লেখক পরিচিতি :জন্ম ১৯৮৯ সালে ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হাওড়া জেলায়। শিক্ষা: প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষা হাওড়া জিলা স্কুলে। এরপর কলকাতার “সেইন্ট থমাস্ কলেজ অফ এঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনলজি” কলেজ থেকে বৈদ্যুতিক কারিগরিবিদ্যা নিয়ে প্রযুক্তিতে স্নাতক (B.Tech. in Electrical Engineering)। পেশা: তথ্য প্রযুক্তি পেশাদার (IT Professional)। নেশা: বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা নিয়ে পড়াশোনা ও চিন্তাভাবনা। এছাড়াও বিজ্ঞান প্রবন্ধ, কল্প-বিজ্ঞান ভিত্তিক গল্প ও বিজ্ঞান কবিতা লেখা।
ইম্পেরিয়াল মেডিকেল কলেজ অফ লন্ডন। ক্লাসরুমে ছাত্রছাত্রীদের বিবর্তনের কারণ বোঝাচ্ছেন ডঃ এডওয়ার্ড ডি বস্কো। ছাত্রছাত্রীদের প্রথম সারির কোণের সিটে বসে রয়েছে এক আগ্রহী ছাত্র। প্রোফেসারের মুখের প্রতিটি শব্দ যেন সে গোগ্রাসে গিলছে। ইম্পরট্যান্ট বিষয়গুলো একটা নোটবুকে লিখে ফেলছে। নাম দিগন্ত। ভীষণ পড়ুয়া কিন্তু বুদ্ধিসুদ্ধি তার বেশ কম।
বিবর্তন প্রধানত তিনটি কারণে ঘটে – মিউটেশন, সেক্সুয়াল রিকম্বিনেশন (রিপ্রডাকশন) ও ন্যাচারাল সিলেক্শন। মিউটেশন হলো পরিবেশ ও অন্যান্য জীবের প্রভাবে কোন জীবের জিনে নিউক্লীয়টাইড সিকোয়েন্সের এক স্থায়ী পরিবর্তন যা জীবের মধ্যে নতুন বৈশিষ্ট্যের জন্ম দেয়। প্রোফেসর আরও বলে চললেন – সেক্সুয়াল রিপ্রোডাক্শানের মাধ্যমে সবসময় নতুন নতুন বৈশিষ্ট্যের সৃষ্টি হয়। সন্তানের মধ্যে কিছু মায়ের, কিছু বাবার আর কিছু নতুন বৈশিষ্ট্য দেখা দেয় যাদের একসঙ্গে ‘ইনহেরিটেন্স’ বলে। এরপরেই আসে ন্যাচারাল সিলেক্শন-র কথা যে এইভাবে সৃষ্টি হওয়া নতুন নতুন বৈশিষ্ট্যের জীবেদের মধ্যে কোন্ জীবগুলি বা জীবের কোন্ বৈশিষ্ট্যগুলি প্রকৃতিতে টিকে থাকবে আর কারা বিলুপ্ত হবে তা ঠিক করে দেয়। প্রোফেসর এডওয়ার্ড এর এই বক্তব্য শেষ হলে ছাত্রছাত্রীদের দ্বিতীয় সারি থেকে এক প্রশ্নসূচক মিষ্টি গলার স্বর উঠে এল – “মে আই বি এক্সিউস্ড” ? প্রোফেসর বললেন – “ইয়েস সুনীতি…”। সুনীতি বলল – “স্যার,ক্যান উই কনসিডার মেল, ফিমেল, ট্রান্সজেন্ডার ক্যাটাগরিস্; মোরওভার হোমোসেক্সুয়াল, হেটারোসেক্সুয়াল, বাইসেক্সুয়াল সাব-ক্যাটাগরিস্ টু বি ডিফারেন্ট ডিফারেন্ট সাব-স্পিসিস্” ? উত্তরে ডক্টর জানালেন যে তারা অবশ্যই ভিন্ন ভিন্ন সাব-স্পিসিস্ কিন্তু সূক্ষ্মতর অর্থে প্রতিটি জীবই অনন্য ও এক একটি সাব-স্পিসিস্।
সুনীতি সুন্দরী। দুধে আলতা গায়ের রং, ঘন কালো কোঁকড়ানো চুল, টানা টানা বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, টিকালো নাক, নম্র গোলাপী ঠোঁট আর দৃঢ় চিবুক নিয়ে সে যেন ভারতীয় দার্শনিক সৌন্দর্য্যের উৎকৃষ্ট এক নিদর্শন। তবে তার মনের মাটিতে জ্ঞান, বিবেক, বুদ্ধি, বিবেচনা আর ঔদার্য্য বর্ষণেও প্রকৃতি কোন কার্পণ্য করেনি। দিগন্ত ও সুনীতির সম্পর্কটা বন্ধুত্বের। উভয়ের এই ভীষণ বন্ধুত্বের কারণ যে শুধু তারা উভয়ই বাংলাভাষী তা নয়, আর একটা বড় কারণ হলো যে তাদের চিন্তা-ভাবনার ওয়েভলেংথ খুব মেলে। দিগন্তের মধ্যে যে বিষয়টা সুনীতি সবচেয়ে বেশী খুঁজে পায় তা হলো সারল্য। দৃষ্টিভঙ্গির আর দোষ কোথায় ? সুন্দরের সর্গে সকল মনই গর্ভবতী হতে চায়। প্রকাশ না করলেও সুনীতির মনে দিগন্ত সম্পর্কে ভাবনাগুলো বার বার বন্ধুত্বের গন্ডি পেরিয়ে যায়। প্রতিদিন কলেজ শেষে দুজনে একই সাথে বাড়ি ফেরে। এছাড়াও মাঝে মাঝে দুজনে লং ওয়াকে বেরোয়। মনের ও আবেগের অনেক কথাই হয়। একদিন সুনীতি দিগন্তকে অদ্ভুত এক প্রশ্ন করল – “দিগন্ত, তুই জীবনে এমন কোন স্পর্শ পেয়েছিস যা কোনদিন ভুলতে পারবি না”? দিগন্ত বলল – “দুরকম স্পর্শই আমার জীবনের চালকশক্তি”। সুনীতি জিজ্ঞাসা করল – “কি কি”? দিগন্ত বেশ আবেগ প্রবণ হয়ে পড়ল, বলল – “একটা স্পর্শে রয়েছে প্রচন্ড উত্তেজনা যা আমি পাই বিভিন্ন সায়েন্টিফিক ফ্যাক্ট থেকে। তারা যেন আমায় বার বার ঠেলে আর বলে যে ছুটে চলো, এখনও কিছুই জানা হয়নি, আরও অনেক ঘটনা অজানা। অন্য স্পর্শটা মায়ের যাতে রয়েছে ভীষণ শান্তি। সে যেন বারে বারে আস্বস্ত করে বলে যে সেই একমাত্র সত্য যা আমার গন্তব্য”। দিগন্ত ভীষণ নরম মনের আর ইমোশনাল। এই দূর দেশে মায়ের কথা উঠলেই তার দুচোখ ভরে ওঠে। সুনীতি দিগন্তের মনকে একটু ডাইভার্ট করার জন্য সরাসরি বিজ্ঞানের আলোচনা শুরু করে দেয়। সুনীতি বলল – “বল্, ‘থিয়োরি অফ ইভোলিউশন’ কেমন লাগছে ? আর্দ্র চোখ মুছতে মুছতে দিগন্ত বলল – “ভালোই। কিন্তু…..”। সুনীতি বলল – “কিন্তু কী” ? দিগন্ত বলল – “না আসলে প্রোফেসর এডওয়ার্ড যখন সবার সামনে বলছিলেন যে বিবর্তনের একটা কারণ নাকি সেক্সুয়াল রিপ্রোডাক্শন, আমার না ভীষণ লজ্জা করছিল”। এই শুনে সুনীতি হেসে গড়িয়ে পড়ল, তারপর বলল – “ধ্যাত্, এতে লজ্জার কি আছে ? এই তো তুই আমাকে বলছিস, কই লজ্জা পাচ্ছিস না তো”। দিগন্ত বলল – “আরে তোকে সব বলা যায়”। সুনীতি মুচকি হেসে বেশ সুর টেনে বলল –“আচ্ছা…….বুঝলাম। আমাকে সঅঅঅব বলা যায়”। দিগন্ত সিরিয়াস হয়ে বলল – “তুই আবার বাজে ইয়ার্কি করছিস। এইজন্যই তোকে কিছু মনের কথা বলতে নেই”। সুনীতি দিগন্তের দুই গাল টিপে বলল – “আচ্ছা বাবা সরি। তা বলে আবার রাগ করে বসে থাকিস না”। সুনীতি এবার একটু উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল – “বাই দ্য ওয়ে, ‘সেক্সুয়াল রিপ্রোডাক্শন’ বলতে মনে পড়ল, সেদিন একটা রিসার্চ আর্টিকল্ পড়ছিলাম জানিস – রিসেন্টলি জানা গেছে যে শুধু মাইক্রোব্স নয়, এমন মেরুদন্ডী প্রাণীও আছে যারা সেমিসেক্সুয়াল রিপ্রোডাক্শান এর মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি করে”। দিগন্ত কিছুটা ভুরু কুঁচকিয়ে জিজ্ঞাসা করল – “’সেমিসেক্সুয়াল রিপ্রোডাক্শান’ বলতে……‘বাইনারী ফিশন্’”? মৃদু ধমকের সুরে সুনীতি দিগন্তকে বলল – “আরে ‘বাইনারী ফিশন্’ তো ‘আসেক্সুয়াল রিপ্রোডাক্শান’ যে পদ্ধতিতে সাধারণত ব্যাক্টেরিয়া বংশবৃদ্ধি করে। ‘সেমিসেক্সুয়াল রিপ্রোডাক্শান’-র মধ্যে পড়ে ‘গাইনোজেনেসিস’, ‘হাইব্রিডোজেনেসিস’ আর ‘পারথেনোজেনেসিস্’………….”।
তার পরের দিন সুনীতি কলেজে এল না।খুব প্রয়োজন না হলে সুনীতি কলেজ মিস্ করার মেয়ে নয়। দিগন্ত সারাদিনে অনেকগুলো কল্ করল। একটা কলও রিসিভ্ড হল না। একটা মেসেজেরও রেসপন্স এল না। পরের দিনও একই ব্যাপার, বরং সুনীতির সেল এবার সুইচড অফ ইন্ডিকেট্ করছিল। তৃতীয় দিনে সুনীতির রুম-মেট জেনিথ বেনিংটন কে কলেজে উপস্থিত দেখে দিগন্ত তাকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে যে সুনীতি কোন আর্জেন্ট কারণে ইন্ডিয়া ফিরে গেছে। জেনিথ জানাল যে কী কারণ তা সুনীতি তাকে না বললেও সুনীতির হাব-ভাব তার মোটেও স্বভাবিক মনে হয়নি। দিগন্ত খুব টেন্স্ড হয়ে পড়ল। আরও তিন-চার দিন কেটে গেল। সুনীতির কোন খবর নেই। একটা অজানা আশঙ্কা ক্রমাগত দিগন্তের মনকে ঘিরে ধরছিল। এই কদিনে সুনীতির থেকে দূরে থেকে দিগন্ত যেন নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছে। নতুন করে অনুভব করেছে তার সাথে সুনীতির সম্পর্কটাকে। বার বারই সুনীতির মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সুনীতির কোন বিপদ হয়নি তো – এই দুশ্চিন্তাই দিগন্তকে বার বার চেপে ধরে। এতদিন ধরে সচেতন মনে দিগন্ত যাকে শুধু বন্ধু ভেবে এসেছে, অবচেতন মনে তার জন্য যেন লুকানো ছিল অন্য এক অনুভূতি। দিগন্ত আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। মুম্বই-এ সুনীতির বাড়ির ঠিকানা তার জানাই ছিল। লন্ডন থেকে সে মুম্বই-এ এসে সরাসরি গেল সুনীতির বাড়ি। কলিং বেল কয়েক বার বাজাতে সুনীতিই দরজা খুললো। সুনীতির চোখ-মুখ বেশ শুকনো ঠেকল। সেই হাসি-খুশি ভাব যেন বিবাগী হয়েছে। দিগন্তকে দেখে সুনীতি যেন মনে একটু বল পেল। দিগন্ত ভুরু কুঁচকে ভীষণ বিচলিত হয়ে জিজ্ঞাসা করল – “কি রে ? কি হয়েছে ? তোর কোন খবর নেই। সব ঠিক আছে তো” ? সুনীতি বলল – “কিচ্ছু ঠিক নেই । ভেতরে আয়, সব বলছি“। সুনীতির ঘরে দুজনে নিরিবিলি বসে দিগন্ত সব শুনল। সুনীতির দিদি সুচেতনার শরীরটা খারাপ হওয়ায় ও পরপর কয়েকদিন বমি হওয়ায় বাড়িতে ডাক্তার ডাকা হয়েছিল। ডাক্তার সুনীতির দিদিকে পরীক্ষা করে সন্দেহ করেছিলেন যে সুনীতি সন্তান সম্ভবা। পরে সব টেস্ট রিপোর্ট সেই কথাই বলেছে। কিন্তু সুনীতির দিদি সুচেতনা বার বারই জানিয়েছে যে এ অসম্ভব কারণ সে এখনও পর্যন্ত কখনই কোন পুরুষের সাথে সেরকম ঘনিষ্ঠ হয়নি।
“কুমারী মাতা”। এর থেকে ভালো মশলা মুড়ি বোধ হয় পাড়ার লোকেদের কাছে আর কিছু হয় না। একজন মানুষের ব্যক্তিগত জীবন টেবিল টক হয়ে চারপাশের বাড়িতে বাড়িতে ছড়িয়ে পড়েছে এবং কিছু মানুষ বিস্কিটে কামড় দিয়ে আর চায়ের একটা সিপ নিয়ে তা উপভোগ করছে। নির্লজ্জ প্রশ্ন আর বেআব্রু কটাক্ষে সুচেতনা একদম ভেঙ্গে পড়েছে। এরই মধ্যে সে একবার সুইসাইড অ্যাটেম্পট-ও করেছে। এই বলতে বলতেই সুনীতি কেঁদে দিগন্তকে জড়িয়ে ধরল। সুনীতি বেশ কিছুক্ষণ দিগন্তের জামা আঁকড়ে কাঁদল। দিগন্ত বেশ অপ্রস্তুত। সে আড়ষ্ট হয়ে রইল। এরপরই হঠাৎ সুনীতি সম্বিত ফিরে পেলে চোখের জল মুছতে মুছতে সংকোচে দূরে সরে গেল। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা। নিজের অপ্রস্তুত অবস্থা কাটিয়ে সুনীতিকে স্বাভাবিক অনুভব করানোর জন্য দিগন্ত বলে উঠল – “ক-কষ্ট পাস না সুনীতি। আচ্ছা ডাক্তারের কোন ভুল হচ্ছে না তো”? সুনীতি চোখের জল মুছতে মুছতেই বলল – “একাধিক ডাক্তার দেখানো হয়েছে। একাধিকবার টেস্ট করানো হয়েছে। বার বার একই রেসাল্ট। কিন্তু আমি আমার দিদিকে অবিশ্বাস করতে পারব না। আমার দিদি সেরকম মেয়েই নয়। মা-বাবাকে সমাজের নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে সেরকম কাজ ও কক্ষনও করতে পারে না”। সুনীতির চোখ-মুখ ভীষণ ডিপ্রেস্ড দেখাচ্ছিল। এমন অবস্থায় শান্তনা দেওয়া ছাড়া দিগন্ত আর কিই বা করতে পারে। সুনীতি দিগন্তকে রিল্যাক্স্ড ফিল করানোর জন্য সবসময়ই বিজ্ঞান প্রসঙ্গ টেনে আনত। দিগন্ত তার সহজ সরল বুদ্ধিতে আর কিছু না ভাবতে পেরে সেই চেষ্টাই করল। সে বলল – “তুই শেষ আমায় পারথেনোজেনেসিস্ এর কথা বলে ছিলিস না। বিষয়টা নিয়ে তারপর আর আমার তেমন পড়াশোনা করা হয়নি……..”। সুনীতি প্রচন্ড রেগে গেল – “তোর স্বাভাবিক বুদ্ধি কবে হবে দিগন্ত ? এখন ঐসব আলোচনা করার সময়” ! একথা বলতে বলতেই সুনীতি হঠাৎ থেমে গেল আর ভুরু কুঁচকে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে বলল – “তুই কি বললি”? দিগন্ত বেশ ঘাবড়ে গিয়ে একবার ঢোক গিলে বলল – “ক….কি আবার বললাম, বলছি পারথেনোজেনেসিস্…….”। দিগন্তের কথা শেষ হতে না হতেই সুনীতি দিগন্তের থেকে মুখ ফিরিয়ে চোখ বড় বড় করে বলল – “এও কি সম্ভব”! সুনীতি যে কি ক্লু পেল তা দিগন্ত কিছুই বুঝল না। সুনীতি সঙ্গে সঙ্গে লন্ডনে ডঃ এডওয়ার্ডকে কল করল ও স্কাইপে আসার জন্য রিকোয়েস্ট করল। স্কাইপে সুনীতি এডওয়ার্ডকে প্রথমেই যে প্রশ্ন করল তা হলো যে ঠিক কোন্ মেরুদন্ডী প্রাণীদের মধ্যে পারথেনোজেনেসিস্ দেখা গেছে। উত্তরে প্রোফেসর-র বক্তব্য – ইউনিসেক্স ভার্টিব্রেট্স অর্থাৎ উভয়লিঙ্গ মেরুদন্ডী। উভয়লিঙ্গ মেরুদন্ডী প্রাণীদের মধ্যে তিন ধরনেরই সেমিসেক্সুয়াল বা ক্লোনাল রিপ্রোডাক্শন দেখা গেছে। এদের মধ্যে পারথেনোজেনেসিস্ একটি। ডঃ আরও জানালেন যে এখনও অবধি শুধু স্তন্যপায়ী বাদ দিয়ে বিশেষ বিশেষ মাছ, উভচর, সরীসৃপ ও পাখি – এই সকল মেরুদন্ডীর মধ্যেই পারথেনোজেনেসিস্ আবিষ্কৃত হয়েছে। এরপর সুনীতি তার দিদির ঘটনা সব বলল ও এও জানাল যে সে সন্দেহ করছে যে তার দিদির এই অবস্থার জন্য পারথেনোজেনেসিস-ই দায়ী। এ কথা শুনে হতভম্ব হয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় প্রোফেসর বললেন – “সুনীতি, ডু ইউ নো হোয়াট ইউ আর সেইং ! পারথেনোজেনেসিস্ ইস ইমপসিবল্ ইন হোমোসেপিয়েন্স সেপিয়েন্স”। সুনীতি একটু উত্তেজিত হয়ে বলল – “হোয়াই নট্ স্যার্ ? হিউম্যান বিইং ইস্ ইভল্ভিং এভ্রি সিঙ্গল্ সেকেন্ড”। প্রোফেসর বললেন – “লুক্ সুনীতি, আই হ্যাভ্ অলওয়েস্ প্রেইসড্ ইয়োর ইন্টেলেক্চুয়ালিটি অ্যান্ড আউট অফ বক্স থিংকিং। বাট্ দিস্ টাইম, হোয়াট ইউ আর সেইং ইস্ টোটালি ক্রেজি। হাওএভার, হোয়েন ইউ হ্যাভ্ সাজেস্টেড্, কাম টু লন্ডন শার্প উইথ ব্লাড, ইউরিন, জেনেটিক স্যাম্পেল্স অ্যান্ড অল দ্য মেডিক্যাল টেস্ট রিপোর্ট্স অফ ইয়োর এল্ডার সিস্টার”।
সুনীতি দিদিকে মা-বাবার দায়িত্বে রেখে দিগন্তের সাথে লন্ডন ফিরে এল। প্রোফেসর স্যাম্পেল্স আর টেস্ট রিপোর্টস অ্যানালাইজ করার জন্য কয়েকদিন সময় নিলেন। নির্দিষ্ট দিনে প্রোফেসরের মতামত জানতে সুনীতি ও দিগন্ত প্রোফেসরের বাড়ি গেল। ডঃ এডওয়ার্ডকে বেশ চিন্তিত দেখালো। তিনি ভুরু কুঁচকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন – “সুনীতি, আইম্ রেল্লি নট আন্ডারস্ট্যান্ডিং ওয়েদার ইউ আর রাইট্। বাট্ আইম্ ড্যাম্ সিয়র্ দ্যাট্ ইউর্ এল্ডার সিস্টার ইস্ ট্রুথফুল”। বিভিন্ন সায়েন্স ম্যাগাজিনে লেখালেখি হচ্ছে যে পুরুষ হোমোসেপিয়েন্স সেপিয়েন্স-র স্পার্ম কাউন্ট কমছে। ফলে মানুষের রিপ্রোডাক্শানে কম্প্লিকেশান তৈরি হচ্ছে। মেডিকেল সায়েন্স এই সমস্যার কিছু সমাধান বের করেছে। প্রোফেসরের বক্তব্য অনুসারে, যদি সুনীতির আন্দাজ সত্য হয়, হয়ত পারথেনোজেনেসিস্ প্রকৃতির নিজস্ব সমাধান – কোন পুরুষের দেওয়া স্পার্ম এর সাহায্য ছাড়াই নারীর শরীরে উপস্থিত ওভাম বা ডিম্বাণু ডেভেলপ করবে ও সন্তানের জন্ম দেবে। আ চাইল্ড উইথ সিঙ্গল্ বায়োলজিকাল পেরেন্ট। সুনীতি বিচলিত হয়ে তার দিদির জীবনের আশংকা আছে কিনা জিজ্ঞাসা করলে প্রোফেসর জানান যে তার দিদির কোন জীবনের আশংকা না থাকলেও বেবি কেমন হবে তা নিয়ে তিনি কিছুই বলতে পারছেন না। তবে ডঃ এডওয়ার্ড একশো শতাংশ নিশ্চয়তার সাথে জানান যে এই কেসে অনেক অ্যাডভান্স্ড স্টেজেও অ্যাবোরশানে মায়ের জীবনের কোন আশংকা নেই। তবে এই সন্তান কেমন হয় তা এক খতিয়ে দেখার বিষয়।
পরের দিন কলেজ থেকে ফেরার পথে দিগন্ত ও সুনীতির অনেক্ষণ কথা হলো। সুনীতির কথাবার্তায় কেবলই হতাশা প্রকাশ পেল – “দিদি স্বপ্ন দেখেছিল স্বামী, সংসার, সন্তান। এই একটা সন্তান নিয়ে কেউ আমার দিদিকে বিয়ে করবে ? তার উপর এমন এক সন্তান যার জন্মতে এত অ্যাবনরমালিটিস্। যে কোন ছেলে এই হিস্ট্রি শুনলে দিদির সাথে সম্পর্কে আসতে চাইবে না। গতকাল অনেক রাতে প্রোফেসর আমায় কল করেছিলেন। ওনার রেফারেন্স-এ মুম্বাই এর একটা খুব বড় মেডিকেল টিম দিদিকে কন্টিনিউয়াস চেক-আপ আর অবসারভেশনে রেখেছে”। এবার সুনীতির গলায় একটা বেশ রাগ প্রকাশ পেল – “মানব সভ্যতায় এমন প্রেগনেনসি প্রথম, তাই আমার দিদি এখন একটা এক্সপেরিমেন্ট করার সাবজেক্ট”। দিগন্ত বলল – “ডঃ তো বললেন অ্যাবোরশানে কোন সমস্যা হবে না, অ্যাবোরশান করালেই তো সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়”। সুনীতি বলল – “আমার দিদিই তাতে রাজি নয়। যে ডাক্তারেরা দিদিকে অবসারভেশন -র নামে শুধু গিনিপিগ্ হিসাবে ব্যবহার করছেন, তাঁরাই দিদির ব্রেইন্ ওয়াশ্ করেছেন”।
এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেল। দিগন্ত ও সুনীতির ডাক্তারি পড়াশোনার লাস্ট ইয়ার চলছিল। ফাইনাল এক্সাম শুরু হতে কয়েকটা মাস বাকি। এইসময় হঠাৎ খবর এল যে সুনীতির দিদির স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশী দিনের প্রেগনেনসির পর কম্প্লিকেশন দেখা দিয়েছে। ইউট্রাসে এমব্রেয়ো অর্থাৎ ভ্রূণ মাঝপথে আর ডেভেলপ করতে পারছে না কারণ সেল ডিভিশন বা কোষ বিভাজন বন্ধ হয়ে গেছে। লিডিং ডাক্তারেরা জানিয়েছেন যে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেই সেমি-ডেভেলপ্ড এমব্রেয়ো অন্য কোন ইয়ং ইউট্রাসে ইমপ্লান্ট না করলে ভ্রূণের মৃত্যু হবে। এই কথা শুনে সুনীতির দিদি সুচেতনা কান্না-কাটি শুরু করে দিয়েছে। বড় মেয়ের মনের অবস্থা দেখে মা-বাবাও বেশ ভেঙ্গে পড়েছেন। ডাক্তারেরাও এই ধরনের আকস্মিক ঘটনায় বেশ চিন্তিত কারণ তাঁরা সকলেই জানতে ভীষণ আগ্রহী যে এই অফস্প্রিং বা সন্তান ঠিক কেমন হয়। সুনীতি দিদির এই খবর পেয়ে রাতারাতি লন্ডন থেকে মুম্বই-এর উদ্দেশ্যে রওনা হলো। ইতিমধ্যে ইন্ডিয়ান বায়োলজিস্ট মহলেও সাড়া পড়ে গেছে। সুচেতনার ইউট্রাসে থাকা ভ্রূণকে নাকি ঘিরে রেখেছে এক ওভাল আকারের বেশ পুরু ও শক্ত প্রোটিন-র তৈরি মোড়ক যা সেই ভ্রূণকে রক্ষা করছে ও নিউট্রিশানাল এলিমেন্টস সাপ্লাই করছে। এ এক নতুন প্রোটিন মলিকিউল যার পলিপেপটাইড চেইনের অ্যামাইনো অ্যাসিড সিকোয়েন্স কোন বিজ্ঞানীরই চেনা ঠেকছে না। এই প্রোটিন মোড়ক থাকার জন্যই নাকি মেডিকেল টিম সুচেতনার ইউট্রাস থেকে অন্য কোন যুবতীর ইউট্রাসে এমব্রেয়ো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন বা ভ্রূণ প্রতিস্থাপনে আশাবাদী। যাই হোক, সুনীতি তার ডাক্তারি পড়াশোনার কথা না ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে সে এই নতুন জীবনকে তার নিজের শরীরে স্থান দেবে, কারণ প্রথমত এই ক্রিটিকাল কেসে কোন মহিলাই সাবজেক্ট হওয়ার রিস্ক নিতে চাইছেন না আর দ্বিতীয়ত সুনীতি তার দিদিকে আর চোখের জল ফেলতে দেখতে পারবে না। তাই এই ভ্রূণকে বাঁচাতে সে যে কোন ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত। দিগন্ত আর বাড়ির সকলের নিষেধ অমান্য করে সুনীতি নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকল। শল্য চিকিৎসার ইতিহাসে এই প্রথমবার এমব্রেয়ো ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন ঘটল এবং তা সফলও হলো।
প্রায় আরও পাঁচ মাস পর ডেলিভারী সাকসেসফুল হলো। আ গ্র্যান্ড সাকসেস্। সকল ডাক্তারের চোখে বিস্ময় আর মুখে হাসি। সুনীতির ক্লান্ত চোখে-মুখেও ফুটে উঠেছে এক গভীর প্রশান্তি। কিন্তু ডেলিভারীর কয়েক মিনিটের মধ্যেই এক দুর্ঘটনা ঘটে গেল। সুনীতির ইউট্রাসে সেই আশ্চর্য প্রোটিন মোড়ক সিজার করে বের করার আগেই হঠাৎ বার্স্ট করল। এই ঘটনা সম্পূর্ণ আকস্মিক ও ডাক্তারদের ভাবনার বাইরে ছিল। শুরু হলো প্রচন্ড ব্লিডিং। অপরেশন থিয়েটারে উপস্থিত সকল ডাক্তার বেবিকে নিরাপদে সরিয়ে দিয়ে সুনীতিকে বাঁচানোর জন্য একসঙ্গে যুদ্ধ শুরু করল। যে কেসটা কিছুক্ষণ আগেও সাকসেস্ফুল মনে হয়েছিল, তা এক ভয়ংকর মোড় নিল। লিড ডক্টর রোনাল্ড টড্, যার সম্বন্ধে কথিত আছে “ইদার গড্ অর টড্”, তারও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা গেল। তাঁর মুখে সঙ্গী ডাক্তারদের উদ্দ্যেশ্যে অত্যন্ত টেন্স গলায় শোনা গেল – “ফাস্ট, ফাস্ট”। ডাক্তারদের পাল্স রেট ক্রমে বেড়ে চলল। কিন্তু সুনীতির পাল্স রেট ক্রমাগত ফল্ করছে। ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম-র ডিসপ্লে অপরেশন থিয়েটারে উপস্থিত প্রত্যেক ডাক্তারের কাছে যেন মূর্তিমান বিভীষিকা। জীবনের রঙ্গমঞ্চে মৃত্যুর তান্ডবনৃত্য। হঠাৎ সুনীতির শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। সেই সঙ্গেই সুনীতি যেন কিছু বলার চেষ্টা করছিল। ডঃ টড্ সুনীতির অক্সিজেন মাস্কটা আলতো করে খুলে দিলেন। এক বাঙালী ডাক্তার আশ্চর্য হয়ে বলে উঠলেন – “ডঃ টড্, শি নিডস্ অক্সিজেন”! ডঃ টড্ ক্লান্ত স্বরে বললেন – “শি নিডস্ সামবডি টু হিয়ার হার লাস্ট লেটার্স”। এই বলেই ডঃ টড্ তাঁর হাতের গ্লাভ্স খুলতে শুরু করলেন। সেই বাঙালী ডাক্তার সুনীতির ঠোঁটের কাছে তার কান নিয়ে গিয়ে শুনতে চেষ্টা করলেন। সুনীতি সর্বশক্তি দিয়ে শুধু উচ্চারণ করতে পেরেছিল – “দি……”। তারপরেই সব শেষ।
সুনীতির পরিবারে শোকের ছায়া নেমে এল। সুদূর লন্ডনে একটা ছেলে চোখের জল মুছতে মুছতে ডাক্তারির ফাইনাল এক্সাম দিল। সেই ক্লাসরুম, সেই জানলা-দরজা, সেই ব্ল্যাকবোর্ড – সবকিছু একই রইল, শুধু তার পাশের ডেস্কটা খালি। পরীক্ষা চলাকালীন তার চোখ বারবার পাশের ডেস্কের দিকে চলে যাচ্ছে। সে যেন দেখতে পাচ্ছে যে সুনীতি মন দিয়ে লিখে চলেছে আর মাঝে মাঝে মুখ তুলে তার দিকে মুচ্কি হেসে আবার লেখায় মন দিচ্ছে…..। পরীক্ষা কোনরকমে শেষ হলো। কিন্তু আজ বাড়ি ফেরার পথে সে একা। তাকে রাগানোর কেউ নেই। বিজ্ঞান নিয়ে গল্প করারও কেউ নেই। আর কেউ তার নাক টানবে না, গাল টিপবে না।
বেশ কিছুদিন পর পরীক্ষার রেসাল্ট আউট হলো। যথেষ্ট প্রিপরেশন থাকা সত্ত্বেও দিগন্তের কোনরকমে পাশ হয়েছে। তা নিয়ে দিগন্তের মনে যেন কোন দুঃখও নেই।
এরপর প্রায় তেইশ বছর কেটে গেছে। ইংল্যান্ড ও আয়ার্ল্যান্ডের বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনার পর দিগন্ত এখন ইম্পেরিয়াল মেডিকেল কলেজ অফ লন্ডন এর প্রোফেসর। দিগন্তের বয়স হয়েছে প্রায় তিপ্পান্ন। চুলে পাক ধরেছে। চোখে চশমা উঠেছে। মুখের ও গায়ের চামড়ায় ভাঁজও পড়েছে। দিগন্ত আজও অবিবাহিত। বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য অনেক চাপ দেওয়া সত্ত্বেও সে বিয়ে করেনি। দিগন্ত আজও একান্তে সুনীতির জন্য চোখের জল ফেলে। কোনদিন মুখ ফুটে সুনীতিকে বলতে না পারলেও সে সুনীতিকে মনে যে স্থান দিয়েছে তারপর অন্য কোন মেয়েকে জীবনসঙ্গিনী হিসাবে মেনে নেওয়া তার পক্ষে অসম্ভব।
সেদিন কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে দিগন্তের প্রথম ক্লাস। ইন্ট্রোডাক্শান পর্ব শেষ করে দিগন্ত রিপ্রোডাক্শান ইন এনিম্যাল্স পড়াতে শুরু করল। এরপর এল সেই ‘পারথেনোজেনেসিস্’ প্রসঙ্গ। দিগন্ত সকল স্টুডেন্ট এর উদ্দ্যেশ্যে প্রশ্ন করল – “হোয়াট ইস্ পারথেনোজেনেসিস্ ?এনি আইডিয়া”? প্রশ্নটা করে দিগন্ত পিছন ঘুরে বোর্ডে “পারথেনোজেনেসিস্” শব্দটা লিখতে শুরু করল। শব্দের প্রত্যেকটা লেটার তাকে ফেলে আসা দিনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। সেই সকল অতীত জুড়ে শুধু একজনেরই মুখ দিগন্তের চোখের সামনে ভেসে উঠছে। দিগন্তের বুক ভার হয়ে উঠল। চোখ যেন ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে। তার হাত কাঁপতে লাগল। শব্দটা যেন ক্রমশ দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। সে যেন শত চেষ্টা করেও শব্দটার শেষ লেটারে পৌঁছতে পারছে না। এইসময় হঠাৎ একটা ফিমেল ভয়েস্ শোনা গেল – “মে আই ট্রাই স্যার”? এই গলার স্বর দিগন্তের ভীষণ চেনা।পরের মুহূর্তেই বিদ্যুৎ-ঝলকের মত তার মনে পড়ে গেল – “এই গলার স্বর সুনীতির দিদি সুচেতনার না”! এক ঝটকায় দিগন্ত বোর্ড থেকে মুখ ফিরিয়ে যা দেখল তাতে তার সমস্ত শরীর হিম হয়ে গেল। ছাত্র-ছাত্রীদের দ্বিতীয় সারি থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে একটি মেয়ে। সেই বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, সেই দুধে-আলতা রঙ, সেই ভীষণ চেনা দৃঢ় চিবুক। দিগন্তের সামনে দাঁড়িয়ে যেন সেই তেইশ বছর বয়সী সুনীতি। আবেগে ও বিস্ময়ে দিগন্তের ঠোঁট কাঁপতে শুরু করল। কাঁপা কাঁপা স্বরে দিগন্ত জিজ্ঞাসা করল – “হোয়া……হোয়াট্স ইয়োর নেইম্ লেডি”? মেয়েটি হেসে উত্তর দিল – “অনামিকা”।