মীর হুমায়ূন কবীর
ধুলোভরা রাস্তাটা এখন কালো পিচের আলিঙ্গনে উত্তপ্ত। রাস্তার পাশে বদরুদ্দিনের ভাঙা বাড়িটি আর নেই, সেখানে বসেছে ধান-ভাঙার কল। বদরুদ্দিনের দরাজ গলায় প্রাণ শান্ত হওয়ার সুযোগ নেই। সারাদিন এখানে কলের খটখট শব্দ আর মহাজনের কটমট দৃষ্টি। বদরুদ্দিনের বাড়ির পাশেই বাঁশ বাগান, তারপরেই এমদাদদের বাড়ি। এ বাগানের শোঁ-শোঁ শব্দ এখনও কানে ভাসে এমদাদের। আর নুরু হুজুর, যে ওকে নাতির মতো আদর করতো, বাড়ি নিয়ে কাঁঠাল খাওয়াতো, তাকেও খুব মনে পড়ে। তবে সবচেয়ে বেশি স্মরণে আসে নানার বাড়ন্ত মেয়েটাকে। এমদাদকে দেখে সে শুধুই হাসতো। এ হাসির অর্থ বুঝতো না এমদাদ। মেয়েটার হয়তো বিয়ে হয়েছিল, নইলে শাড়ি পড়বে কেন? একুশ বছর পর আজ তাই মনে হলো এমদাদের।
দীর্ঘদিন পূর্বে এই লক্ষ্মীদরিয়া গ্রামে কেটেছে এমদাদের শৈশব। পদ্মার যে ধারাটা বয়ে গিয়েছিল লক্ষ্মীদরিয়ার পাস দিয়ে, আজ তা নেই। কতো ট্রলার যে যাতায়াত করতো ওখান দিয়ে! শিশু এমদাদের কাছে ওসব ছিল জাহাজের মতো। আচ্ছা, সাগর ট্রলার কি এখনও আছে ? ওই ট্রলারই তো এমদাদের বেশি পছন্দের। না, সাগর ট্রলার আজ নেই, সাগরিকাও নেই। সাগর ট্রলার এখন হয়েছে পিচের রাস্তার ভুটভুডি গাড়ি, আর সাগরিকা হালিম ক্যাশিয়ারের বউ। পাঁচ বয়সে এমদাদের সাথে সাগরিকার গভীর ভাব ছিল। সাগরিকার বয়স তখন আট। এ ভাব কখনও বর-বধূ, কখনও মা-ছেলেতে ভর করতো।
ইটভাটার পাশেই মুনশির আমবাগান। এই বাগানের মাচার ওপর চলতো ওদের সংসার-সংসার খেলা। এমদাদ পাশের ঝোঁপ থেকে আনতো বালুর চাল, কচুর মাংস, আরো কতো কী যে! সাগরিকা রান্না করে ক্লান্ত হতো। খাবার সময় ঠোঁট পাকড়ে কেমন অদ্ভুত শব্দ করতো ওরা। তারপর শুরু হতো তাদের একান্ত সংসার; যা কখনও আনাড়ি, কখনও হাতুড়ে, কখনও বা হিং¯্র। কিন্তু ওসব কিছু সাগরিকাকে হয়তো তুষ্ট করতে পারতো না। তাই অচেনা জগতোর আনাড়ে খেলোয়াড়ের চেয়ে চেনা জগতের বাচ্চা এমদাদকেই ওর বেশি ভালো লাগতো। এমদাদকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে অস্পষ্ট দুটো স্তনদানই যেন সাগরিকার কাছে অনেক সুখের ছিল। এমদাদ একমনে খেয়ে যেত, আর সাগরিকা মাথা নাড়তো। এমদাদের বরবেশের চেয়ে সন্তানসুলভ আচরণই সাগরিকাকে সে সময় মুগ্ধ করতো।
এভাবে অনেকক্ষণ পর্যন্ত চলতো ওদের সংসারলীলা। তারপর মা-ছেলে বের হতো মোহনদের পুকুরপাড়ে। কোনোদিন লিচু পাড়ে, কোনোদিন বেগুন ছিঁড়ে, কখনও ফড়িং ধরে। লাল ফড়িংটাকে এমদাদ ডাকতো হেলিকাপ্টার বলে। আর সাগরিকা একটা ফড়িং ধরতে পারলেই তার স্তনে ওটাকে চেপে ধরতো। ফড়িংয়ের ঠোকড়ানো তার কাছে মনে হতো ছোট্ট শিশুর কচি দাঁতের কামড়। এক অচেনা মাতৃত্বের সুখে তখন ওর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠতো।
২.
হালিম ক্যাশিয়ার টাকাওয়ালা লোক। বউকে কম ভালোবাসে না। শহরে বড় বাড়ি ভাড়া করেছে। বউকে কত কিছু সে এনে দেয় ! কিন্তু কেন যেন শান্তি নেই সাগরিকার মনে। ওর উত্তাল ভাবনায় ইটভাটার কথা মনে পড়ে, পরক্ষণে অবশ্য জোয়ারের ¯্রােতে ভাটা চাপা পড়ে চোরাবালির তলায়। সাগরিকার পাড়াতো ভাই রাজ্জাক। এই শহরে নতুন এসেছে। বুবুর সঙ্গে কথা বলতে এমদাদের প্রসঙ্গও আসে। লক্ষ্মীদরিয়া ছেড়ে যাওয়ার পর ওরা কোথায় বাড়ি করেছে, কয়টা ভাই হয়েছে ইত্যাদি। এমদাদ এখন এ শহরেই তেরো হাজার টাকা মাইনের চাকরি করে। সাগরিকা রাজ্জাককে দিয়ে এমদাদকে নেমন্ত্রণ করে। বালির চাল নয় সে বাশমতি চালের ভাত রাঁধে, কচুর মাংস নয় একটা আস্ত কালো মোরগ জবাই করে।
এমদাদও আসে হর্ষচিত্তে। একুশ বছর পর তার দেখা হবে এমন এক নারীর সঙ্গে, যে একইসঙ্গে প্রেয়সী এবং মাতৃত্বের দাবিদার। এ কী হয়েছে সাগরিকা! এ যেন সত্যিই বর্ষার উত্তাল সাগর, কানায় কানায় পূর্ণ ওর চারধার। জোয়ারের ¯্রােতের মতো ওর রূপও যেন উপচে পড়তে চাইছে।
ইস! এই রূপের সাথে ওর দুঃখটাও যদি ঝরে পড়তো।
এমদাদকে হারানোর দুঃখ নয় এটি। শৈশব থেকে যে নারী সব সময় মা সেজেছে, ডাক্তার বলেছে সে কোনোদিন মা হতে পারবে না।