বা চব্বিশ ঘন্টা মাষ্ক গ্লভ্স পড়েও থাকি না, কারন আমরা জানি পরিবারের সদস্যরা কেউ আক্রান্ত না। পাশাপাশি বসছি এক ঘরে থাকছি এক বিছানায় ঘুমাচ্ছি। বাইরে বের হলেই করোনায় আক্রান্ত হতে হবে বিষয়টা যদি এমন হতো তাহলে হাজার হাজার রিকশাচালক ভ্যানচালক ট্রাক-মিনিট্রাক ড্রাইভার আড়তদার পাইকারি ব্যবসায়ী মুদি দোকানদার সব্জীওয়ালা মাছওয়ালা ব্যাংকের লোকজন- গ্রাহক, কনজিউমার গুড্স উৎপাদনকারি হাজার হাজার মিল ফ্যাক্টরির শ্রমিক কর্মচারি, রাস্তায় ডিউটিকরা পুলিশ র্যাব আর্মি সবাই এতদিনে করোনার রোগী হয়ে যেতো। ব্যপারটা হচ্ছে সাবধানতা। যারা এসব জরুরী কাজে নিয়োজিত তারা সাবধানতা অবলম্বন করছেন বলেই নিরাপদ আছেন। সাবধানতা নিয়েই আমরা জরুরী কাজগুলো সাড়ছি।
কাল দেখলাম ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় অনুষ্ঠিত একটি জানাযা নিয়ে শোরগোল পড়ে গেছে। সাবধানতার প্রশ্নটা ওখানে উঠেছে। ফেসবুক ভাইরাল। কারও কারও আশংকা দেশের সাড়ে সর্বনাশ হয়ে গেছে! ওই জানাযা থেকেই করোনা এবার বাংলার ঘরে ঘরে ঢুকে যাবে। আবার সেই ধর্ম! নানা কমেন্ট। একজন লিখেছেন এর ফলে দেশ একটা জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি ওপর চেপে বসলো। কারও মন্তব্য এক জানাযা কোটী জানাযা ডেকে আনলো। একজন এতই ক্ষিপ্ত- লিখেছেন জানাযায় অংশ নেয়া লোকগুলোকে এখনই গুলী করে মেরে ফেলা হোক। কেউ কেউ রাজনৈতিক দৃস্টিকোন থেকে কেউ ধর্মীয় বিদ্বেষ থেকে নানা মন্তব্য করেছেন। আমি সাধারনত: এসব উষ্কানীমুলক বিষয়কে গুরুত্ব দেই না, এড়িয়ে যাই। কিন্তু জানাযা নিয়ে বেশ কিছু পোস্ট কমেন্ট পড়ে মনে হলো অনেকেই না জেনে না বুঝে শুধুমাত্র আবেগের বশে বা অতি মাত্রায় আতংকিত হয়ে কিছু মতামত ব্যক্ত করেছেন। সম্ভবত: পরশু ভারতের তামিলনাড়ুর এক গ্রামে একটা ষাঁড় মারা যাবার পর লকডাউনের মধ্যে কয়েক শ’ লোক সেই ষাঁড় নিয়ে দীর্ঘ বর্ণাঢ্য শবমিছিল করেছে। পত্রিকায় নিউজ হয়েছে কিন্তু কোন দু’পেয়ে ষাঁড়কে এ নিয়ে ফেসবুক ভাইরাল করতে শুনি নাই। ওটা ওদের ধর্মবিশ্বাষ।
প্রথম কথা হলো দেশের এই অবস্থায় সামাজিক বা ব্যক্তি দুরত্ববিধি না মেনে কাল ওভাবে বিশাল আয়োজনের জানাযা করাটা ঠিক হয়েছে কিনা। না কোনক্রমেই ঠিক হয় নাই। দেশবাসী এখন এটা মানছে। আয়োজকদের বিষয়টা মাথায় রাখা উচিত ছিল। তারা দোহাই দেবেন মানুষের আবেগ, ইমোশন বা সেন্টিমেন্টের। হতে পারে এলাকাবাসীর কাছে মৃত ব্যক্তি অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন, সবাই চেয়েছে শেষ বিদায় জানাতে। বাঙ্গালী মুসলিম সমাজে এটা একটা প্রচলিত ব্যপার। তারপরও পরিবেশ পরিস্থিতির গুরুত্ব ফেলে দেয়া যায় না। লোক সমাগম দুইচার পাঁচ শ’ হাজার হলে হয়তো তেমন একটা শোর হতোনা, লক্ষাধিক হয়ে যাওয়াতেই নজরে পড়েছে। প্রশাসনের দায়িত্ব ছিল ঠেকানোর। পারে নাই। গুলী চালিয়ে পাঁচ দশ হাজার মেরে ফেলতে পারতো, তাতে হয়তো জানাযা বন্ধ হতো কিন্তু একটা জানাযা ঠেকাতে মুসুল্লী হত্যা- সরকারের জন্য তা কোন গুড ক্রেডিট হতো না। যে ভাবেই হোক জানাযা পড়ানো হয়ে গেছে পাশাপাশি সরকারি ব্যবস্থাও নেওয়া সাড়া! দায়িত্বে অবহেলার দায়ে ওসি প্রত্যাহার, এলাকা লকডাউন। এরপর যদি দরকার হয় বাড়ী বাড়ী গিয়ে ট্রেস্টিং করা যেতে পারে। ওই লক্ষাধিক মানুষকে কোয়ারেন্টিনেও নেয়া যেতে পারে।
এখন দেখা যাক জানাযা পড়ে মানুষগুলো আমাদের কি সাড়ে সর্বনাশটা করলো। আগেই বলেছি ঘরের বাইরে এলেই করোনা ধরবে বা ছড়াবে তেমন কোন দিব্যি নাই। এরা যে এলাকার তা কি লকডাউন ঘোষিত ছিল? ওই এলাকায় কি ইতিপুর্বে কেউ সনাক্ত হয়েছে? কেউ কি করোনায় মারা গেছে? ওটা কি রেড জোন? হট স্পট? যদি না হয়ে থাকে তাহলে কি করে নিশ্চিত হওয়া যাবে যে সবাই করোনা পজেটিভ। না হলে দশ পনেরো মিনিটের জানাযায় অংশ নিয়ে এরা কিভাবে অন্যকে সংক্রমিত করবে! তাছাড়া মানুষ তো। ধর্মপ্রান মুসুল্লী বলে গরু ছাগল তো না। দেশের অবস্থা বোঝে নিজের ভালমন্দ বোঝে। জেনে বুঝে কেউ ভাইরাস ছাড়াতে বা আনতে জানাযায় গেছে- এতটা বেকুব মনে করা কি ঠিক?তারপরও এত লোকের মধ্যে একেবারে কারোরই কোন উপসর্গ ছিল না এটাও হলফ করে বলা যাবেনা। সে কারনে ব্রাহ্মনবাড়িয়ার স্থানীয় সাংবাদিকদের প্রতি একটা অনুরোধ রইলো- আজ থেকে হিসাব রাখুন, চৌদ্দদিন পর আমাকে দয়া করে জানাবেন জানাযা পড়ার কারনে এই এক লাখের মধ্যে কয় লাখ করোনায় মারা গেছে! ‘সাড়ে সর্বনাশে’র একটা পরিসংখ্যান থাকা দরকার।