দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বাহিনীর একটি বিশেষ ইউনিট ছিল যাদের একমাত্র কাজই ছিল লাইব্রেরি ধ্বংস করা। পোল্যান্ড দখল করার পর “ব্রেন-কমান্ডোস” বা আরজন স্কোয়াড নামে পরিচিত এই বাহিনী নির্বিচারে পোল্যান্ডের সব লাইব্রেরি, আর্কাইভ, জাদুঘর আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করে। কেন্দ্র থেকে তাদের উপর নির্দেশ ছিল, একটি বইও যেন রেহাই না পায়। একটি জাতির ইতিহাস-সংস্কৃতিকে ভুলিয়ে দেওয়ার এই চেষ্টা যুগে যুগে চলেছে
আবার মানুষই রুখে দিয়েছে আগ্রাসন, জীবন দিয়ে রক্ষা করেছে নিজের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি। অষ্টম শতকে বৌদ্ধ কবিরা তাদের সহায়-সম্বল সব ছেড়ে কেবল ক’টি তালপাতা বুকে জড়িয়ে শত শত মাইল পাড়ি দিয়েছেন, রক্ষা করেছেন প্রাচীন বাঙালী জাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতি। তাঁদের কারণে হাজার বছর পরে এসে আমরা গর্ব করতে পারছি, আমাদের একটি সুনির্দিষ্ট ভাষা ছিল, সেই ভাষায় সাহিত্যও লেখা হতো। নেপালের রাজসভায় পাওয়া ক’খানা চর্যাপদ বিশ্ব দরবারে আমাদের মাথা উঁচু করে দিয়েছে। লুইপা, কাহ্নপা প্রমুখ সিদ্ধাচার্যরা যদি সেদিন তাদের পদগুলোকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রক্ষা না করতেন, বাঙালী জাতির গৌরবময় ইতিহাস হয়তো চিরকাল অন্ধকারেই ঢাকা পড়ে থাকত।
গজনির সুলতান মাহমুদ সতের বার ভারত আক্রমণ করে এই অঞ্চলের সব সম্পদ লুট করেও অতৃপ্ত থেকেছেন কারণ তার দেশে ‘মহাভারত’ ও ‘রামায়ণ’-এর মত একটি মহাকাব্য নেই। তাইতো তার ফরমায়েশে ফেরদৌসী লিখলেন ‘শাহনামা’, সমৃদ্ধ হলো পারস্য ইতিহাস। যদিও প্রাপ্য সম্মানী না পেয়ে দুঃখে অভিমানে মারা গেলেন মহাকবি ফেরদৌসী। সুলতান মাহমুদ সে মহাকাব্য আদৌ পড়ে দেখেছেন কিনা সন্দেহ থাকতে পারে কিন্তু তার এই প্রয়াস পারসিকদের সাহিত্য সংস্কৃতির গতিপথ পাল্টে দিয়েছে সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই।
যুগে হয়তো হিটলারের নাৎসি বাহিনী নেই যারা সব বই পুড়িয়ে দিবে কিন্তু জাতিকে বই বিমুখ করার সকল উপকরণ মজুদ রয়েছে। কেবল টেলিভিশন, ইন্টারনেট আর স্মার্টফোনের প্রচন্ড প্রতাপে বই পড়া আজ যেন চিঠি লেখা বা টেলিগ্রাফ করার মত একটি হারিয়ে যাওয়া বিষয়ে পরিণত হয়েছে। পাঠ্যপুস্তক বা বিসিএস গাইডের বাইরে এখন ক’জন ক’টা বই পড়ে তা একটা গবেষণার বিষয় হতে পারে।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক হিসাবে কাজ করার সময় এ বিষয়টি প্রকট হয়ে আমার সামনে এসেছে। আমি প্রায়ই ছেলেমেয়েদেরকে জিজ্ঞাসা করতাম তারা ক’টি উপন্যাস পড়েছে- তাদের অধিকাংশের সরল উত্তর দুটি- ‘লালসালু’ ও ‘পদ্মা নদীর মাঝি’। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ্ ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৌভাগ্য তারা বাংলাদেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। এ বইবিমুখতার জন্য কে দায়ী? এই আত্মঘাতী সংস্কৃতি থেকে মুক্তির উপায় কী?
ছোট বেলায় আম্মাকে দেখতাম যৌথ পরিবারের হাড়ি ঠেলার অবসরে বই, পত্রিকা, ম্যাগাজিন যখন যা পেতেন নিয়ে বসে যেতেন। আম্মা পড়তেন আর আমার উপযোগী কিছু পেলে পড়তে দিতেন। ‘মায়ের ছেলে’ আমি সেই থেকে বইয়ের পোকা। ভুল বললাম, ছাপার লেখার পোকা। ধার করে আনা গল্পের বই, কিশোর উপন্যাস, বিনোদন কিংবা অপরাধ ম্যাগাজিন, পত্রিকার ছেঁড়া পাতাও আমি পরম আগ্রহে পড়েছি, বাদ দেইনি কিছুই।
একদিন বিকেলে দেখি আম্মা পড়ছেন আর হাপুস নয়নে কাঁদছেন, রাতের রান্নার সময় হওয়ায় আম্মা চলে যেতে বইটা ধরলাম। এক বিকেলেই শেষ হলো ‘দেবদাস’। আম্মার কাছ থেকেই পড়েছি ‘মেম সাহেব’, ‘গল্পগুচ্ছ’ আরও অনেক অনেক গল্প-উপন্যাস। পরবর্তীতে সাহিত্যের ছাত্র হওয়ায় প্রচুর সাহিত্য পড়েছি, সঙ্গে পড়েছি প্রিয় বিষয় ইতিহাস।
আর দশটা ভালো অভ্যাসের মত বই পড়াও পরিবার থেকে গড়ে উঠে। বাবা-মাকেই এই দায়িত্ব নিতে হবে। দেশে কাড়ি কাড়ি পাঠ্যপুস্তক, নোটবই, কোচিং নোট ইত্যাদির চাপে বাচ্চাদের নাভিঃশ্বাস অবস্থা। এর উপরে সাহিত্য, ভূগোল, ইতিহাস ইত্যাদি বই পড়ার জন্য বাচ্চাদেরকে চাপ দেওয়া কঠিন। তবুও বাচ্চাদের মানসিক বিকাশের জন্য, মানবিক, অসাম্প্রদায়িক ও বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলার জন্য যেভাবেই হোক বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। আর একাজে বাবা-মাকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হবে।
আমরা যারা প্রবাসে আছি তাদের জন্য কাজটি বেশ দুরূহ। ছেলে-মেয়েদেরকে যেখানে বাংলা বলা শেখাতেই বাবা-মা গলদঘর্ম, সেখানে বাংলা বই পড়ার অভ্যাস করানো কঠিন জানি। তবু ভাবতে পারিনা, আমাদের মানে বাঙালীর ছেলেমেয়েরা দেবদাসের দুঃখে কাঁদবেনা, ‘লাল নীল দীপাবলি’ পড়বেনা, জানবেনা তাদের ভাষা-সাহিত্যের ইতিহাস।
এখানকার স্কুলে আমাদের বাচ্চারা ফ্রেঞ্চ শিখে, বিকেল বেলা আরবী শিখে, আবার অনেক বাচ্চাই সময় করে নাচ-গান শিখে। এতকিছু যখন হচ্ছে বাংলা পড়াটাও শেখানো যায় বলে আমার বিশ্বাস। বাচ্চাদের হাতে একটি বা দু’টি বাংলা বই ধরিয়ে দিলে তাদেরকে খুব কষ্ট দেওয়া হবে বলে মনে হয়না।
এই বিশ্বাস থেকেই চার বছর বয়সী পুত্রের জন্য একগাদা বাংলা বই নিয়ে এসেছি। প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে তাকে বই পড়ে শোনাতে হয়। ঠাকুরমার ঝুলির সাথে বেশ কিছু রূপকথা তার মুখস্ত। পান্তা বুড়ি, সিঁধেল চোর আর ডালিম কুমার তার প্রিয় চরিত্র। বাংলা বইয়ের প্রতি, ভাষার প্রতি পুত্রের এই আগ্রহ থাকবে তো? আমি নিজে আমার অংশটুকু ঠিক মত করতে পারব তো?
সবাইকে বিশ্ব গ্রন্থ দিবসের শুভেচ্ছা।