জামশেদ উদ্দীন, ঢাকা
বেলুনকে শক্ত বস্তু ভেবে ‘ভেনিস’ করার চেষ্টা করলে যেমন দাঁড়ায় ফলাফল। Ñআয়ুকালে ‘কুড়ি’ হয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসলে অনুরূপ আলামত বা বেগতি হয়। সেরু এতসব কিছুই জানে না। তার জীবনে তো এমন ঘটনা ঘটেনি কখনো।
নতুন বউয়ের হাসি দেখে বিস্মিত হওয়ার ঘটনা হয়ত সে নিজেই এখন বুঝতে পেরেছে। কারণ, দাঁতসুদ্ধয় ধরেছে। তার ভাগ্যই ভালো, তখনো বউকে ঘরে উঠিয়ে আনেনি। নয়তো প্রতিবেশীর কাছে নেহাত সমালোচনার পাত্র হতো। যৌতুক নিয়েছে মোটা অংকের, না হলে কী সাধে এমন বিয়ে? তাই বেচারা তড়িঘড়ি করে ডেন্টিসে নিয়ে ঘষেমেজে দাঁতে শান দিতে বাধ্য হয়? এখন নাকি গিন্নি হাসলে মুক্তা ঝরে!
অথচ কেউ সেরুর আজন্ম দুঃখটা বুঝতে চেষ্টা করেননি। তারও আয়ুকাল ক্ষয় হয়েছিল অলক্ষ্যে। তার আরেকটি দুর্নাম আছে। অমলেট বলেই যুগের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে পারেনি। তাই হামেশা দু’একবেলা না খেয়ে থেকেই আসছে বা কেউ সেধে ডেকে কয়ে না খাওয়ালে উদরে তুষের আগুন জ্বলতো দিনভর। বলেনতো এভাবে কী দিন চলে?
তবে তার অভিজ্ঞতা ঢের রয়েছে। পরিশ্রমে এমন দীনতা-হীনতা ভর করেছিল বহুবার। এটি স্বতঃসিদ্ধ সত্য হিসেবে প্রমাণ মিলেছে তার জীবনে।
একদিন কোনো কারণে যথাসময়ে কাজে উপস্থিত হতে পারেনি। অর্থাৎ কাজটি তাকে আর করতে হয়নি। শুধু শোরগোল আর গলা হেকে দিনটা পার করে দেয়। তাতে নাকি ভাগ্যটা বেশ প্রসন্ন হয়।
অবশ্য এর মধ্যে যখন পাকাপাকি হয় পাত্রীর। বড়মুখ করে হবু বউয়ের কৌশলাদি জানতে ইচ্ছে জাগল। তখন মিষ্টি-মিষ্টি কথা শোনা তো দূরে থাক, একবারও মুখ তুলে ফিরে তাকায়নি। হয়ত তাতে দাঁতের দাঁদলামি খসে অন্তহীন আবরণ খসে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। তাই এ ভীতি প্রচন্ড-ভাবে পেয়ে বসে। এমন একটি অকা্যঁ তত্ত্ব ঘটক মোবারক বরের পক্ষে বুঝাতে সক্ষম হয়। এটি যদি সত্য হয়, নাম ধাম জিজ্ঞেস করার পরও কেন দেয়নি হ্যাঁ বা না উত্তর? তাতে ভীষণ খেদ পেয়ে বসে। আবার অনেকে ভাবতে থাকে, পোশাকে আশাকে কম মার্জিত ছিল কিনা? অথচ পারফিউম সুগন্ধিতেও করছিল ম-ম। জুতোর দিকে চোখ ফেরালে আয়নার মতো চেহারা ভেসে উঠে।
বিয়ের পিঁড়িতে বসবেই। কনের পরে সব দাবি পূরণ করবেই। যে করে হোক স্বর্ণ-বস্ত্র সংগ্রহ করবেই। এমন নিশ্চিয়তা পেয়ে কনের পক্ষে খুশিতে আঁখানা। সেও একেবারে বীরত্ব প্রমাণ করেই ছাড়ে।
কনেও টানা তিন-চার মাস ধরে ফুলপরির মতো সেজেগুঁজে আত্মীয়দের বাড়িতে দাওয়াতে দাওয়াতে বেলা পার করে চলেছিল। সত্যি, এসব না হলে কী নারীদের নির্ভরতা এবং উজ্জ্বলতা বাড়ে?
এখন সেরুর বাহাদুরি ধূলায় লুটিয়ে পড়েছে। লকারে রাখার নামে ফন্দি বেবাক ফাঁস হয়ে যায়। এসব অনুষ্ঠানের জন্য সাময়িক গচ্ছিত ছিল যাকে বলে ‘বরগণ্যে’।
বউ তাপসীও কম তেজী নয়। যতদিন পর্যন্ত নিজের অর্থে এসব কিনতে পারেনি। হাতে-পায়ে খালি-শূন্য থেকেই বিধবা সেজে চলছে। হঠাৎ কেউ এমন বেশবাস দেখেই না বলে কী পারে? ‘কী হয়েছিল দাদার? কখন তিনি মারা গেছেন! আহ্, এ বয়সে আপনাকে সাগরে ভাসিয়ে গেল।’
দুই।
—টাইগারপাস, লালখানবাজার হতে জামালখানের দূরত্ব খুব বেশি নয়। কিন্তু এক সময় নাভিশ্বাস উঠতো এ পথ পাড়ি দিতে। বিশেষ করে টাইগারপাস এলাকাটি ছিল সাংঘাতিক ঝুঁকিপূর্ণ। যে কোন মুহূর্তে ঘটতো প্রাণহানির মতো ঘটনা।
নগরীর টাইগারপাসের উঁচু উঁচু পাহাড়-টিলার সাথে দু’প্রান্তের টিলার ছিল আত্মীয়ের মতো সেতুবন্ধন। অবশ্য এখন তা নেই বললেই চলে। অনেকটা ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় দু’একটা টিলা টিকে রয়েছে। আর, তারই পাদদেশে গুটি কয়েক প্রতিকৃতি তা স্মরণ করে দেয়।
—সেরু শহরের এ পথে গণপরিবহনের একটি থ্রি-স্টোক দিয়ে যাচ্ছিল। একের পর এক তিনটি প্রতিকৃতি অতিক্রম করতে গিয়ে তার শরীর ছমছম করে উঠে। একেবারে জীবন্ত মনে হচ্ছিল। এ ভীতিতে সে নিমজ্জিত।
কিন্তু, এ ঘোর কাঁতে তার বেশি সময় লাগেনি। অনেকটা গ্রিক পৌরাণিক কাহিনী তার ওপর যেন ভর করেছে। লিডা’র ¯œান করার দৃশ্য দেখে দেবরাজ জিউস যেখানে স্থির থাকতে পারেনি! অতপর লিডার সঙ্গে মিলন হলো রাজহাঁস ছদ্মবেশে।
কর্ণফুলীর ঢেউ যেন আছড়ে পড়ছে ক্ষণে ক্ষণে। তর্জনি, মধ্যমা নয়, অনামিকাই দৃষ্টি কাড়ে। তারা তো সকলে মায়াবী-অপূর্ব সাজে সেজেছিল।
দু’পাট্টা উড়ে। ভাঙে শিহরণ-অনুকম্পা। বাগানবিলাসের তাড়নায়। যার জন্য একপায়ে বগাও শিকারের আশায় দাঁড়িয়ে থাকে।
—সে ছুটে যায় গন্তব্যে। কিছুটা বাঁক খেয়ে ফিরে দেখে। সোনামণি-ছোট্টমণির নিবেদনে।
ক্ষণে ক্ষণে মাথিন ডাকে, ‘ধীরাজ তুমি কোথায়? কাছে আস, আমার পাশে বসো। বলো, আর কোনো দিন আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না?’
‘না মাথিন, আমরা যুগে যুগে এমনই ছিলাম।।।।
তিন।
‘ও মধুওয়ালা, গম মধু আছে-না? ‘ওমা! কী কদ্দে? ক্যান গম্ নওরকা, হেয়াকুর পারত্তুন রাইত জাগি চাক ভাঙি আইন্নিদি।’
মধুওয়ালা এসব বলতে বলতে চটের বস্তায় রাখা পলিব্যাগ খুলে তা দেখাতে লাগল। মধুওয়ালার মধু দেখতে তাৎক্ষণিক লোকজনও ভিড় জমাতে থাকে। তখন অনেকে বলাবলি করছিল, ‘এ ক্যান আলকাতরা ফানলার?’
আবার কয়েকজন বলল, ‘খোশবু তো ক্যান মধুর মত ফানলার?’
এভাবে সন্দেহের দোলাচলে ঘুরপাক খাচ্ছিল সকলে। মধুওয়ালাও অনড় অবস্থানে। এমন অবস্থায় সে বৈতরণী পার হবেই; এটি তার রুটিরুজির অবলম্বন। সে বলল, ‘এইছ্ন, একেবারে বাসা ভাঙা তরতাজা মধু।’ তার এ কথায় সবাই আবারও হুমড়ি খেয়ে পড়ল মধু দেখতে, এবং সকলের মধ্যে তা নিয়ে ব্যাপক গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল।
তারা বলতে লাগল, ‘মধু’ত্ব ক্যানপরলাড় বাসা ভাসের যে, অইলেও হইত পারে।’ মধুওয়ালাও উপস্থিত লোকজনের মতিগতি বুঝেই কয়েক ফোঁটা মধু কাঠি দিয়ে উঠিয়ে দিতে থাকে। তাতে কয়েকজন বেশ আগ্রহ দেখিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল। তার মধ্যে কয়েকজন রীতিমতো জিহ্বা দিয়ে চেটে চেটে খেতে লাগল। অবশ্য তারা তা খেয়ে খাঁটি কিনা ‘হ্যাঁ-না’ কিছুই বললো না। এর মধ্যে তাদের একজন বলেই ফেললো, ‘গম মধু ন-ফানলার। ন-অইলে হাত ন-পোড়াতো?’ তাদের এ কথা শুনে উপস্থিত অপর একজন বললো,‘দেইখ-না এনগরি কী দলবান্দি মধু খাইতো না পিঁরা?’
—এ ভাবে একের পর এক খাঁটি মধুর পরীক্ষার নানা তত্ত্ব-উপাত্ত বলতে থাকে তারা। তাদের একজন বললো, সে গত বছর আড়াইশ’ গ্রাম মধু কিনেছে সাড়ে তিন’শ টাকা দিয়ে। অথচ এখন দেখছি এ মধু মাত্র বিক্রয় হচ্ছে কেজি সাতশ’ টাকা। দর কষাকষিতে হয়ত দাম আরো কমে আসবে। তার যুক্তি হলো খাঁটি মধু এত সস্তায় বিক্রয় করার কথা নয়। সে বলল, এক মৌচাকে সর্বোচ্চ এক-দেড় কেজির বেশি মধু পাওয়া যায় না। এখানে তো পাঁচ-সাত কেজিরও বেশি হবে মনে হয়। মধুওয়ালাতো মুখ ফসকে বলেই ফেললো, এক বাসা থেকে সে এসব সংগ্রহ করেছে।
উপস্থিত উৎসুক একজন বলতেই থাকে, মধু কেনার সময় এক দোকানদার তাকে বলেই দেয়, শিশিভর্তি মধুর ভেতর যেন কয়েকটি গোলমরিচ দিয়ে রাখে। তাতে নাকি আর মধু নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। মাঝে মাঝে রোদেও গরম করে নিতে হয়।
ঠিকই এ কথায় সে একদিন সকালে উঠোনের রোদে মধু গরম দিল। তার সাথে শিশি’র ছিপিও খুলে দিল, যেন দ্রুত মধু গরম হয়ে যায়। তারপর কি একটা কাজে ঘরের ভেতরে গেল সে। কিন্তু তার ছোট্ট মেয়ে মিথিলা তখন দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল।
মহূর্তের মধ্যে কোত্থেকে একটি কুকুরছানা তেড়ে এল, এবং শিশিভর্তি মধু মাটিতে ফেলে জিহ্বা দিয়ে চেটে চেটে খেতে লাগল। মিথিলা তা বুঝার আগেই কুকুরছানা সব মধু খেয়ে সাবাড় করে দিল। এক পর্যায়ে মিথিলা বাবাকে ডেকে বললো, ‘আব্বু, আব্বু, কুকুরছানা মধু খেয়ে কেমন নাচানাচি করছে।’ সঙ্গে সঙ্গে তিনি দৌঁড়ে এসে দেখতে পেলেন কুকুরছানার এমন কান্ড। মেয়ে মিথিলার জন্য মধু কিনতে তাকে বেশ কিছুদিন অপেক্ষাও করতে হয়। তিনি এ ঘটনায় অনেকটায় নির্বাক হয়ে যান।
না, কুকুর ছানা স্থির-শান্ত থাকতে পারেনি। লেজ গুটিয়ে ‘ঘেউ-ঘেউ’ চিৎকার করে আবারও মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। এক পর্যায়ে দৌড়ে গিয়ে খড়ের স্তূপের সাথে গা ঘষতে লাগল।
তিনি ভাবতে লাগলেন, এটি খাঁটি মধুর ক্রিয়া-তেজ। Ñনিরীক্ষক হিসেবে ব্যাপক হারে পরীক্ষামূলক কুকুরের খামার গড়ে তুলতে তো মন্দ হয় না।